পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘বঙ্গবন্ধু’ যে উপাধিতেই তাঁর অতুল্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে। ছোট থেকেই নির্ভীক আর সাহসিকতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সবসময় সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন এবং ন্যায়ের পথে চলেছেন। অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে তিনি দিয়ে গেছেন সর্বদা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম এই মহানায়কের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিশোর থেকে কখনো পিছপা হননি ন্যায্য কথা বলতে। সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন বীরদর্পে। তিনি ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও শোষিত মানুষের অধিকারের আদায়ের সংগ্রামে সচেষ্ট থেকেছেন সর্বক্ষণ। অত্যাচার এবং অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই তিনি ওঠেন বাঙালির প্রতিটি ন্যায্য অধিকার আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। আর সেজন্য শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহুবার। একাধিকবার তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। ফাঁসির মঞ্চও তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। বাঙালির প্রতি তার বিশ্বাস ও আস্থা ছিল আকাশচুম্বী। আর সেজন্যই হাসিমুখে, নির্ভীকচিত্তে মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সব ধরনের জুলুম ও নির্যাতন বরণ করেছেন সোনার বাংলার স্বপ্নসারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর অন্ধকারের অতল গহীনে ডুবতে থাকা বাঙালি জাতির মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আবির্ভূত হয়ে নায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন একের পর এক নেতৃত্ব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাঙালিরা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হবে। বাঙালি জাতির উপর একের পর এক আঘাত হানে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি। যার ফলে বাঙালি জাতির ইতিহাসে খচিত হয় ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন। উক্ত আন্দোলনগুলোর প্রতিটিতে সামনে থেকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু, যার ফলে কোনো আন্দোলনই বিফলে যায়নি এবং সফল পরিসমাপ্তি হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
মানুষকে সংঘবদ্ধ করার এক অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডাকে ধনী-গরিব, ছোট-বড় সকলেই সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। যেটার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখেছিলাম স্বাধীনতা আন্দলোনের ঠিক আগ মুহূর্তে ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। সেদিন রেসকোর্সের ময়দানে বিশাল জনসভায় সমবেত জনতাকে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে বলেন। ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তখন সারাদেশের মানুষ, এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও সে ডাকে সাড়া দেন। ভাষণ সমাপ্তির প্রাক্কালে জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর আহবান, আবেগঘন বক্তৃতা, বাংলার জনসাধারণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর আহবানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত, জাত, পাত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়।
ওই ভাষণের পর থেকেই বাঙালিরা নিজেদের একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে। তখনই ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর স্বশস্ত্র পাক বাহিনী ভীরু কাপুরুষের মতো ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ও ন্যাক্কার জনক গণহত্যা চালায়। এই নারকীয় হত্যাকান্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিদারুণ পীড়া দেয়। বঙ্গবন্ধু তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি জানতেন যেকোন মুহূর্তেই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তাই তিনি আর কালক্ষেপণ না করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। লাখ মানুষ শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ওই ঘোষণার অপেক্ষায় ছিলেন। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার মানুষের অধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। যে সংগ্রামের শুভ সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভিতর দিয়ে। যে ভাষণের আহবান বাঙালি জাতির অনুভূতিকে সোচ্চার করে তাদের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালিদের ওপর চলল পাকিস্তানি আগ্রাসন। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ এবং কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জিত হলো। কিন্তু থেমে থাকেনি বাঙালিদের রক্তাক্ত প্রতিরোধ। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। লাখ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হলেও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে অবিচল ছিল। ওই ঐক্য শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছিল একটি মাত্র বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য আর তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সবই ছিল আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, আমাদের টিকে থাকার লড়াই। আর এ লড়াইয়ের ইতিহাস, আমাদের গৌরবের ইতিহাস, যার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দেশ স্বাধীনের পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীন দেশের স্থপতি, মৃত্যুঞ্জয়ী, সর্বকালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফিরে তিনি একটি মুহূর্তও অপচয় করেননি। দেশকে এগিয়ে নিতে বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ও প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতার পর সরকার গঠনের সাথে সাথে তার একের পর এক প্রতিফলন হতে শুরু করে। একটি জরাজীর্ণ ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, প্রচেষ্টা, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের সময়ের দরকার ছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশের ভিতরে গড়ে ওঠা ঘাতকদের কারণে তিনি সেই সময় পাননি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের পরম আত্মীয়। পৃথিবীর খুবই কম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর মতো এতটা ঈর্ষানীয় জনপ্রিয়তা লাভ করতে পেরেছিলেন। তিনি সর্বদা ভাবতেন, সকল বাঙালি তাঁর বন্ধু। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তার নিজের বা পরিবারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। আর এই বিশ্বাস থেকেই সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে তিনি থাকতেন তাঁর প্রিয় বাসভবন ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসায়। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর অসম্ভব প্রিয় ছিল। কিন্তু তাঁর এই অগাধ বিশ্বাসের কোনো মূল্যই দেয়নি অকৃতজ্ঞ কিছু নরপশু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা ভীরু কাপুরুষের মতো বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে স্বশস্ত্র আক্রমণ চালায়। যে আক্রমণের বর্বরতা ইতিহাসে বিরল। হামলার পর দেখা গেছে ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরের দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে তর তাজা মৃতদেহগুলো পড়ে আছে। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকরা সেইরাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে উপস্থিত সবাইকে হত্যা করে। রেহাই পাইনি আট বছর বয়সের নিষ্পাপ ছোট্ট শিশু বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল।
এভাবেই নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে রচিত হয় বাঙালি জাতির জন্য আরও একটি কালো অধ্যায়। বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পরে এধরনের প্রতিদান অকল্পনীয়। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে সেদিন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কোনো একটি দেশের স্থপতি ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে তার পরিবারের সদস্যসহ এমন ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেদিনকার হত্যা শুধু বঙ্গবন্ধুর হত্যা ছিল না। হত্যা করা হয়েছিল একজন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতাকে। জনগণের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া একজন মহান ব্যক্তিত্বকে। ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী প্রণেতাকে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। যে হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাঙালি জাতির চিন্তা, চেতনা ও আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়।
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।