Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোরবানির ইতিহাস ও শিক্ষা

মুফতি মাওলানা আহসান জামিল | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

বলুন আমার সালাহ, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার বেচে থাকা, আমার মরে যাওয়া সব বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আলোচ্য আয়াতে কারিমা এটাই প্রমান করে আমরা যারা আত্মসমর্পণ কারি আল্লাহর গোলাম, আল্লাহর বান্দা, আমাদের বেচে থাকা, মরে যাওয়া এক কথায় সব কিছু হতে হবে আমাদের রব আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তা না হলে সব কিছু বিফলে যাবে। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন : আল্লাহর নিকট তাদের কোরবানির পশুর গোশত এবং রক্ত পৌছায়না বরং পৌছায় তোমাদের তাক্বওয়া। তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। এজন্য যে তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্ম পরায়ণদেরকে। আর অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ আপনার রবের জন্য নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।
উপরোক্ত আয়াতে কারিমাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে আমরা আত্মসমর্পণ কারি বান্দা হিসেবে যা করি সব কিছুই তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই করতে হবে। এর পেছনে যদি কাউকে দেখাবার বা কারো সন্তুষ্টি অর্জন করার থাকে তাহলে আমাদের আমলগুলি সব বিফলে যাবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন আমাদের সন্তান, সন্ততি এসবের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে পরীক্ষা করেছেন! আমরাা এসব নিয়ামত পেয়ে কি করি? দুনিয়া মুখি হয়ে তাঁকে ভুলে যায়! নাকি জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়! আর এই পরীক্ষা থেকে নবী আলাইহি ওয়াসাল্লামও বাকি নন। মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লামকেও তিনি বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। কিন্তু তিনি সব সময় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কারণ তিনি সব কিছু থেকে আল্লাহকেই বেশি ভাল বাসতেন। আমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম গোটা জীবন আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করতে, করতে বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। ১২০ বৎসরে উপনীত হয়েছেন, আর স্ত্রী ৯৯ বৎসর।
এমতাবস্থায় তিনি ভাবলেন তার ইন্তিকালের পর আল্লার দ্বীনের তাবলীগ কে করবে? তার যদি একটি সন্তান থাকতো, সন্তানকে তাবলীগের কাজে লাগাতে পারতেন। তাই তিনি সন্তানের জন্য আকুতি জানিয়ে বলছেন, হে আমার পরওয়ার দেগার আমাকে একটি সালেহ আল্লাহভীরু সন্তান দান করুন। হযরত ইব্রাহিমের ইমান ছিল তার রব যখন খুশি তখন দান করতে পারেন। কিভাবে হবে এটা তার ইচ্ছা, তিনি যেভাবে চান, আর সে প্রবল ইচ্ছা নিয়ে হাত তোলতে দেরি আল্লাহর সুসংবাদ দিতে দেরি হয় নাই। আল্লাহ বলেনঃ যাও আমি তোমাকে একটি সহনশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। আর সে সুসংবাদের ভিত্তিতেই একজন সন্তান হল যার নাম রেখেছেন ইসমাইল। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সন্তান পেয়ে খুবই খুশি। এখানেও মহান আল্লাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম থেকে ছোট একটি পরীক্ষা নিলেন। দেখলেন তার মনকি ইসমাইলের দিকে ঝুকে গেছে! নাকি তার মহান রবের দিকেই আছে! ইব্রাহিমকে আদেশ করা হল সন্তানকে মরু প্রন্তরে রেখে আসার জন্য, আল্লাহর নির্দেশে জন মানবহীন কাবার নির্জন প্রন্তরেই তার কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল ও তার বিবি হাজেরাকে রেখে গেলেন। আল্লাহর হুকুম পালন করতে ছুটে যাবার সময় হাজেরা বারবার পিছন দিক দিয়ে ডাকার পরেও কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল ও প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরার দিকে এক বারের জন্যও তাকালেননা। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর রেখে যাওয়া পানি ও শুকনো খাবার যখন ফুড়িয়ে গেল মা হাজেরা সন্তানের খাবারের ব্যপারে একমাত্র আল্লাহর সাহায্য প্রার্থি হয়ে সাফা মারওয়ায় দৌড়া দৌড়ি করলেন। আল্লাহর সাহায্য এসে গেল।
আর ইসমাইলের বরকতেই জম জমের ঝর্ণাদ্বারা প্রবাহিত হল, যার বরকত আজও পযর্ন্ত পৃথিবীবাসি ভোগ করছে। এতে বুঝা যায় কেও যদি একেবারে আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থী হন, মহান আল্লাহ তাকে এমনভাবে দেন সমস্ত পৃথিবীর মানুষ নিয়েও তা শেষ করতে পারেনা। শিশু ইসমাইল দিরে দিরে কিছুদূর বড় হওয়ার পর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে মহান আল্লাহ এবার তার একমাত্র কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল দ্বারা আবারও পরীক্ষার সন্মূখীন করেছেন। যখন ইসমাইল তার পিতার সাথে দৌড়া দৌড়ি করার বয়সে উপনীত হল তখন ইব্রাহিম স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে বললো হে বৎস আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি। অতএব বল তোমার মতামত কি? ছেলে বললো হে আমার সম্মানিত পিতা আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের মধ্যে পাবেন। এত আদরের সন্তানকে কেউ কোরবানি তথা নিজ হাতে জবাই করার জন্য কেবলমাত্র স্বপ্নে দেখে প্রস্তুতি নিতে পারেনা। কিন্তু নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে এক প্রকারের ওহি স্বরুপ। আর তাই তিনি বুঝতে পারলেন এটা আল্লাহর আদেশ।

আল্লাহর আদেশের সামনে সন্তানের মহব্বত ও তার মনকে আগে কোরবানি করে চললেন, মিনা প্রান্তেরের দিকে, আল্লাহর হুকুমকে বাস্তবায়ন করার জন্য। সঙ্গে নিলেন ছুরি ও একটি রশি। তিনি সামনে দৌড়ে চাচ্ছিলেন আল্লার হুকুমকে বাস্তবায়ন করার জন্য আর ইসমাইল পিতার পিছনে পিছনে এই সুযোগে মানব জাতীর চরম শুত্রু ইবলিস এসে ইসমাইলকে বললো ওহে নির্বোধ বালক! তোমার পিতা তোমাকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে যদি প্রাণ বাচাতে চাও এখনি পিছু ত্যাগ কর। শিশু ইসমাইল তখন বললেন আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি হতে পারাতো সৌভাগ্যের বিষয় মহান আল্লাহ তার কোটি কোটি বান্দাহ হতে আমাকে তার রাস্তায় কোরবানি হওয়ার জন্য কবুল করেছেন, এটাতো চরম সৌভাগ্যের ব্যপার। তৌ এপথে তুমি আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? তুমি অবশ্যই মানব জাতির শুত্রু হবে। এভাবে ইসমাইল তিনবারই শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দেন এবং পিতার সান্নিধ্যে চলে আসেন। পিতা এবং পুত্র উভয়ে আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য মিনা প্রান্তরে উপনীত হলেন। ইব্রাহিম সন্তানকে কোরবানি করার জন্য আর ইসমাইল আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য। একে অপরকে সহযোগিতা করছেন।

পিতা হাত পা বেধে কাত করে শুয়ালেন, এমন সময় মহান আল্লাহ বললেন যখন পিতা পুত্র উভয়ে আমার আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে কাত করে শুয়াল তখন আমি তাকে ডেকে বল্লাম হে ইব্রাহিম তুমি তোমার প্রতি স্বপ্নাদেশ সত্যি সত্যি পালন করেছো এইভাবে আমি পূণ্যবানদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক বড় কোরবানির জন্তুর বিনিময়ে। বিষয়টি আমি পরবর্তীদের জন্য স্বরণে রেখেছি। ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এইভাবে আমি পূণ্যবানদের পুরষ্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। কোরবানির কতিপয় উপকারিতাও রয়েছে ইবনে মাজাহ শরীফের হাদীসে এসেছে হযরত যায়েদ বিন আরকাম রাযি.বলেনঃ রাসুলুল্লাহর সাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ এই কোরবানির হাকীকত কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর সূন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ এতে আমাদের কী ফায়দা আছে? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এর প্রতিটি পশমে একটি করে নেকি রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন ভেড়া ও দুম্বার পশমের বেলায় কী? রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এটারও প্রতিটি পশমে একটি করে নেকী রয়েছে। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোরবানির কঠিন তাগিদ এসেছে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। ( মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ)

যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজঃ কোরবানির জন্য মোটা, তাজা ও সুন্দর পশু অথ্যাৎ যা দেখতে সুন্দর ও শুশ্রী হয়। হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সুন্দর, মোটা, তাজা, হৃষ্ট, পুষ্ট পশু দ্বারা সব সময় কোরবানি করেছেন।

আর আবু সাইদ খুদরী রাযি. হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব তাজা দুম্বা দ্বারা কোরবানি করতেন। ছয় প্রকার পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। উট,গরু,মহিষ,দুম্বা, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি। এর বাহিরে অন্য কোন হালাল পশু দ্বারা কোরবানি করলে তা জায়েজ হবেনা। আর যেসব পশু কোরবানি জায়েজ নয়। হযরত বারা ইবনে আযেব রাযি. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হলো যে কোরবানির ব্যপারে কোন ধরনের জন্তু হতে বেচে থাকতে হব? রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতের দ্বারা ( অথ্যাৎ চার আঙুল দেখিয়ে বললেন, চার রকমের পশু হতে। ১. খোড়া - যার খোড়ামি স্পষ্ট। ২. কানা যার অন্ধত্ব স্পষ্ট। ৩. রোগা - যার রোগ স্পষ্ট। ৪. দুর্বল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোরবান

৯ জুলাই, ২০২২
৯ জুলাই, ২০২২
৮ জুলাই, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