Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হে প্রভু, আমাদের শ্বাস দাও

ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব | প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

শ্বাস-প্রশ্বাসের মূল্য যে কত বেশি, সেটা কেবল সেই-ই বুঝে যে মহামারি করোনায় চূড়ান্ত শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হয়েছে। করোনা মূলতঃ ফুসফুসে হানা দেয়। আর তাই প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। বুকের মধ্যে রক্ষিত ফুসফুস বা ফুল্কা এই অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাজ করে এবং সারাজীবন আমাদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে। প্রতি মিনিটে গড়ে ১২-১৮ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকলে জীবনে কত লক্ষ-কোটি বার এই সিলিন্ডার আমাদের অক্সিজেন দিয়েছে, তা একবার ভেবেছি কি? বর্তমান বাজারে ১২ লিটারের একটি সাধারণ অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, যা দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা চলে। পরে তাতে আবার অক্সিজেন ভরতে হয়। একবার ভাবুন, কত কোটি টাকার অক্সিজেন আমরা বিনা পয়সায় বিনা চেষ্টায় সর্বদা পাচ্ছি। বাতাসে নাইট্রোজেনের পরিমাণ শতকরা ৭৮ ভাগ, যা ভূমির উর্বরা শক্তি বাড়ায় এবং গাছের বৃদ্ধি ঘটায়। আর অক্সিজেনের পরিমাণ ২১ ভাগ, যা উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতকে বাঁচিয়ে রাখে। অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি হ’লে দাবানল সৃষ্টি হয়। কার হুকুমে ও কার ব্যবস্থাপনায় ঐ সরবরাহের পরিমাণ ঠিক থাকছে? গাছ হ’ল জীবন্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার, যা দিনের বেলায় প্রাণীজগতের জন্য অক্সিজেন ছাড়ে। এজন্য সুন্দরবনকে বলা হয়, ‘দেশের ফুসফুস’। কারণ, সেখানকার জঙ্গলে উৎপাদিত অক্সিজেন দেশের প্রাণীজগতকে রক্ষা করে। তাই বৃক্ষ রোপণকে গুরুত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, তুমি বেঁচে থাকতে যদি ক্বিয়ামত এসে যায়, আর তখন যদি তোমার হাতে একটি চারা গাছ থাকে, তাহ’লে সেটি রোপণ করো’ (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪৭৯)। তিনি বৃক্ষ রোপণকে ‘ছাদাক্বা’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন (বু. মু. মিশকাত হা/১৯০০)। তিনি মক্কা ও মদীনার ‘হারাম’ এলাকায় বৃক্ষকর্তন নিষিদ্ধ করেন (বু. মু. মিশকাত হা/২৭১৫, ২৭৩২)। তাছাড়া বৃক্ষের প্রতিটি পত্র-পল্লব আল্লাহ্র তাসবীহ পাঠ করে। অতএব, সাধ্যমত বৃক্ষ রোপণ করা আবশ্যক। বিশেষ করে নিম গাছ, যা সর্বাধিক ঔষধিগুণ সম্পন্ন। এছাড়া তাল গাছ, যা বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। ফলে একটি গাছ কাটার আগে তিনটি গাছ লাগান। বাড়ির চারদিকে সবুজের বেষ্টনী গড়ে তুলুন। সর্বদা চক্ষু শীতল রাখুন!

দেশের খ্যাতিমান আর্কিটেক্ট জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩-২০২০) গত বছর রমজানের রাত্রিতে খেয়ে-দেয়ে সুস্থহালে ঘুমিয়ে গেলেন। সাহারীর সময় আর ঘুম ভাঙলো না। দেখা গেল নিঃশ্বাস চলছে না। অর্থাৎ অক্সিজেনদাতা অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে এই মূল্যবান মানুষটির প্রাণহীন দেহ এখন মাটির খোরাক। শ্বাস বন্ধ হওয়াতেই সব বন্ধ। বন্ধু মহলে হায় হায় রব উঠল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তিনি এখন নতুন জীবনের মুসাফির। জানি না সেখানে তিনি কেমন আছেন।

