Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তি

ইসরাত জাহান | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য: ১ জানুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ। বিবিএস এর রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০-এ জানানো হয়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত আগের ছয় মাসে জনসংখ্যা বেড়েছে আরো ৯ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ৫০ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি বিভাগের হিসেব মতে, প্রতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা ১ ভাগ হিসেবে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই স্বল্প জমিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে জৈবপ্রযুক্তির বিকল্প নেই।

জৈবপ্রযুক্তি বা নরড়ঃবপযহড়ষড়মু আধুনিক ও প্রয়োগমুখী প্রযুক্তি। ১৯১৯ সালে হাংগেরীয় কৃষি প্রকশলী কার্ল এরেকি সর্বপ্রথম বায়োটেকনোলজি শব্দটি ব্যবহার করেন। জৈবপ্রযুক্তিকে সহজভাবে বললে বোঝায় জীববিদ্যা ভিত্তিক প্রযুক্তি। এটি বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে কোনো দ্রব্য বা পদ্ধতি উৎপন্ন করে বা পরিবর্তন করে, যা মানুষের জন্য অধিক কল্যাণকর। জৈবপ্রযুক্তির প্রয়োগক্ষেত্র ৪টি (স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, শিল্প-শস্য ও অন্যান্য পণ্য) হলেও খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম কৃষিক্ষেত্রে এর অবদান অনস্বীকার্য। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধি, কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবন, পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ফলমুল উৎপাদন, অল্প সময়ে অধিক চারা একসাথে উৎপাদন, প্রজাতির মধ্যে ভিন্নতা আনয়ন, বিলুপ্ত উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ, বছরের যেকোন সময় যে কোন ধরনের জাত চাষ করা যায়। এর জন্য কোন মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।

বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে তাকালে আমরা বেশ কিছু প্রতিকূল পরিবেশ দেখতে পাই। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলায় শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত খরা যা প্রায় মরুময়তার উপক্রম,আর বর্ষা মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত বন্যা, যা প্রতি বছর শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ক্ষতি করে ৫০০ কোটি টাকারও অধিক। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটে। তাছাড়া জলাবদ্ধতা, নদীভরাট, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসব প্রতিকূল প্রভাব কাটিয়ে উঠে অধিক ফলন পেতে অবশ্যই জৈবপ্রযুক্তির স্বার্থক প্রয়োগ করতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কৃষি উন্নয়নে কৃষিবিদ, প্রকৌশলী, কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গ্রিন বায়োটেকনোলজি নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে বেশ সফলতা এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি), দেশের একমাত্র সফল গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি (Bacillus thuringiensis) বেগুন নামে বিশেষ একধরনের বেগুন উদ্ভাবন করেছে। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উৎপন্ন এই জাতটি বেশ সফলভাবে এর আবাদ স¤প্রসারণ করতে পেরেছে। বেসিলাস থুরেনজেনসিস মাটিতে বসবাস করা একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা Cry1AC বংশাণু (জিন) ধারণ করে। এই জিন একধরনের কীটনাশক প্রোটিন উৎপন্ন করে, যা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করতে পারে। যেখানে সাধারণ বেগুন চাষে ফল ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মৌসুমে অসংখ্যবার কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু বিটি বেগুন প্রাকৃতিকভাবেই এই পোকা দমন করতে পারে। এতে আলাদা করে কীটনাশক দিতে হয় না বলে উৎপাদন খরচ কম। সিংগেল আরবি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলুর লেট ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী আলু-৮ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তাছাড়া এটি টমাটোর বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী জাত উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা চলছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি), জিন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি গোল্ডেন রাইস নামে বোরো ধানের উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন জাত উন্নয়ন করেছে। উদ্ভাবিত হয়েছে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ জি আর ২-ই গোল্ডেন রাইস। এটি এ পর্যন্ত প্রায় ৭২টি উচ্চফলনশীল ধানের জাতসহ ১০৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে, যা আমাদের কৃষিক্ষেত্রে ব্যপক সাফল্য এনে দিয়েছে। অতীতে যেখানে খাদ্য ঘাটতি ছিল, সেখানে আমরা বর্তমানে চাল রপ্তানিতে তৃতীয়। গ্লােবাল ফুড আউটলুক জুন ২০২১ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০সালে বাংলাদেশ ৩ কোটি ৭৪ লাখ টন চাল উৎপাদন করেছে। এফএও ধারণা করছে যে, বাংলাদেশ চলতি বছরেও ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদন করে তৃতীয় অবস্থানেই থাকবে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা যে স্বস্তিকর অবস্থানে আছি তার নেপথ্যে ব্রির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাতের মধ্যে আউশ ২৪টি, আমন ৪৭টি, বোরো ৪৬টি, জিআই স¤পন্নজাত ৩টি। হাইব্রিড ধানের জাত ৭টি, যার গড় ফলন ৬-৭ টন/হেক্টর। অন্যান্য জাতের চেয়ে এর রোগবালাই অনেক কম। কথায় আছে হাইব্রিড ধান করলে চাষ, খাবার থাকবে বারো মাস। জিংক সমৃদ্ধ ধানের জাত ৬টি। এ জাতের চালে এমাইলোজের পরিমাণ ২৬% ও প্রোটিন প্রায় ৯ ভাগ। খরাসহিষ্ণু জাত ৭টি। দেশের খরাপ্রবণ এলাকায় বিশেষ করে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, চুয়াডাঙ্গায় বেশি বপণ করা হয়। জলমগ্নতাসহিষ্ণু জাত ৩টি ব্রি-৫১,৫২,৭৯ এগুলো বন্যা প্রবণ অঞ্চলে ১৮-২০ দিন বন্যার পানিতে ডুবে থাকলেও ৪-৪.৫ টন/হেক্টর। এন্টিঅক্সিডেন্টালসমৃদ্ধ জাত ১টি, বিআর ৫ যা টুংরো ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধশীল এর খুবই জনপ্রিয় আরেক নাম দুলাভোগ।

