পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ করোনা এবং টিকা নিয়ে লেখার অভিপ্রায় করেছি। সেটি লিখতে গিয়ে শুরুতেই একজন বিখ্যাত ভারতীয় পলিটিশিয়ানের কথা মনে পড়ল। তার নাম গোপালকৃষ্ণ গোখলে। তিনি কংগ্রেসের একজন বড় নেতা ছিলেন। ছোটবেলায় সেই পাকিস্তান আমলে স্কুলের পাঠ্য বইয়ে আমাদেরকে গোখলের একটি উক্তি পড়ানো হয়েছিল। পাকিস্তান আমলের পাঠ্যবইয়ে মি. গোখলেকে ‘মহামতি গোখলে’ বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। গোখলে বলেছেন, What the Bengalees think today the whole of India thinks it tomorrow. অর্থাৎ, আজ বাঙালিরা যা চিন্তা করে সারা ভারতবর্ষ আগামীকাল তা চিন্তা করে। কংগ্রেসে মি. গোখলের সমসাময়িক রাজনীতিবিদ ছিলেন সরোজিনী নাইডু, দাদাভাই নৌরজী, অ্যানি বেসান্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখ। এসব বাঘা বাঘা কংগ্রেসির সামনে তিনি এমন একটি উক্তি করেছেন।
যেহেতু বগুড়া জেলায় স্কুলের পাঠ্য বইয়ে (এটা সরকারি স্কুল) এটি পড়ানো হয়েছিল তাই সেই উক্তিটি রীতিমতো মগজের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। বলতে পারেন, ব্রেইন একদম ডধংযবফ হয়ে গিয়েছিল। তারপরে যতই বড় হতে থাকলাম, আশেপাশের আনুষঙ্গিক বই পড়তে থাকলাম ততই দ্বিতীয় চিন্তা শুরু হলো। মনে হতে লাগলো, গোখলে বাবুর উক্তিটি খাঁটি সত্য নয়। বাঙালিদের খুশি করার জন্য তিনি ওই কথাটি বলেছিলেন। তাই যদি না হবে তাহলে কংগ্রেসের নেতৃত্ব বাঙালি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে থাকল না কেন? বিজেপির নেতৃত্বও অবাঙালিদের হাতে কেন? স্বাধীন ভারতের ৭৪ বছরে কত প্রধানমন্ত্রীই এলেন আর গেলেন। কিন্তু এই ৭৪ বছরে একজন বাঙালিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না কেন? মাত্র একজন অর্থাৎ শঙ্কর নারায়ণ ছাড়া আর কোনো বাঙালি ভারতের প্রধান সেনাপতি হতে পারলেন না কেন? নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাই শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায়, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম দুই বাংলাকে এক রেখে স্বাধীন বাংলা নামক সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে পারলেন না কেন? মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে মুসলিম লীগের হাইকমান্ড তো বলেছিল যে, অখন্ড বাংলা যদি ভারতের অধীনে না গিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম থাকতে পারে তাহলে মুসলিম লীগের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু কংগ্রেসের অবাঙালি নেতৃত্ব, অর্থাৎ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের ধমক খেয়ে বঙ্গীয় কংগ্রেসের নেতারা খামোশ হয়ে গেলেন। তারা যদি এত দূরদর্শীই হয়ে থাকেন, তাহলে কংগ্রেসে অবাঙালি নেতৃত্বের কাছে বাঙালি নেতৃত্ব মার খেয়ে গেল কেন?
দুই
এখন আসছি করোনা এবং টিকার কথায়। দেখি, এপারের বাঙালিদের দূরদর্শিতা কতদূর। অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজার বা মডার্না- যে টিকার কথাই বলেন না কেন, সবই দুই ডোজ টিকা। প্রথম ডোজ দিয়ে দেড় মাস বা দুই মাসের বিরতির পর দ্বিতীয় ডোজ নিলে টিকা নেওয়া পূর্ণতা পায়। সকলেই এটা জানেন। টাকা দিয়ে কেনা এবং উপহার মিলে বাংলাদেশ ভারতের সেরামের নিকট থেকে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা পায়। এই টিকা দিয়ে সর্বোচ্চ ৫১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া যায়। এর বেশি নয়। কিন্তু ৫৮ লাখের বেশি মানুষকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার (কোভিশিল্ড) প্রথম ডোজ দেয়া হয়। সকলেই তো জানেন যে প্রথম ডোজ হিসাবে ৫৮ লাখ দেওয়ার পর আরও ৫৮ লাখ হাতে মজুদ থাকা উচিত উচিত ছিল। দ্বিতীয় ডোজ ৪৩ লাখ দেওয়ার পর টিকা ঝযড়ৎঃভধষষ ১৫ লাখ। সেই ঘাটতি চলছে আজ তিন মাস ধরে। আর ওই ১৫ লাখ ব্যক্তি একটি ডোজ নিয়ে আধা খাঁচড়া হয়ে বসে আছেন। কোথায় গেল দূরদর্শিতা? দূরদর্শী হলে ৫৮ লাখ প্রথম ডোজ না দিয়ে ৫১ লাখ ৫১ হাজার ডোজ দিয়েই কর্তৃপক্ষের থেমে যাওয়া উচিত ছিল।
