Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

রূপগঞ্জে ৭ মাসে অর্ধশত অগ্নিকান্ডের ঘটনা

মো. খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম


অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, ফায়ার এক্সটিগুইসার, এক্সিট পয়েন্টের ঘাটতি রয়েছে বেশিরভাগ কারখানায়।
ফায়ার সার্ভিস পরিদর্শকদের সঠিক পর্যবেক্ষণ না থাকার অভিযোগ।
অগ্নি ঝুঁকিতে আরো ৩৫ টির অধিক শিল্প-কারখানা : ফায়ার সার্ভিস।


নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় চলতি বছরে গত ৭ মাসে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসকল অগ্নিকান্ডের ঘটনার বেশিরভাগই শিল্প কারখানায়। শিল্প কারখানাগুলোতে মালিকপক্ষের অসাবধানতা, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার ঘাটতি, পর্যাপ্ত এক্সিংগুইসার না থাকা, পর্যাপ্ত এক্সিট পয়েন্ট না থাকা অগ্নিকান্ডের মূল কারণ হিসেবে জানা গেছে। তবে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে রূপগঞ্জের আরো ৩৫টির অধিক শিল্প কারখানা অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস পরিদর্শকরা শিল্প কারখানা গুলোতে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে রূপগঞ্জ উপজেলার অবস্থান। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় ও রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প গড়ে উঠায় এ উপজেলাকে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হিসেবে ধরা হয়। এ উপজেলায় ছোট বড় মিলে পোশাক কারখানা, ভোজ্যপন্য, বেভারেজ, ষ্টীল মিলসহ প্রায় ৯৯৬ টি শিল্প-কারখানা গড়ে রয়েছে। শিল্প কারখানাগুলো বেশিরভাগই ভুলতা, গোলাকান্দাইল ও তারাব ও বরপা ও রূপসী এলাকায় অবস্থিত। এসকল শিল্প কারখানা গুলোর মাঝে সিংহভাগে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থা, পর্যাপ্ত এক্সিংগুইসার, পর্যাপ্ত এক্সিট পয়েন্ট নেই বলে সংশ্লিষ্ট কারখানা সূত্রে জানা গেছে। রূপগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শকরা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করে শিল্প কারখানা গুলোতে পর্যবেক্ষণ করেন না। বেশিরভাগ শিল্প কারখানাই ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা গুলো মানে না। এসকল কারণেই অগ্নিকান্ডের এতো বেশি ঘটনা ঘটছে। এসব কারখানার বেশিরভাগই বাইরে থেকে মেইন গেট ও কলাপসিবল গেটের পাশাপাশি ভেতরের প্রতিটি ফ্লোরের সিঁড়ি নেট দেয়া গেট, রেলিং গেট ও লোহার গেট দিয়ে পরিবেষ্টিত রয়েছে বলে শ্রমিকরা জানায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি কারখানায় কারখানার শতকরা ১৮ জনকর্মীকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে ৬ মাসের কোর্স করাতে হবে। ওই ১৮জন কর্মীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে একজন সেফটি অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। ওই অফিসারের অন্য কোন কাজ করবে না সে শুধু কারখানার ফায়ার সেফটির বিষয়টি দেখবেন। ফায়ার সেফটির অফিসার যোগ্যতা হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কোন অফিসার অথবা ৬ মাসের প্রশিক্ষণপাপ্ত অভিজ্ঞ কোন ব্যাক্তি। রূপগঞ্জের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানাই এসকল নির্দেশনা মানেন না।

ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের অধীনের রূপগঞ্জ উপজেলায় আরিফ ও শাহ-আলম নামে পরিদর্শক হিসেবে কাজ করেন। তারা দুজন শিল্প-কারখানা গুলোতে অগ্নি নির্বাপণ ও অগ্নিকান্ডবিষয়ক ক্রটি বিচ্যুতি তদন্ত করে ফায়ার লাইসেন্স প্রদান করেন। তারা শিল্প কারখানাগুলোতে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করেই লাইসেন্স প্রদান করেন বলে অভিযোগ করছে শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা, গোলাকান্দাইল, কাঞ্চন, সাওঘাট, কালাদীসহ আশপাশের এলাকার চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারী থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত ৩৩ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অপরদিকে, রূপগঞ্জ উপজেলা তারাব ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৩৬ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া পূর্বাচল উপশহরের আশপাশেও কয়েকটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তবে অনেক স্থানে ডেমরা, কাঞ্চন ও পূর্বাচল উপশহরের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কয়েকটি ইউনিট একসাথে সম্মিলিতভাবে আগুন নির্বাপণের জন্য যায়। এ সেক্ষেত্রে রূপগঞ্জ উপজেলায় গত ৭ মাসে অগ্নিকান্ডের ঘটনা অর্ধশতাধিকেরও বেশি। নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, রূপগঞ্জে এখনো আরো ৩৫ টির অধিক ঝুকিপূর্ণ কারখানা রয়েছে। কারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দ্রæত সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে হাসেম ফুডের মতো আরো ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঝুকিপূর্ণ শিল্প কারখানায় রয়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ও বড় প্রতিষ্ঠান।
সর্বশেষ গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের হাসেম ফুড কারখানার ৬ তলা ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মোট ৫২ জন শ্রমিক নিহত। এতে আহত হয় প্রায় অর্ধশতাধিক। আহত ও নিহতদের মাঝে বেশিরভাগই ছিল শিশু। গত ২১ জুন একই ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। এতে প্রায় ১০ জন শ্রমিক আহত হয়। এছাড়া চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে সিম গ্রুপে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া এনজেড টেক্সটাইল, গোলাকান্দাইল এলাকার প্রাণ আরএফএফ গ্রুপসহ প্রায় অর্ধশত কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। বেশিরভাগ অগ্নিকান্ড হয়ে থাকে মালিকপক্ষের অসাবধনতার কারণে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, কারখানার ভেতরে বিড়ি সিগারেটসহ নানা কারণে।

হাসেম ফুডে কর্মরত শ্রমিকরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, হাসেম ফুডে অগ্নিকান্ডে ৫২ জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে মালিকপক্ষের অবহেলার কারণে। অগ্নিকান্ডের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ছাড়াও কারখানার অন্যান্য ভবনগুলোতে অব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত এক্সিট পয়েন্ট, আগুন নেভাতে পর্যাপ্ত পানির মজুদ, পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এছাড়া কারখানার ওই ভবন নির্মাণের সময় কোন বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, ওয়ারটার রিজার্ভার, পর্যাপ্ত এক্সিট পয়েন্ট, অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক জিল্লুর রহমান (অপারেশন) ও জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। হাসেম ফুডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, শিল্প কারখানা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এঘটনায় হাসেম ফুডের চেয়ারম্যানসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঝুকিপূর্ণ কারখানার বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক (রূপগঞ্জ) তানহারুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জের অন্তত ৩৫টির অধিক শিল্প-কারখানা অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে। শুকনা খাবার তৈরীর পাশাপাশি স্টীল মিল ও পোশাক কারখানা এবং টেক্সটাইল মিল কারখানাও রয়েছে ঝুকিপূর্ণ কারখানার তালিকায়। এছাড়া অনেক কারখানাতেই নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে নেই ইমারজেন্সী এক্সিট ডোরও। কোথাও একটি আবার কোথায় একাধিক সিঁড়ি রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে ফায়ার সার্ভিস কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, যেসকল কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা কম ও ইমারজেন্সী এক্সিট ডোর নেই, আমরা আমরা তাদের নোটিস করে থাকি। নোটিস না মানলে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শকদের অবহেলার ব্যাপারে তানহারুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শকদের পর্যবেক্ষণে অবহেলার বিষয়টি সঠিক নয়। পরিদর্শকরা সঠিকভাবে কারখানা পর্যবেক্ষণ করেন। ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টররা কারখানা পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনার ক্রটি পেলে কারখানা কর্তৃপক্ষকে নোটিস করে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। হাসেম ফুড কারখানায় ফায়ার সার্ভিসের ক্রুটী পাওয়ায় তাদেরকেও নোটিস করা হয়েছিল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অগ্নিকান্ড


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