ফুসফুস হ’ল শ্বাসযন্ত্র। এর প্রধান কাজ হ’ল বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্ত প্রবাহে নেওয়া এবং রক্ত প্রবাহ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডের অপ্রয়োজনীয় অংশ বাতাসে নিষ্কাশন করা। এই গ্যাস আদান-প্রদান করা হয় বিশেষ কোষ দ্বারা তৈরি খুবই পাতলা দেওয়াল বিশিষ্ট লক্ষাধিক বায়ুথলির দ্বারা। এছাড়া অক্সিজেন সরবরাহের প্রধান মাধ্যম রক্তের লোহিত কণিকা, যার আয়ু ১২০ দিন বা চার মাস। অন্যদিকে শ্বেতকণিকা, যা নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি থেকে মানুষকে রক্ষা করে, তার আয়ু বড় জোর ৩-১৫ দিন। এই সাথে রক্তের প্লেটলেট, যা সূতার আঁশের ন্যায় অতি ক্ষুদ্র কোষ। তা দেহের ক্ষতস্থানের রক্ত জমাট বাঁধানোর কাজে নিয়োজিত থাকে। যদি এটা না থাকতো, তাহ’লে যেকোন ক্ষতে দেহের সব রক্ত বেরিয়ে গিয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করত। অথচ, এর আয়ু বড় জোর ৫-৭ দিন। এগুলি সবই মরছে আবার পুনর্জন্ম হচ্ছে। এভাবে ফুসফুস ও হৃৎপিন্ড তথা লাংগ্স ও হার্ট প্রাণীদেহের এই জটিলতম যন্ত্র দু’টির মধ্যে সর্বদা হায়াত-মউত ও পুনর্জন্মের খেলা চলছে। তাই ক্বিয়ামত তথা আখেরাতে জওয়াবদিহির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই সম্ভবতঃ আল্লাহ বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস পাঠিয়েছেন, যা প্রধানত ফুসফুসে আক্রমণ করে। আল্লাহ বলেন, ‘আর সে আমাদের সম্পর্কে নানাবিধ উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টির বিষয়ে ভুলে যায়। সে বলে, কে হাড্ডিগুলিকে জীবিত করবে যখন তা পচে-গলে যাবে?’ ‘বলে দাও, ওগুলিকে তিনিই জীবিত করবেন, যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন...’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৮-৭৯)।

করোনায় কারো ফুসফুসের অল্প ও কারো বেশি আক্রান্ত হয় আল্লাহ্র হুকুমে। যারা বেঁচে যায় তাদেরকে ‘করোনা বিজয়ী’ বলে মূর্খরা অভিনন্দন জানায়। এমনকি এরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় সবাইকে দু’আঙ্গুল উঁচু করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখায়। অথচ, আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করে না। আর যারা মরে যায়, তাদের আপনজনেরা লাশ নিতে চায় না নিজেরা সংক্রমিত হয়ে মরার ভয়ে। অথচ অন্যেরা তাদের গোসল-কাফন-দাফন করে। সে জানে না যে, করোনা ছোঁয়াচে হ’লেও তা আল্লাহ্র হুকুম ব্যতীত কার্যকর হয় না। আর মৃত্যুর পরে তা আর ছোঁয়াচে থাকে না। এভাবে দুনিয়াতেই আমরা ক্বিয়ামতের দৃশ্য সর্বদা অবলোকন করছি। এরপরেও কি মানুষ দুনিয়ার আরাম-আয়েশের পিছনে ছুটবে? সে কি তার পরকালীন জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ে ব্রতী হবে না?