ধানের পরই গমের অবস্থান। বর্তমানে গমের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে দেশে গমের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। বারি উদ্ভাবিত বারিগম-২৫ (তাপ ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু), বারিগম-২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ (তাপ সহিষ্ণু), বারিগম ৩৩(তাপ সহনশীল ও ব্লাস্ট রোগপ্রতিরোধী)। গমের পর তৃতীয় অবস্থানে আছে ভুট্টা। ধানের তুলনায় ভুট্টা সেচ সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও অধিক ফলনশীল। বারি কর্তৃক মোট ১৬টি জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাত হলো বারি হাইব্রিড ভুট্টা ১২ (খরা সহিষ্ণু), ১৩ (তাপ ও খরা সহিষ্ণু), ১৪, ১৫ (তাপ সহিষ্ণু), ১৬ (তাপ ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু, স্বল্প উচ্চতা সমপন্ন জাত, যা ঝড়ো বাতাসে ভেঙে পড়ে না।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি ইন্সটিটিউট (বিনা) খরা, বন্যা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু, উচ্চমাত্রার ফলনশীল, কম জীবিতকাল জাত উদ্ভাবন করেছে। বিনা ১৬, বিনা ১৭ ধানের জাত চাষ করে কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছে। বিনা ধান-১৭ খরা সহিষ্ণু ও স্বল্পমেয়াদী সেই সাথে উন্নত গুণসম্পন্ন আমন ধানের জাত এতে সার খুব কম লাগে। বিনাধান-১১ বন্যা সহিষ্ণু। বিনা উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে ধানের ২৪টি, তেল ফসল ৩০টি, ডাল ফসল ৩৩টি, গম ১টি, পাট জাত ২টি, সবজি ১৪টি, মসলা জাতীয় ৬টি ও লেবু জাতীয় ২টি। তাছাড়া মটরশুটির ডিএনএ হেলিকাস জিন কনফিউশনের মাধ্যমে লবণাক্ততাসহিষ্ণ এইচওয়াইভি ধান উদ্ভাবনে ব্রির ট্রান্সজেনিক গ্রিনহাউজ এ সীমিত আকারে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাবির প্রাণ-রাসায়ন ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ। জিন ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে ধানের বাড়তি উৎপাদনশীল, প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনেও কাজ করছে। একইসঙ্গে ঢাবির বুটানি বিভাগ চিনাবাদাম, মটরশুঁটি ও ডালের ছত্রাক প্রতিরোধী ও মুগ ডালের ইয়েলো মোজাইক ভাইরাস প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে।

এছাড়াও মসুর, ছোলা, খেসারী, মূগ, মাসকলাই, সরিষা, তিল, চিনাবাদাম, লিচু, নারিকেল, আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কাঁঠাল, কুল, আনারস, লেবু, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, ধনিয়া, টমেটো, বেগুন, আলু, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন এর জাতে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড কৃষিকে আরো মজবুত, শক্তিশালী ও প্রভাবশালী করতে জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে ব্যপক হারে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশের মাটি খাঁটি সোনার চাইতেও খাঁটি আর সেই সোনার জমিতে সোনালি ফসল ফলিয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জৈবপ্রযুক্তির জুড়ি নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষি


আরও
আরও পড়ুন