এটাতো গেল সেই ১৫ লাখ মানুষের দুঃখের কাহিনী যারা এক ডোজ টিকা নিয়ে ঝুলে আছেন। ওরা ছাড়া অবশিষ্ট ১৬ কোটি মানুষের কী হবে? (এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এক ডোজ হোক আর দুই ডোজ হোক, সব মিলিয়ে এক কোটি লোককে টিকা দেওয়া হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে দাবি করা হয়েছে।) এখানেই এসে পড়ে সব চেয়ে বড় প্রশ্নটি। আমার কাছে তো বটেই, পাঠক আপনাদের অনেককেই মানুষ নিশ্চয়ই প্রশ্ন করে: এই সর্বনাশা করোনা কবে যাবে? ৮/৯ মাস আগেও এই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। কারণ জবাবটি আমাদের কারো জানা ছিল না। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমরা অনেকেই অনেক টোটকা ঔষধ খেয়েছি। গরম পানির ভাপ নিয়েছি। যে যা বলেছে, আমরা তাই করেছি। না করে কোনো উপায় ছিল না।
কিন্তু আমি একবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকের মানুষকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলবো যে বিশ^ব্যাপী করোনা ভাইরাস যে প্রলয় ঘটাচ্ছে তার বিরুদ্ধে মাত্র ৯ মাস সময়ের মধ্যে প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিগত কয়েক শতাব্দিতে এত দ্রæত কোনো মহামারী বিরোধী টিকা বা ঔষধ এত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আবিষ্কার হয় নাই। এই করোনা সহজে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আশার আলো জ্বালিয়েছে এই টিকা।
বাংলাদেশে আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকা নিয়েছি এবং কিছুটা অভিজ্ঞাতাও হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, টিকা নিলেও যে করোনা হয় না, এমন নয়। এক ডোজ কেন, দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরেও করোনা হয়েছে এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। আমার আপন ভাই বোন এবং ছেলে মেয়েদের মধ্যে ২১ জনের করোনা হয়েছিল। যাদের মধ্যে ১৬ জন ডাবল ডোজ টিকা নিয়েছিল। এই ১৬ জনই এখন আল্লাহর মেহেরবানীতে সুস্থ হয়েছেন। কাউকেই হাসপাতালে যেতে হয়নি। কোনো বড় সমস্যাও হয়নি। এখান থেকে একটি উপসংহারে আসা যেতে পারে যে, টিকা নিলেও করোনা হয়। কিন্তু গুরতর কোনো সমস্যা হয় না।
মাঝখানে সাড়ে তিন থেকে চার মাস জনগণ টিকা নিতে পারেনি। এই সাড়ে তিন থেকে চার মাসে আরও প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া যেত। বাংলাদেশে টিকা যখন প্রথম আসে তখন জনগণের মনে টিকার সাইড এফেক্ট নিয়ে অনেক ভয়, শঙ্কা বা দোদুল্যমানতা ছিল। ৭ দিনের মধ্যেই সেই জড়তা কেটে যায়। এপর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ১ কোটি ১৮ লাখ মানুষ। এখন মানুষ টিকা নেওয়ার জন্য লাইন ধরছেন।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সোশ্যাল ট্রান্সমিশন হয়েছে। এখন গ্রামেগঞ্জেও করোনা ছড়িয়েছে। আগে বলা হতো, মফস্বলে বা গ্রামে করোনাই নাই। কিন্তু গত দেড় মাসে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন গ্রামের রোগী ঢাকায় আসছে। চুয়াডাঙ্গার একাধিক সিরিয়াস রোগী ঢাকায় এসেছে। বগুড়ায় শহরের উপকণ্ঠে কয়েকজনের কথা জানি। তাদের বাড়ি করোনার দ্বীপে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তার বাড়ির ডান ধারের বাড়িতে করোনা, সামনের বাড়িতে করোনা, পেছনের বাড়িতে করোনা। এখন ডেল্টা ভাইরাসের সোশ্যাল ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। গ্রামে তথা মফস্বলের লোকেরা টিকা নিতে চায়। তারা শিক্ষিত মানুষদের কাছে যাচ্ছে নিবন্ধন করিয়ে নিতে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।
সরকার নাকি ৩০টি কোল্ড ফ্রিজার আমদানি করেছে। এসব ফ্রিজারে নাকি হিমাঙ্কের নিচে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় (মাইনাস ৫০ তাপমাত্রা) টিকা সংরক্ষণ করা যায়। তাই যদি হয় তাহলে ফাইজারের টিকা কেনার চেষ্টা করা হোক। ফাইজারের টিকাকে সর্বোত্তম টিকা হিসাবে গণ্য করা হয়। তারপর অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং মডার্না। বেলজিয়ামের জনসন এন্ড জনসন কোম্পানির জ্যানসেন সিঙ্গেল ডোজ টিকা মার্কেট হিট করতে পারেনি। মানুষ মডার্না বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চায়। না পেলে রুশ স্পুটনিক-ভি। স্পুটনিকের কথা শুধু মন্ত্রীর মুখেই শুনেছি। কবে তার প্রথম চালান আসবে? ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নাকি স্পুটনিক-ভির বাংলাদেশে সোল ডিস্ট্রিবিউটর নিযুক্ত হয়েছে। তিনি ৬ মাসের মধ্যে নাকি দুই কোটি ডোজ ডেলিভারি দিতে পারবেন। মূল্য প্রতি ডোজ ৮ মার্কিন ডলার। কেন তার প্রস্তাব ঝুলে আছে? সোজা কথা, টিকা চাই। এবং সত্বর যথেষ্ট পরিমাণে টিকা চাই। ওপরে আল্লাহর রহমত এবং নিচে টিকা- এটিই মুক্তির পথ। এই পথে করোনা সম্পূর্ণ না গেলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।