গ্রীকদের অদ্বৈতবাদ, যা মৃত্যুর পর স্রষ্টার মধ্যে বিলীন হওয়ার কথা বলে। হিন্দুদের জন্মান্তরবাদ, যা মৃত্যুর পর কর্মভেদে পশু-পক্ষী, গাছ-পাথর ইত্যাদি রূপে পুনর্জন্মের কথা বলে। বৌদ্ধদের নির্বাণবাদ, যা পরকালে মানুষকে কোনরূপ কর্মফল পাওয়া থেকে নিরাশ করে। এইসব কাল্পনিক দর্শনের বিরুদ্ধে ইসলামের সত্য দর্শন মানুষকে মৃত্যুর পরে ভাল-মন্দ ফলাফল লাভের নিশ্চয়তা দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহ্র নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মফল পুরোপুরি প্রাপ্ত হবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)। আর এটাই ছিল কুরআনের সর্বশেষ আয়াত, যা রাসূল (ছা.)-এর মৃত্যুর ৭ বা ২১ দিন পূর্বে নাযিল হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতঃপর যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর হয় সত্যবিমুখ এবং তারা হয় অহংকারী’ (নাহ্ল ৬/২২)। তিনি স্বীয় নবীকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে’ (যুমার ৩৯/৩০)। একদিন জিব্রীল এসে তাঁকে বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! যতদিন খুশী জীবনযাপন করুন। কিন্তু মনে রাখুন আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। যার সাথে খুশী বন্ধুত্ব করুন। কিন্তু মনে রাখুন আপনি তাকে ছেড়ে যাবেন। যা খুশি কাজ করুন। কিন্তু মনে রাখুন আপনি তার ফলাফল পাবেন...’ (হাকেম ৪/৩৬০, হা/৭৯২১; ছহীহাহ হা/৮৩১)। একদিন জনৈক ব্যক্তি এসে রাসূল (ছা.)-কে জিজ্ঞেস করল, কে সবচাইতে বিচক্ষণ? তিনি বললেন, ‘মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণকারী এবং পরকালীন জীবনের জন্য সর্বাধিক সুন্দর প্রস্তুতি গ্রহণকারী’ (ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯)।
অতএব, হে বিচক্ষণ! তোমার প্রতিটি পদক্ষেপকে পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ে ব্যয় কর। হে মানুষ! তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের মূল্যায়ন কর। শ্বাস-প্রশ্বাসের মালিককে ভয় কর। অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলেও তুমি তার বিনিময় পাবে। আর অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলেও তুমি তার শাস্তি পাবে, যদি সাথে সাথে তওবা না কর। একবার তাকাও তোমার শ্বাসকষ্টে কাতর নিকটজনের মলিন চেহারার দিকে। দেখ একটু নিঃশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য তার চরম আকুলি-বিকুলি। দুনিয়ার সবকিছু দিয়েও কি তুমি তাকে একটা নিঃশ্বাস এনে দিতে পারবে? অতএব, সাবধান হও! তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাস তার মালিকের পথে ব্যয় কর।

লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক শিক্ষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



 

Show all comments
  • Dadhack ১৫ জুলাই, ২০২১, ১২:৩৫ পিএম says : 0
    মানুষ যখন আল্লাহর আইন মানে না তখন সেই মানুষ. পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে নিকৃষ্ট নিকৃষ্ট নিকৃষ্ট জন্তুর থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যায় ,আর এর ফল হচ্ছে সারা পৃথিবীতে নানা ধরনের অসুখ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে থাকে সারা পৃথিবী জুড়ে বছরের পর বছর... এর একমাত্র উপায় হচ্ছে আল্লাহর কাছে তওবা করে কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন-যাপন করা তাহলে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের উপর থেকে এই গজব উঠিয়ে নিবেন ইনশাআল্লাহ..........................
    Total Reply(0) Reply
  • Saifullah 387836 ১৫ জুলাই, ২০২১, ১:৩৭ পিএম says : 0
    অসাধারণ লেখনি,মাশাল্লাহ, জাজাকাল্লাহ খাইরান
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন