Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্ধেক মানুষকে টিকা না দেওয়া পর্যন্ত বিধিনিষেধের কষ্ট মেনে নিতে হবে

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:১১ এএম

আগামীকাল ২১ জুলাই, বুধবার। পবিত্র ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল এই ঈদ। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগেও যে আনন্দ আছে সেটির জ্বলন্ত স্বাক্ষর এই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। কিন্তু তারপরেও বলি, ঈদের স্বাভাবিক আনন্দ কি এই ঈদে আছে? শুধু এই ঈদে বলি কেন, ২ মাস ১০ দিন আগে যে ঈদুল ফিতর গেল, সেই ঈদেও কি স্বাভাবিক আনন্দ ছিল? তারও আগে গত বছর। গত বছরেও দুইটি ঈদ গেছে। এবারের দুটি ঈদ। মোট চারটি ঈদ। চারটি ঈদ গেল। কিন্তু জামাতে নামাজ পড়া হলো না। ঈদ মানেই তো কোলাকুলি। আপনার বাসায় আপনার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আসবেন। আপনি তাদের বাড়িতে যাবেন। কিন্তু করোনার মধ্যে কে কার বাড়িতে আসবেন? গরুর হাট আগের মতো আর জমে না। অনলাইনে গরু কেনা। গরু কিনে রাখবেন কোথায়? কোরবানি দেবেন কোথায়? আপনার অ্যাপার্টমেন্টের কম্পাউন্ডে গরু রাখা যাবে না, কোরবানিও দেয়া যাবে না। গরুর হাটে করোনার ভয়, ফ্ল্যাট সিস্টেমের অ্যাপার্টমেন্টে করোনার ভয়। ঈদের জামাতে করোনার ভয়। ভয় কোথায় নাই?

গত বছর পবিত্র হজে যাওয়ার জন্য আমার মেয়ে এবং জামাতা এজেন্সির কাছে টাকা জমা দিয়েছে। সৌদির বাইরের কোনো দেশকে হজে যেতে দেওয়া হয়নি। তাই ওরা হজে যেতে পারেনি। কিন্তু এজেন্সিকে দেওয়া জমা টাকা ওরা ফেরৎ নেয়নি। ওদের ইচ্ছে ছিল এবছর যাবে। এ বছরও সৌদি আরব বাইরের কাউকে অ্যালাও করেনি। তাই এবারও ওদের যাওয়া হয়নি।

করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের কী প্রাণান্ত চেষ্টা! কিন্তু তারপরেও কি শেষ রক্ষা হচ্ছে? করোনা টিকার দুইটি ডোজ নিয়েও তো করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বড় ভাই ডাক্তার। বগুড়ায় বাস এবং বগুড়াতেই প্র্যাকটিস। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাই ও ভাবী অ্যাস্ট্রাজেনেকার (কোভিশিল্ড) প্রথম ডোজ নেন। এপ্রিলের ১০ তারিখে, অর্থাৎ ২ মাস পর তারা দ্বিতীয় ডোজ নেন। তারপর ২ মাস ১০ দিন গত হয়েছে। তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্ডিবডি বা ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মানোর কথা। কিন্তু কোথায়? গত ১ তারিখ তারা দুজনই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আমার জামাই করোনার টিকা নিয়েছিল। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তার করোনা হয়। তার স্ত্রী, অর্থাৎ আমার মেয়ে টিকার ডাবল ডোজ নিয়েছে প্রায় ২ মাস আগে। গত ৭ তারিখ থেকে তার পজিটিভ। আমার ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান মান্নাও টিকা নেওয়ার পর সংক্রমিত হয়েছিল।

আর কত বলবো? আমাদের পরিবারে এ পর্যন্ত ১৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১২ জনেরই টিকা নেওয়া আছে। একটি বিষয় দেখেছি। সেটি হলো, টিকা নিলেও করোনা হয়। তবে টিকা নেওয়া থাকলে সংক্রমণের তীব্রতা কম হয়, হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন বা ঝুঁকি কমে যায়।

দুই
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে। এই ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ মার্চ। আজ ২০ জুলাই, মঙ্গলবার। এক বছর চার মাস পার হতে চলেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এর আগে আরো একটি ঢেউ আমরা পার হয়ে এসেছি। এই দ্বিতীয় ঢেউ কি শেষ ঢেউ? মনে হয় না। কারণ, বলা হচ্ছে ডধাব ধভঃবৎ ধিাব আসবে। ঢেউয়ের প্রবাহ অত সহজে থামবে না। তাই বলে কি এটা অনন্তকাল ধরে চলবে? আর আমরাও অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন বা বিধিনিষেধ জারী করতেই থাকবো? এই দুটো প্রশ্নেরই সুস্পষ্ট উত্তর হলো: ‘না’। তাহলে কি আমাদের করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে? এটার উত্তরও হলো: ‘না’।

