পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানবাধিকারের পক্ষে অনেকেই কথা বলছে। কেউ কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য গড়ে উঠেছে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য বিদেশি মানবাধিকার মুখপাত্র। যেসব ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র যেমন, আমেরিকা ও ভারত যারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসহ ছোট ছোট রাষ্ট্রের মানবাধিকার হরণ করছে তারাও মানবাধিকার গেল, মানবাধিকার গেল বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, প্রচারের জন্য খরচ করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আফগানিস্তানকে মার্কিনিরা দখল করে সেখানে মার্কিন মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ একটি উপহাসের বিষয়ে পরিণত। কারণ, পৃথিবীর কোথাও এর কার্যকারিতা নেই। রোহিঙ্গারা মানুষ নয়, বরং কীটপতঙ্গের মতো দিনযাপন করছে। মানবাধিকার তাদের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এমনি বহু ঘটনা ঘটছে, যা পৃথিবীবাসী জানে। আবার কোনোটা অজানাও থেকে যায়। অমানবিক ঘটনার মাধ্যমেই পৃথিবীর সেরা সেরা বহু ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। একজন খুন করলে খুনির ফাঁসি হয়, ১০০০ খুন করলে ইতিহাসের পাতায় খুনি হয় ‘হিরো’। ইতিহাস সে হিরোকে যারপরনাই সম্মান দেয়। ইতিহাসবিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে নায়ক ও খলনায়কের অবস্থান। ফলে অনেক সময় নায়ক পরিচিতি লাভ করে খলনায়ক হিসেবে, খলনায়কের পরিচিতি আসে নায়ক হিসেবে এবং এটাই পৃথিবীর ইতিহাসের ট্র্যাজেডি।
সরকার বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে সত্য, কিন্তু মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন পাস করেনি। সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘মৌলিক মানবাধিকারের’ উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে যে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সবপর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ উল্লেখ্য, সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন’ ১৯৯১ (১৯৯১ সালের ২৮নং আইন) এর ২ ধারাবলে সংবিধানে ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, বর্তমান আমলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত হচ্ছে তা কারো অজানা নেই। বাস্তব চিত্র যা-ই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবীদের মুখে মুখে তো ‘জনগণের অংশগ্রহণেই নির্বাচন হচ্ছে’।
স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছরেও মানবাধিকার প্রয়োগসংক্রান্ত কোনো আইন পাস করা হয়নি। সংবিধানের তৃতীয় ভাগ মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের অনুচ্ছেদ-২৬ থেকে ৪৪ পর্যন্ত মানবাধিকার রিলেটেড অনেক অনুচ্ছেদ থাকলেও বাস্তবায়নের অভাবে যেসব মুখ থুবড়ে আছে এবং জনগণ এটাই দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে, যদিও সরকার এ কথা মানে না। কারণ ক্ষমতায় থাকলে অনেক সময় নিজেদের ভুল নিজেদের কাছে ধরা পড়ে না। তাছাড়া সংবিধানের নীতিমালা ও ক্ষমতার প্রয়োগ যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবতা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখা সরকারের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
সরকার বা পার্লামেন্ট সদস্যদের উপস্থাপিত প্রস্তাবনার আলোচনা পর্যালোচনা করে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে থাকে, যা রাষ্ট্রপতির সম্মতি স্বাক্ষরে অনুমোদিত হয়। রাষ্ট্রপতি পুনর্বিবেচনার জন্য প্রস্তাবিত আইন ফেরত না পাঠালে তা-ই অনুমোদিত হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। আমাদের রাষ্ট্রে মানবাধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো আইন গৃহীত বা পাস হয়নি। রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন নির্ভর করে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাই বাস্তবে আইন। আইনের খসড়া প্রস্তুত করেন আমলারা।
আইনের খসড়া নিয়ে বিতর্ক দূরের কথা, সংসদে কোনো আইন পাস হচ্ছে তাও অধিকাংশ এমপির খুটিয়ে দেখার সুযোগ নেই। একসময় বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, কেরানিরা (আমলা) আইন লেখে, যা পার্লামেন্টে ‘হাঁ’ ‘হাঁ’ করে সব পাস করে দেয়। আইন নিয়ে ডিবেট করার যোগ্যতাসম্পন্ন সংসদ সদস্যের অভাব রয়েছে। সা¤প্রতিককালে পার্লামেন্টে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও যেন খুঁজে খুঁজে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের দলে ভেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে টাকাওয়ালাদের অনেক গুরুত্ব। নির্বাচন এখন টাকার খেলা। রাজনৈতিক একটি টাউট শ্রেণী রয়েছে, যারা টাকার বিনিময়ে নির্বাচনী খেলা খেলে। নীতি-আদর্শ বলতে কোনো কিছুরই তারা ধার ধারে না। নির্বাচনের প্রাক্কালে কোরবানির হাটের মতো সব হাটেই ঢুঁ মারে, কোনো না কোনো হাটে উচ্চমূল্য তো পাওয়া যাবেই, এ প্রত্যাশায়।
এ অবস্থা চলছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে আয়োজিত ভারতের স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এনভি রমন আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আইনের কোনো স্পষ্টতা নেই। আমরা জানি না, কী উদ্দেশ্যে আইন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। এটা হচ্ছে, যখন পার্লামেন্টে আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবী উপস্থিত নেই।’ তিনি আরো বলেন, যদি আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, তাদের অনেকেই ছিলেন আইনগত দিক দিয়ে জানাশোনা ব্যক্তি। লোকসভা এবং রাজ্যসভার প্রথম সদস্যপদে বসানো হয়েছিল আইনজীবী স¤প্রদায় থেকে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন আমরা পার্লামেন্ট হাউজে যা দেখি, তা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ওই সময় পার্লামেন্টে বিতর্ক হতো অত্যন্ত গঠনমূলক। আর্থিক বিল নিয়ে বিতর্ক আমি দেখেছি। এই বিতর্ক থেকে অনেক গঠনমূলক পয়েন্ট বেরিয়ে আসত। আইন নিয়ে আলোচনা হতো এবং তা অনুমোদন করা হতো।’ বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্য জন্ম দেয় রাজনৈতিক দল। হালে রাজনৈতিক দলে টাকাওয়ালাদের অনেক প্রভাব। দলগুলোও টাকাওয়ালাদের টাকা কোন পন্থায় উপার্জিত তা দেখে না, তাকিয়ে থাকে দলে ভিড়িয়ে নমিনেশন দেয়ার জন্য। জনগণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তখন গৌণ হয়ে যায়। কোন পন্থায় ক্ষমতায় বসা যাবে, এটাই হয়ে যায় মুখ্য। ফলে আমাদের দেশের রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুলিশ, আমলা ও গোয়েন্দাদের হাতে পড়েছে।
প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, গ্রেফতার করার পর পুলিশ গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির সাথে আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয় না। এমনও সংবাদ পাওয়া যায় যে, আটক করার বেশ কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার না দেখিয়ে পুলিশ কাস্টডিতে ফেলে রেখে নির্যাতন করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম, খুন তো এখন প্রায় গা সওয়া। গ্রেফতার করা ব্যক্তির সাথে কী রকম আচরণ করতে হবে, এ মর্মে সংবিধানের ৩৩(১) ও ৩৩(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘১. গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শিগগির গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না। (২) গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’
সংবিধান ও শাসন যদি সাংঘর্ষিক হয় এবং সংবিধান যখন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে তখন আইনের প্রতি মানুষ আস্থাহীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধ করে একটি জাতি কেন স্বাধীনতা চায়? এর পেছনের কারণ কী? এর পেছনের যুক্তি হলো, মানুষ চায় তার বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা জন্মগত ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তাসহ রাষ্ট্র থেকে মানবিক আচরণ। যে ক্ষমতায় থাকে সে যদি সীমালঙ্ঘন করে, এ লঙ্ঘনের দায় রাষ্ট্রই বহন করার কথা। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাষ্ট্র সীমালঙ্ঘনকারীকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে এবং তখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। মানবাধিকার বাস্তবায়নে যদি সুনির্দিষ্ট কোনো আইন থাকত তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার একটি পথ খোলা থাকত। সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে প্রদত্ত নির্দেশনার কি কার্যকারিতা বর্তমানে রয়েছে?
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।