Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিল্পকারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হবে

মোঃ মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ জন শ্রমিক মারা যায়। এ দুর্ঘটনার মাধ্যমে শিল্প কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তহীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে। অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পরিবেশ নেই। এতে বর্হিবিশে^ বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। বড় বড় কারখানায় যখন কোনো আগুনের ঘটনা ঘটে তখন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তি ও মালিকপক্ষের লোক ও শ্রমিক নেতারা নানা বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে থাকেন। যেমন আগামীতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে এ ব্যাপারে সজাগ থাকবো। মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের ক্ষতিপূরনের কথা ও নানা আশ^াসবাণী দেয়া হয়। গঠন করা হয় তদন্তকমিটি। পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে খবর প্রচার হয়। সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীল কর্তা-ব্যাক্তিরা বলে থাকেন ‘ঘটনাটি মর্মান্তিক’। ‘যারাই দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের বিচার হবে’। কিছু দিন যাওয়ার পরে অন্যকোন ঘটনায় এটি চাপা পড়ে যায়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আর খুঁজে পাওয়া যায়না। বারবার এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর নিউইয়র্ক টাইম্স পত্রিকায় সম্পদকীয়তেও স্থান পেয়েছে। আরও অনেক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে আমাদের শিল্পখাতের নানা দুর্বলতা ও দেশের বদনাম হচ্ছে। কলকারখান, শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা রোধে এবং শ্রমিকেরা যাতে নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করনে শক্তিশালী সমন্বয় কমিটি গঠন করে কারখানা পরিদর্শন ও তদারকির মাধ্যমে কর্ম পদক্ষেপ উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষ (বিডা), এফ বি সি সি আই, বিজিএমইএ এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাÐ ও ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের মাধ্যমে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত কতটা নাজুক এবং শ্রমিকদের বঞ্চনার হার কত মাত্রায় উঁচু তা উপলব্ধি করা যায়। তবে রানা প্লাজা ঘটনায় জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৩-২০১৮) এর আওতায় দেশের পোশাক শিল্পে নিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা সত্তে¡ও এখাতে নিরাপত্তার বিষয়টি বর্তমানে জটিল পরিস্থিতি মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অ্যাকর্ড-এ্যালায়েন্স (২০১৫-২০১৮) সময়ে বা তার পরবর্তী সময়ে দেশের পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনার সংখ্যাগত দিক থেকে কমেছে বটে কিন্তু তৈরী পোশাক খাতের বাইরেও হাজার হাজার কারখানা আছে যেখানে শ্রমিকেরা নিয়ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনায় পোশাক ও বস্ত্রখাতসহ মোট কারখানা আছে প্রায় ৭ হাজার ৮২৪ টি। তৈরী পোশাকের বাইরে থাকা কারখানায় অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি সিপিডির এক ভার্চুয়াল আলোচনায় মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মে থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গত তিন বছর পোশাক শিল্পে, (নিট, ওভেন,সোয়েটার) ৪৬ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মাঝারি আকারের কারখানাগুলোতে। আগুন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, কারখানার কাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ ইত্যাদি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিদর্শনে দেশের বিভিন্ন কারখানা ও ভবনের প্রায় ৯০ শতাংশের ঝুঁকিপূর্ণ অথবা অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। দুর্ঘটনা ঘটনার পর উঠে আসে অবহেলার নানাচিত্র। ২০০০ থেকে ২০২১ সালের অগ্নিকাÐ ও বিস্ফোরণের চিত্র থেকে উঠে আসে শ্রমিকরা কত বৈরী পরিবেশে কারখানায় কাজ করে। ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার চৌধুরী নিট ওয়্যারে আগুনে নিহত হয় ৪২ জন শ্রমিক, আগস্ট ২০০১-এ মিরপুরে ম্যাক্রো সোয়েটারে আগুনে ২৪ জন, ২০০৫ সালে জানুয়ারীতে নারায়নগঞ্জের শান নিটিং অ্যান্ড প্রসেসিং লিমিটেড আগুনে নিহত হয় ২৮জন এবং একই বছরে এপ্রিলে আশুলিয়ায় স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধসে নিহত হয় ৬৪ জন শ্রমিক, ২০১৬ সালের ফেব্রয়ারীতে চট্টগ্রাম কেটিএস টেক্সটাইল মিলে আগুনে নিহত হয় ৬৫ জন, একই বছরে ঐ মাসেই তেজগাঁও শিল্প এলকায় ফিনিক্স টেক্সটাইলের ভবন ধসে নিহত হয় ২১ জন, ২০১০ সালে ফেব্রæয়ারীতে গাজীপুরের গরিব ও গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরীতে আগুনে নিহত হয় ২১ জন একই বছর ডিসেম্বরে আশুলিয়া হামীম গ্রæপের ফ্যাটসইট স্পোটর্স ও্যয়ারে আগুনে নিহত হয় ২৯ জন এর পর ২০১২ সালে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকান্ডে নিহত হয় ১১২জন ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজায় ধসের কথা করো অজানা নয়, সেখানে নিহত হয় ১১৩৮ জন। সর্বশেষ এ বছরে (২০২১) জুলাই মাসে নারায়নগঞ্জে হাসেম ফুডস ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হয় শিশুসহ ৫২ জন শ্রমিক। এসব কারখানায় যেসব পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছে তাদের কান্না কি থামবে? আর কত শ্রমিক, কত পরিবার তাদের স্বজনদের হারাবে? কাদের অবহেলা, অব্যবস্থাপনায় এসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে? বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখা উচিৎ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানা ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ও ভবনে ঝুঁকি নিরসনের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিলোনা। ভবন ও কারখানায় মালিকদের উদাসিনতা এবং সরকারী তদারক সংস্থার গাফলতি ও দায়িত্বহীনতায় নানা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