সেটা কি সম্ভব? সম্ভব। পৃথিবীটা এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজ। আমার আপনার সকলের অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ঘনিষ্ঠজন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির বদৌলতে তাদের সাথে কথা বলাও এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। এখন আমাদের অনেকেই প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দৈনিক বেশ কিছুটা সময় নিয়ে কথা বলি। এই সুবাদে সংবাদপত্র ও রেডিও টেলিশিভন ছাড়াও আমরা ঐসব দেশের অনেক খবর জানতে পারি।

আর সেই সুবাদেই আমরা জানি, আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশেই এখন লকডাউন বা বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। এখন ওদের অনেকেই মাস্ক পরে না এবং তাদের সরকারও মাস্ককে ম্যান্ডেটরি করছে না। ওরা সুপারশপে যায়, ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে শপিং করে। ওরা যখন ফুড কোর্টে যায় তখন সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখে। সেদিন ইংল্যান্ডে ইউরোপীয় ফুটবল কাপের ফাইনাল হয়ে গেল। ফাইনাল ম্যাচ হওয়ার আগে ইউরোপের ১১টি দেশে খেলা হয়ে গেল। প্রতিটি ম্যাচে স্টেডিয়াম ছিল দর্শকে ঠাসা। অনেকের ফেস মাস্ক ছিল না। ম্যানচেস্টার ও শেফিল্ডে কথা বলে জানতে পারলাম যে, সেখানে বিগত এক সপ্তাহে তারা করোনায় কোনো মৃত্যুর সংবাদ পায়নি।

এগুলো সবই সম্ভব হয়েছে ব্যাপক এবং গণহারে টিকা দানের কারণে। শেফিল্ড এবং ম্যানচেস্টারে যাদের সাথে আমি কথা বলেছি, তারা বললো যে, তাদের পরিচিত সার্কেলের মধ্যে এমন একজনও নাই যে টিকা নেয়নি। আসলে এই টিকাই হলো করোনার ভয়াল থাবার বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষা কবচ। ১১ জুলাই পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে চীন, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ করোনার প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ। সমগ্র বিশ্বের ১২ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ১১ জুলাই পর্যন্ত টিকা নিয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশে যতদিন পর্যন্ত অন্তত ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধেক মানুষ টিকা না নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত লকডাউন বলুন, বিধিনিষেধ বলুন বা সাধারণ ছুটি বলুন, সেটি রাখতেই হবে।

তিন
কিন্তু সেই লকডাউন বা বিধিনিষেধ বা সাধারণ ছুটি, যাই বলুন, সেটি নিয়ে চোর পুলিশ খেলা হচ্ছে। অথচ এই জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা পিকে উঠেছে। জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছে দেড় লাখ এবং মৃত্যু হয়েছে ২৭৭৫ জনের। এর আগে বিগত ১৫ মাসে গত এপ্রিল মাসকেই সবচেয়ে ভয়াবহ ধরা হয়েছিল। কারণ, তখন শনাক্ত ছিল ১ দশমিক ৪ লাখ এবং মৃত্যু ছিল ২ হাজার ৪০৪ জন।

এমন একটি পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ বা লকডাউন শিথিলের পরিবর্তে লকডাউন বলতে গেলে তুলে নেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরামর্শক কমিটির অধিকাংশ সদস্য বলেছেন যে, ১০ দিনের জন্য লকডাউন প্রত্যাহারে তাদের সায় ছিল না। বিধিনিষেধের শিথিলতা তাদের পরামর্শের ঠিক উল্টা চিত্র। তারা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেখানে বার বার ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন, সেখানে সংক্রমণের পিক টাইমে এধরনের ঘোষণা আমাদেরকে আরো খারাপ অবস্থায় ফেলবে। গণপরিবহন, শপিংমল, কোরবানির হাট- এগুলো সংক্রমণ বাড়িয়ে দেবে। ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকে এর কুফল দেখা দেবে।

তারা বলেন, দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার দেড় বছর পর যেদিন সর্বোচ্চ সংক্রমণ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলো, ঠিক তার পরদিনই বিধিনিষেধ শিথিল করার নামে ‘কঠোর লকডাউন’ বলতে গেলে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হলো।

জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. ইকবাল আরসালান বলেন, এই প্রজ্ঞাপনে আমরা বিস্মিত, হতভম্ব। লকডাউন খুলে দেওয়া হলো ১০ দিনের জন্য। এটিকে সরকারের ‘ছলনা’ বলে তিনি আখ্যায়িত করেন। তিনি নিশ্চিত করে বলেন যে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। পরামর্শক কমিটির সভাপতি ড. শহীদুল্লাহ বলেন, করোনা মোকাবেলায় আমাদের কাজ হলো, যেটা ভালো সেটা বলা। আমরা তাই করি। এখন একসঙ্গে হুড় হুড় করে অনেক মানুষ বের হচ্ছে। আর এই সুযোগে ভাইরাস তার কাজ করে যাচ্ছে। শুধু পরামর্শক কমিটির সদস্য নন, খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিনিয়র অফিসার অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সল বলেছেন, ‘এখন আমরা সবাই সংক্রমিত হয়ে যাবো। কিছু মানুষ বেঁচে যাবে, আর যারা সারভাইভ করতে পারবে না, তারা বেঁচে থাকবে না।’
বিগত আড়াই মাস টিকা দেওয়া বন্ধ ছিল। আড়াই মাস পর টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এরমধ্যে মডার্নার ২৫ লাখ এবং সিনোফার্মের ২০ লাখ টিকা এসে পৌঁছেছে। আরও নাকি পাইপলাইনে আছে। এখন সরকারের প্রধান কাজ হলো, সারাদেশে সর্বাত্মক টিকাদান অভিযান। অন্তত ৬ কোটি বাংলাদেশিকে টিকা দিতে পারলে এই মহামারী হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। ততদিন যতই অপ্রিয় হোক, যতই অসুবিধা হোক, বিধিনিষেধসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে।
Email: [email protected]



 

Show all comments
  • Babul Rohan Uddin ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১৫ এএম says : 0
    আপনাকে অতন্ত্য ধন্যবাদ। কারণ এত সুন্দর মতো বুঝিয়ে বলার জন্য। এবং আপনার বাংলা ভাষা গুলো এত মধুর ভাষায় বলা যাবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Anm Shafiul Azim ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১৬ এএম says : 0
    ব্লাড থিনার যারা নেয় তারা কি টিকা দেয়ার সময়ে টিকার স্থানে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা রয়েছে নাকি টিকা নেয়ার পরে ইন্টারনেল ব্লিডিং এর সম্ভাবনা রয়েছে ? এক্ষেত্রে ঝুঁকিপুর্ণ সময় কত ?
    Total Reply(0) Reply
  • MD Sahid ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১৬ এএম says : 0
    খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অালোচনা করেছেন অাপনি,মানুষের সেবায় নিয়মিত পরামর্শ এবং দেশের মানুষের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ জানাই অাপনাকে,অাল্লাহ অাপনার নেক হায়াত দান করতা দোয়া রইলো,
    Total Reply(0) Reply
  • Ali Akbar Jicu ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশের দূরত্ব বজায় রাখা বলে বর্তমানে কিছু নাই তাই টিকায় হবে একমাত্র ভরসা
    Total Reply(0) Reply
  • Dwijen Mausumi ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১৮ এএম says : 0
    করোনা আক্রান্ত হবার কত দিন পর প্রথম অথবা দ্বিতীয় ডোজের vaccine নেওয়া যাবে ?
    Total Reply(0) Reply
  • Engr M Sahabuddin Rashed ২০ জুলাই, ২০২১, ১:২১ এএম says : 0
    সহজ বিষয়টি আমলাদের কেন বুঝে আসেনা বুঝি না।
    Total Reply(0) Reply
  • Tapas TapasTapas Tapas ২০ জুলাই, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
    দয়া করে 18+ দের টিকা দিন অতি দ্রুত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দিন ।
    Total Reply(0) Reply
  • শেখ রাসেল ২০ জুলাই, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
    সহমত পোষণ করছি, স্যার, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু,
    Total Reply(0) Reply
  • রুকাইয়া খাতুন ২০ জুলাই, ২০২১, ১:২৪ এএম says : 0
    দ্রুত গণটিকা কার্যক্রম ফুল গতিতে শুরু করা হোক। টিকা না নেয়া পর্যন্ত বিধিনিষেধ কঠোর ভাবে দেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন