Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন্যার অবনতি ১২ জেলায়

ভারতের ঢল আসছে হু হু করে : ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসহ আট নদী ১৫ পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্লাবিত নতুন নতুন এলাকা : লাখো বানভাসি মানুষের বাড়ছে কষ্ট-দুর্ভোগ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

উজানে অতিবৃষ্টির সাথে হু হু করে আসছে ভারতের ঢল। উত্তাল হয়ে ফুলে-ফুঁসে উঠেছে দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহ, শাখা-প্রশাখা, উপনদী-খাল। এরফলে বন্যা ও নদীভাঙন আরো বিস্তৃত হয়েছে। সকাল-বিকাল-রাতে দফায় দফায় পানি বাড়ছে নদ-নদীর। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গতকাল শনিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাসে জানায়, আজ রোববার উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উত্তর-মধ্যাঞ্চলে জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর হয়ে ভাটিতে শরীয়তপুর ও দক্ষিণের মোহনায় চাঁদপুর এই ১২টি জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি ও ভাঙন অব্যাহত থাকায় আরও বিভিন্ন এলাকা বন্যার মুখে রয়েছে। এদিকে গতকাল উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এরফলে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
উজানে ঢলের সঙ্গে ভারতে সব বাঁধ-ব্যারেজ একযোগে খুলে দেয়ার কারণে ভাটিতে দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহে ক্রমাগত বাড়ছে পানি। গতকাল ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনাসহ আটটি নদ-নদী ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির দিকে এবং বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। পানি যতই বাড়ছে নদীভাঙনের ততই বিস্তার ঘটছে উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল হয়ে ভাটিতে দক্ষিণের চাঁদপুর মোহনা, বৃহত্তর বরিশালের উপকূলভাগ পর্যন্ত।

ভাঙনের আতঙ্কে ঘুম নেই নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। লাখো বানভাসি মানুষের বাড়ছে কষ্ট-দুর্ভোগ। পৈত্রিক বসতভিটা, ফল-ফসল, বাগান, ক্ষেত-খামার, রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা নদীগর্ভে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সড়ক, রাস্তাঘাট ভেঙে ও ধসে পড়ছে অনেক জেলা-উপজেলায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
দেশের নদ-নদী পরিস্থিতি সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা, দুধকুমার, ধলেশ্বরী, আত্রাই এই ৮টি নদ-নদী ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫২টি স্থানে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে।

শুক্রবার নদ-নদীর ৬১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪২টিতে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ১২টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বৃহস্পতিবার ৭২টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৫টিতে হ্রাস, দু’টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ১০টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বুধবার ৬৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৯টিতে হ্রাস, ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।

নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা ব্যতীত প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। যমুনা নদ পুরাবাড়ি পয়েন্টে ইতোমধ্যেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।

গতকাল বিকাল পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা উভয় নদ এবং এর শাখা-প্রশাখা, উপনদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে পানি আরও বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

যমুনা নদে গতকাল আরও তিনটি স্থানে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে যমুনা ফুলছড়িতে বিপদসীমার ২ সে.মি., বাহাদুরাবাদে ৭ সে.মি., সারিয়াকান্দিতে ২৬ সে.মি., কাজীপুরে ১৯ সে.মি., সিরাজগঞ্জে ২৮ সে.মি., পুরাবাড়ীতে এক এবং মথুরায় দুই সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
ধরলা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৩৪ এবং দুধকুমার নদী পাটেশ^রীতে ১২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে ভারতে গজলডোবা বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে আবারও। লালমনিরহাট জেলার কাউনিয়ায় তিস্তা বিপদসীমার মাত্র ৫ সে.মি. নিচে এসে গেছে।

উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ^রী নদীর পানি কিছুটা বেড়ে টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ৩৬ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মা নদীর পানি কোথাও হ্রাস কোথাও স্থিতিশীল রয়েছে। পদ্মায় গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৪৩ সে.মি. এবং সুরেশ্বরে ৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মাওয়া ও ভাগ্যকুলে মাত্র ৪ সে.মি. নিচে রয়েছে। মেঘনা নদীর ভাটি-মোহনায় চাঁদপুরে পানি বিপদসীমার এক সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বেতনা নদীর পানি আরও কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।

মো. হায়দার আলী গোদাগাড়ী (রাজশাহী) থেকে জানান, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমতলা, চাক পাড়া, খারিজাগাঁতি ও মোল্লাপাড়ায় পদ্মা নদীতে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার বিঘা এলাকার ফসলি জমি, আম বাগান। হুমকির মুখে রয়েছে বসতবাড়ি, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

প্রতি বছর বন্যার সময় পদ্মা নদী ভয়ালরূপ ধারণ করে। পদ্মার তীব্র ভাঙ্গনে আম বাগান, বিভিন্ন ফলের গাছ, ফসলী জমি যাচ্ছে নদীগর্ভে। গত ১৫ দিন ধরে উপজেলার নিমতলা চাক পাড়া, খারিজাগাঁতি ও মোল্লাপাড়া এলাকায় দেখা দিয়েছে এই ভাঙন। হুমকির মুখে রয়েছে ফসলি জমি, পাশাপাশি বসতবাড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। এই বুঝি সব তলিয়ে গেল, সর্বনাশা পদ্মা নিয়ে গেল আমাদের জান মাল, গবাদিপশু।

শনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভেঙে পড়ছে নদীপাড়ের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। পদ্মার ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) লোকজন সেখানে ফেলছেন জিও ব্যাগভর্তি বালু। তারপরও থামছে না পদ্মার ভায়ন।
পাউবো সূত্র জানায়, গত ১৭ আগস্ট নিমতলী গ্রামের ভাঙনের কথা জানার পরদিনই জিও ব্যাগভর্তি বালু ফেলে সাময়িকভাবে প্রতিরোধ চেষ্টা করা হয়। ১৮ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বস্তা জিও ব্যাগে বালু ফেলা হয়েছে। তবে সেখানে ১০ হাজার বস্তা জিও ব্যাগ ফেলা হবে।
পাউবোর সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার রিফাত করিম বলেন, ভাঙন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা আগে এখানে ছিল না। ভাঙন ঠেকাতে এলাকায় ১০ হাজার বস্তা জিও ব্যাগে বালু ফেলার কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে।

নুরুল আলম সিদ্দিকী,জামালপুর থেকে জানান, জামালপুরের বকশিগঞ্জের কুশল নগর গ্রাম। ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ সুরুজ্জামান পৈত্রিক বাড়িতে বাস করছেন জন্মলগ্ন থেকে। তীব্র ভাঙ্গনে সেই বাড়ির অধিকাংশই চলে গেছে নদী গর্ভে। বাকিটুকু ভাঙনের মুখে।

স্থানীয়দের দাবি- পনেরো দিন যাবত ভাঙন অব্যাহত থাকলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। এলাকাবাসীর চাঁদার টাকা দিয়ে বাশের বাঁধ দেওয়া হলেও কমছে না ভাঙন। নদী ভাঙন রোধের বিষয়ে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, কুশল নগর গ্রামে দশআনী নদীর ভাঙনের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এই ভাঙন রোধে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে প্রতিরক্ষা কাজের জন্য ইতিমধ্যে বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ পেলেই আমরা দ্রুত টেন্ডার করে এই ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

আব্দুস সালাম, বিশ্বনাথ (সিলেট) থেকে জানান, খাজাঞ্জি ইউনিয়নের রাজাগঞ্জ বাজারের দক্ষিনে গোবিন্দ নগর গ্রামের পাশে পূর্বদিকে মোড় নিয়েছে নদীটি। শীতকালে নদীর পানি কমলে কিংবা বর্ষাকালে নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে এই মোড়ে প্রবল ভাঙ্গন শুরু হয়। গত কয়েক বছরে গোবিন্দ নগর গ্রামের পূর্ব ও উত্তরাংশে একটি বাড়ি, রাস্তা ও কয়েকটি কবর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গ্রামবাসি বিভিন্নভাবে বাশ দিয়ে আড় বেঁধে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেও ভাঙ্গন রোধ করতে পারছেন না। পানির ঢেউয়ে বালুর বস্তা বাশ চুখের পলকেই পানিতে তলিয়ে যায়। আর মাত্র কয়েক ফুট জায়গা ভেঙ্গে গেলে নদীর তীরের বাড়ি ঘর ও গোবিন্দ নগর জামে মসজিদ এবং পাশের কবরস্থানটি নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যেতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