পোশাক শিল্পের কারখানা বা অন্য যেকোনো কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে মালিকদেরকে বিভিন্ন সংস্থায় অনুমোদন নিতে হয়। কারখানা নির্মানের চেকলিস্ট থাকে। চেকলিস্ট অনুযায়ী, কারখানায় অভ্যন্তরীন ও ব্যাহ্যিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু কাজ ও নিয়ম মানার বিষয় থাকে। এক্ষেত্রে কারখানা শুরুর আগের কিছু বিষয় থাকে, কিছু বিষয় কারখানা চলমান বা চালু অবস্থায় করতে হয় এটা কারখানার ধরণ ও অবস্থার আলোকে হয়ে থাকে। যেমন কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, কারখানা লে-আউট প্ল্যান, পরিবেশ ছাড়পত্র, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ এর জন্য রাস্তার, প্রয়োজনীয় জেনারেটর, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা , পয়ঃনিস্কাশন ও ব্যর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকদের প্রবেশ ও বর্হিঃগমনসহ মালিকদেরকে ২০১৫ সালের শ্রম আইন ও বিধিবিধানসহ কতগুলো পূর্বশর্ত মানতে হয়। এসব ঠিকঠাক করে কারখানা প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই), ফয়ার সার্ভিস ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)সহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকি ও কার্যকর পরিদর্শন হলে কারখানার টেকসই পরিবেশ রক্ষা ও অগ্নির ঘটনা ও বিস্ফোরণসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যাতায়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থার বিষয়ে মালিকদের যতটা ভাবা দরকার তা না করে তারা নিজেদের মুনাফা নিয়েই বেশী ভাবেন। তাজরীন গার্মেন্টসে আগুনের ঘটনার পরে জানা গেছে, কলাপসিবল গেটে তালা ছিল, নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডসের গেটও তালাবদ্ধ থাকায় শ্রমিকেরা বের হতে পারেনি। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে শুধু এধরনের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করা হয় ১৫৪ টি। এছাড়া এসময় হাসপাতালে ও হাসপাতালের বাইরেও এসব ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

আমাদের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিতকরে পরিদর্শনের আলোকে অগ্নি ও অন্যান্য দুর্ঘটনা নিরোধের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে বর্হিবিশে^ আমাদের ভাবমর্যাদায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পোশাক রপ্তানিসহ আমাদের চামড়া রপ্তানি, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, জুতা ও বাইসাইকেলসহ রপ্তানি পণ্য বিদেশে নির্বিঘœ রপ্তানিতে যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তাতে সকল কারখানা ও তার পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা দূরিকরণে সরকারী নীতি সহায়তা ও তদারকি আরও জেরদার করা উচিত। শ্রমিকদের সুরাক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ডিআইএফই’র হিসাবে বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ কারখানা, দোকান ও স্থাপনা নিবন্ধিত রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে পরিদর্শনের জন্য প্রয়োজনে জনবল নিয়োগ করা উচিত। নারায়ণগঞ্জের রূপঞ্জের হাসেম ফুড্স লিমিটেডের অগ্নিকাÐের ঘটনার পরে কলকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা রোধে ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে সভাপতি করে যে ২৪ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে আশা করি, তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে শিল্প কারখানা সরেজমিন পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ও অগ্নি ও অন্যান্য দুর্ঘটনা নিরোধের বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান করবেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পায়নের যে উজ্জ্বল সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগাতে হলে কারখানার পরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের মৌলিক জীবিকার জন্য জরুরী নগদ সহায়তা প্রদান ও কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষদ্র ও মাঝারি শিল্পের পুণরুদ্ধারের জন্য মেয়াদী তারল্য সহায়তা প্রদান করা উচিত।
লেখক: অর্থনীতিবীদ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমিক

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন