পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সামাজিক-অর্থনৈতিক, পরিবেশ-প্রতিবেশ, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত যেসব মানদন্ড কোনো জাতির উন্নয়ন ও উন্নতির সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেসব সূচকের প্রায় সবগুলোতেই পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা অতিমারির শুরুতেই বলা হয়েছিল, এই মহামারী বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে। যে সব দেশ যথাযথ প্রক্রিয়ায় করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থ হবে, সেসব দেশ নিজের অবস্থান ও সম্ভাবনা থেকে পিছিয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ, মৃত্যুর হার কমাতে চিকিৎসা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রæততম সময়ে সব নাগরিককে করোনা ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমেই কেবল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকা সম্ভব হতে পারে। নতুবা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হবে দেশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে দেড় বছরের অধিক সময় ধরে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। কোটি কোটি শিক্ষার্থী এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা ও মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় দেশের কলকারখানাগুলো খোলা রাখা হলেও, কোনো বিসিক শিল্প এলাকা বা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় শ্রমিক কর্মচারিদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের বাড়তি কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। কঠোর বিধিনিষেধ ও কঠোর লকডাউনের মধ্যেও গত একমাস ধরে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গণপরিবহন বন্ধসহ চৌদ্দ দিনের কঠোর লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্ট কারখানাসহ রফতানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে করোনা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চলছে ধীর গতিতে। যেখানে প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়ে ১ বছরের মধ্যে দেশকে উন্নয়নের স্বাভাবিক গতিধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে, নানা দেশ থেকে দান-অনুদান খয়রাতি ডোজ দিয়ে টেনে হেঁচড়ে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সরকারের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো কমতি দেখা যায়নি। কিন্তু ফলাফল ঘটেছে বিপরীত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমলাতন্ত্রের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা বিদেশি এজেন্ট অথবা রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি দেশকে প্রতিবেশী দেশে ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির ফাঁদে ফেলে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। প্রধান টিকা উৎপাদনকারী বড় দেশগুলো যেখানে দ্রæততম সময়ে দেশকে লকডাউন-শাটডাউনের অচলায়তন থেকে মুক্ত করতে বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের কৌশল গ্রহণ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশের আমলা-মন্ত্রীরা ভারতীয় প্রেসক্রিপশন গিলে চিন-রাশিয়ার প্রস্তাব উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে টিকার চুক্তি করে দেশকে বড় ধরনের প্রতারণা ও ক্ষতির সম্মুখীন করেছেন। দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য অন্তত ৩৬ কোটি ডোজ করোনা টিকা প্রয়োজন হলেও সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে সাড়ে ৩ কোটি ডোজ টিকার জন্য চুক্তি করে সব অর্থ পরিশোধ করার পর প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকা হাতে পেয়ে গত ফেব্রæয়ারিতে বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে ভারত সরকার বাংলাদেশে টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়। ভারত নিজের চাহিদা পূরণে একের পর এক বিভিন্ন দেশের টিকার অনুমোদন ও সংগ্রহের প্রয়াস অব্যাহত রাখলেও বাংলাদেশে ভারতীয় এজেন্টরা শুরুতে সব রাস্তা বন্ধ করে ভারতের সাথে চুক্তি করে বিপর্যয় সৃষ্টি রাস্তা তৈরী করেছিল।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পিছিয়ে রাখার মাধ্যমে ভারত কি বশংবদ করে রাখতে চায়? সচেতন জনগণের মধ্যে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অথচ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই আঞ্চলিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে সুসংহত করা সম্ভব। শক্তিশালী প্রতিবেশী হিসেবে চীন এবং রাশিয়া যদি নিজেদের সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে কৌশলগত বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে পারে, সে ক্ষেত্রে ভারত কেন চীনের সাথে, পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে পারে না? ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সমস্যা অনেক পুরনো হলেও বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদী অপকৌশল পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করে তুলেছে। বাধ্য হয়েই ভারতের নিকটতম প্রতিবেশীরাও চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মূলত ভারতের শাসকদের হীনমন্ম্যতা ও অপরিনামদর্শী আচরণ তার প্রতিবেশীদের চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতকিছুর পরও বাংলাদেশ এখনো ভারতের সাথে একটি অসম বন্ধুত্বের ঊর্ণাজাল বাঁচিয়ে রেখে চলেছে। পারমানবিক শক্তিধর প্রতিবেশী ভারতকে বাংলাদেশ কখনো প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রোপকুল ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তায় চীন যখন বাংলাদেশকে সাবমেরিন উপহার দেয়, তখন ভারতের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ্যণীয়। রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে চীনের অনুঘটক ভূমিকা সত্তে¡ও বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বের স্বাভাবিক সর্ম্পকের খাতিরে নিরপেক্ষতার বদলে ভারত সব সময়ই মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। এমনকি চীন বাংলাদেশকে সাবমেরিন দেয়ার পর পর ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন দেয়ার ঘোষণা দেয়। এর মানে হচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ঔদ্ধ্যত্বকে আরো বাড়িয়ে তুলতে ভারত নেপথ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে মিয়ানমার কখনো চীনের প্রভাবমুক্ত হয়ে ভারতের সাথে স্বাধীনভাবে সম্পর্ক গড়তে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এই মুহূর্তে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের এক নম্বর অংশীদার হচ্ছে বাংলাদেশ। দুই দেশের ভারসাম্যহীন বাণিজ্যের আশি ভাগই ভারতের অনুকূলে। বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার যথেষ্ট ক্ষেত্র থাকলেও ভারতীয় শাসকদের কাছে তা যেন গুরুত্বহীন। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় তার বাজার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকাও বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার। এসব দেশের সাথে বাণিজ্য বাংলাদেশের অনুকূলে। অ্যাপারেল, মেডিসিনসহ যেসব পন্য বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকায় রফতানি করছে, একই ধরণের পণ্য ভারত বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করলেও বাংলাদেশ থেকে আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় তাদের অনাগ্রহ ক্রমেই লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এমনকি বাংলাদেশ থেকে ভারতের ট্রাডিশনাল আমদানি পণ্য পাটের উপর অযৌক্তিক এন্টি-ডাম্পিং ব্যারিয়ার সৃষ্টি করেছে।
করোনা মহামারীর কারণে বেশকিছু পোশাক কারখানা বন্ধ থাকা এবং ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার কারণে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সর্বশেষ জরিপে পোশাক রফতানি খাতে ভিয়েতনামের কাছে বাংলাদেশ তার দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়েছে। অথচ চীনের রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে পোশাক রফতানিতে ৫ম অবস্থান থেকে ভারতও ৬ষ্ঠ অবস্থানে নেমে গেছে। করোনা অতিমারি ভারত এবং বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতসহ রফতানি বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। চলতি অর্থবছরে রফতানি আদেশ বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় ক্রমাবনতিশীল করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও গার্মেন্টস কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাঁচিয়ে রাখতে ক্রমাবনতিশীল সংক্রমণের মধ্যেও কলকারখানা খোলা রাখা হলেও গত দেড় বছরে একদিনের জন্যও দেশের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। গত বছরের দ্বিতীর্য়াধে সংক্রমণ কমে গিয়ে যখন ১০ ভাগের নিচে নেমে এসেছিল তখন গণপরিবহনসহ সব অফিস-আদালত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এখন রাজধানীসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য সিট খালি পাওয়া যাচ্ছে না। সিরিয়াস রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে অক্সিজেন, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা যাচ্ছে। মাসের পর মাস বিধিনিষেধ ও লকডাউনে দরিদ্র, দিনমজুর ও সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবন ধারণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। যতই দিন যাচ্ছে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মধ্যেও মানুষকে ঘরে বন্দি রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। রুটি-রুজির পথ রুদ্ধ হওয়া, সন্তানের লেখাপড়া ও ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় লকডাউন যেন করোনার চেয়েও বেশি আতঙ্কজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউনের সময় দেশের কিছু সংখ্যক কওমি মাদরাসা চালু থাকলেও সেখানে করোনা সংক্রমণের কোনো কেস হিস্টোরি নেই। উল্লেখ্য, দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে হাজার হাজার অনাথ-এতিম ও ছিন্নমূল শিশু-কিশোরের থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। মাদরাসা বন্ধ থাকলে তাদের যাওয়ার কোনো জায়গাও থাকে না। মূলত কোরবানির পশুর চামড়া বেচা টাকা এবং স্বচ্ছল, দানশীল মানুষের দানে এসব মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং চলে। এ বছরও চামড়ার মূল্য নিয়ে কারসাজির কারণে এসব মাদরাসা ও এতিমখানাগুলো আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে লকডাউনে গার্মেন্টস কারখানা খোলা থাকলেও সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকা মাদরাসার শিক্ষক-মোহতামিমরা পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই করোনার অতিমারীর মধ্যেও একশ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ, ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আয় বেড়েছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষের আয় কমলেও কিছু মানুষের আয় বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। স্থিতিশীর, ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়ভিত্তিক একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য এই বাস্তবতা অশনি সংকেত।
বিপদে বন্ধুর পরিচয়, এই পুরনো বাগবন্ধটি ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। করোনাকালের বিপর্যয় মোকাবেলায় চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটা, নমুনা কিট সংগ্রহ, ভ্যাকসিন সংগ্রহ, ভ্যাকসিন নিবন্ধন, দরিদ্র মানুষের ত্রাণ সহায়তার মত কর্মকাÐে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, আমলাতন্ত্র ও কিছু সুবিধাভোগী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকাÐের উপর মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। একই সাথে আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক কুশীলবদের তৎপরতাও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে টিকা রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানির দেয়া যৎসামান্য টিকায় দেশের করোনা টিকা কার্যক্রম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। চীন এবং রাশিয়া বাংলাদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে, এমন খবর গত প্রায় ৬ মাস ধরেই চলছে। গতানুগতিক গদাইলষ্করি আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করোনা পেন্ডেমিক মোকাবেলা করার এই প্রয়াস দেশকে কোথায় নিয়ে যায় তা ভেবে উৎকণ্ঠিত হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। একের পর এক ওয়েব ও ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর মিছিল মোকাবেলা করতে করতে ভ্যাকসিনেশনের উপর ভর করে সারাবিশ্ব যখন পুনরায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশে নতুন করে কঠোর বিধিনিষেধ ও লকডাউনের মধ্যেও সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেড়ে চলার মধ্যেও কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। তবে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ্যভাবে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলা হচ্ছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার পরই স্কুল-কলেজ খোলা হবে। তবে গত কয়েকমাস ধরে প্রবাসী ও গার্মেন্ট কর্মীদের টিকা দেয়ার উপর জোর দেয়া হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার ব্যাপারে কোনো বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে অসংখ্য ভারতীয় নাগরিকের কর্মসংস্থান হওয়ায় এ খাত থেকে আয়ের একটি বড় অংশ ভারতে চলে যাচ্ছে। অথচ দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার চাকরির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অনেকে জীবনের বাজি রেখে উত্তাল ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মরছে। এ সপ্তাহে তিউনিসিয়া উপকুলে নৌকায় কয়েকশ’ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। দেশে চাকরি না থাকায় যুব সমাজের একটি অংশের এমন ঝুঁকিপূর্ণ প্রবাস জীবন বেঁছে নেয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা ও অকার্যকারিতাই ধরা পড়ে। এখন এই করোনা লকডাউনে শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। মার্চ মাসে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে বিরতিহীনভাবে স্কুল-কলেজ বন্ধ রয়েছে। প্রায় চার কোটি স্কুল-মাদরাসার প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কামিল পর্যন্ত প্রায় চারকোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ও মনস্তত্ত¡ সম্পর্কে অবহেলা-উদাসীনতা দেখিয়ে কিসের উন্নয়নের চিন্তা করছি আমরা?
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মানে অনেক পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিশ্বের তো নয়ই, এশিয়ার ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায় না। দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই তার কাক্সিক্ষত মান ধরে রাখতে পারেনি। সীমিত পরিসরে সীমিত সম্পদ নিয়ে গড়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনোটা অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে থাকায় এটাই প্রমানিত হয়, অযোগ্য দলবাজ ভিসি ও প্রশাসনের কারণে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মান-মর্যাদা হারিয়েছে। এই করোনা পেন্ডেমিকে শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়ার দিকে এগুচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনায় কোটি কোটি মানুষ কর্ম হারিয়েছেন। এক সময়ের স্বচ্ছল পরিবারগুলো এখন জীবনধারণের সংকটে ভুগছে। এমতাবস্থায় শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে অনলাইন ক্লাসের উপর ভরসা রাখতে চাইলেও সরকারি গাইডলাইন ছাড়া যথেচ্ছভাবে নামকাওয়াস্তে অনলাইন ক্লাস চালু রেখে মূলত শিক্ষাবাণিজ্য অব্যাহত রাখার সুযোগ নিচ্ছে তথাকথিত নামিদামি স্কুল-কলেজগুলো। করোনায় শিল্পখাতের বিভিন্ন সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হলেও শিক্ষা সেক্টরে প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী পর্যন্ত সরকারি অর্থ সহায়তার বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত থাকা উচিত। আনরেজিস্টার্ড বিদ্যালয় এবং মাদরাসাগুলোর সাথে জড়িত লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মূল্য গার্মেন্ট শ্রমিকদের চেয়ে মোটেও কম নয়। গত একযুগ ধরে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, সাম্প্রতিক কয়েকটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বিশ্বের সর্বনি¤œ সারিতে অবস্থান করছে। ইন্টারনেটের গতি পর্যবেক্ষণে নির্ভরযোগ্য আন্তজার্তিক সংস্থা ওকলার সর্বশেষ রির্পোটে জানা গেছে, মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৫তম। এশিয়ায় আফগানিস্তান এবং ল্যাটিন আমেরিকায় ভেনিজুয়েলার আগে রয়েছে বাংলাদেশ। নেপাল, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। আফ্রিকার দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়া, সুদান, উগান্ডা বা নাইজেরিয়া বা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ সিরিয়া বা লিবিয়ার মত দেশগুলোর চেয়েও ডিজিটাল বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এই করোনাকালে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্বের কারণে সব মানুষ এখন বাধ্য হয়েই ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে। নিত্যদিনের কেনাকাটা, শিক্ষা-চিকিৎসা, ব্যাংকিং ও সরকারি অফিস-আদালত, পরিষেবা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেটে কার্যক্রম চালিয়ে রাখছে বলেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখনো সচল আছে। সেখানে যে দেশের মানুষ যত বেশি সহজে দ্রæত গতির ইন্টারনেট অ্যাক্সেস পাবে, করোনা পেন্ডেমিকে সে দেশ তত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকা মানে বাংলাদেশের মানুষ ডিজিটালাইজেশনের সুযোগ সুবিধা ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। করোনা ভ্যাক্সিনের জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রান হয়ে পড়ছে। অনবরত সার্ভারে সমস্যার নোটিশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে ডিজিটালাইজেশনের এনালগ বাস্তবতার মধ্যেও দেশে-বিদেশে বদনাম ও বিতর্কের ঝড় তুলেছে বাংলাদেশের নির্বতনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। করোনা ভ্যাকসিনের দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বলে সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানা গেছে। করোনাকালের বিশ্বের পরিবর্তিত সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষা, ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি এবং করোনা ভ্যাকসিনশনে পিছিয়ে থাকা জাতির তথাকথিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশের মানুষের কোনো কাজে আসছে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।