Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাজেটে মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্ররা উপেক্ষিত কেন?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০২১, ১২:০৪ এএম

শত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আত্মসম্মানবোধ টনটনে থাকে। তারা মুখ বুজে সব সহ্য করে। অভাবে পড়লে কারো কাছে বলেও না, হাতও পাতে না। বলা যায়, নীরবে-নিঃশব্দে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। কাছের মানুষজন জানলেও আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগতে পারে, এ শঙ্কায় পাশে এসে দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করে। ফলে মধ্যবিত্তের দুঃখ-কষ্ট কেবল তাদের নিজেদেরই হয়ে থাকে। করোনাকালে জনগোষ্ঠীর যে শ্রেণিটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এই মধ্যবিত্ত। ‘নিউ পুওর’ বা ‘নতুন গরিব’ বলে যে কথাটি বলা হচ্ছে, হিসাব করলে দেখা যাবে এর বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তে পরিণত হওয়ার পথে থাকা মানুষ। করোনার আগে এ মানুষগুলো গরিব ছিল না। তারা স্বচ্ছল অবস্থায়ই জীবনযাপন করত। করোনার ধাক্কায় তারা গরিব হয়ে গেছে। করোনাকালে জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ ‘নতুন গরিব’ হয়েছে তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগও তার হিসাব করেনি। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, দেড় থেকে দুই কোটি নতুন গরিব হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসাবে, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ গরিব অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরে হিসাব করলে দশ কোটির বেশি মানুষ গরিব। এ এক ভয়াবহ চিত্র। যে সময়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি, ঠিক সে সময়ে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের গরিব হয়ে যাওয়া যে বড় ধরনের ধাক্কা, তাতে সন্দেহ নেই। এ ধাক্কা যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়াকে কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দুই.
একটি দেশের অর্থনীতি, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, শিল্প-সংস্কৃতি বিনির্মাণের মূল কারিগর মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাদের মাধ্যমেই সুষম ও সুশৃঙ্খল সমাজের ভিত্তি রচিত হয়। নীতি-নৈতিকতা, আত্মসম্মানবোধের জায়গাটি তৈরি হয়। উন্নত বিশ্ব থেকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সমাজ ব্যবস্থা মধ্যবিত্তদের দ্বারাই তৈরি হয়েছে এবং তা ধরে রেখেছে। বলা হয়, সুসভ্য জাতি গঠনের মেরুদন্ড মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্তের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। সাধারণ হিসাবে, শ্রমজীবী মানুষ ও উচ্চবিত্তের মাঝে যেসব মানুষের বসবাস তাদের মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত রয়েছে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা হয় সেসব মানুষকে যাদের কলেজ ডিগ্রী রয়েছে, কিছু সম্পদ আছে, পেশাদার চাকরিজীবী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সঞ্চিত অর্থ রয়েছে, বাড়ি-গাড়ি করার ইচ্ছা রয়েছে এবং বিনোদনের জন্য বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যে রয়েছে যাদের বাড়ি-গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে। অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি কিছু করার সামর্থ্য রয়েছে, তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে রয়েছে, যাদের নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। এর বাইরে বিলাসী কিছুু করার সামর্থ্য কম। তাদের আয়ে টান ধরলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বেশিরভাগই নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবিত্তের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫২ ভাগ। তবে এ সংখ্যাটি দিন দিন কমছে। আমাদের দেশে কত সংখ্যক মধ্যবিত্ত রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই এবং তা করা হয়না, প্রকাশ হতেও দেখা যায় না। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে কাজ করতে দেখা যায় না। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংখ্যা মাঝে-মধ্যে পাওয়া যায়। এ সংখ্যাটি মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ। এ হিসেবে, দেশের প্রায় দশ কোটির বেশি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রয়েছে। অন্যদিকে সরকারিভাবে কোটিপতির সংখ্যা প্রকাশ হতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, দেশে এক কোটি টাকার উপর ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় আশি লাখ। আবার উচ্চবিত্ত, যাদের শত থেকে হাজার কোটি টাকা রয়েছে, তাদের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি বলে শোনা যায়। উচ্চবিত্ত বা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এমন লোকজনের কাছেই নাকি দেশের সিংহভাগ সম্পদ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দরিদ্রসীমার নিচে এবং দরিদ্র শ্রেণি ও উচ্চবিত্তের মাঝে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অবস্থান। এদের সংখ্যাটিই বেশি। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন এই শ্রেণির মানুষই সম্মিলিতভাবে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিসহ শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান রেখে চলেছে। রাজনীতিতে এক সময় এই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসারাই নেতৃত্ব দিতেন। এখন অপরাজনীতির কারণে দুর্বৃত্তায়ণের মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণি থেকে উঠে আসা ও উচ্চবিত্ত বিশেষ করে শিল্পপতিরা রাজনীতিতে বেশি প্রাধান্য বিস্তার করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমাদের জাতীয় সংসদের শতকরা ৭৫ ভাগই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। রাজনীতিতে এ শ্রেণির কদর বেশি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে এতে এখন মধ্যবিত্তদের স্থান নেই বললেই চলে এবং তাদের সেই আগ্রহও কমে গেছে। মধ্যবিত্তরা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে মনোযোগী হয়ে জীবনযাপন করছে। অর্থনীতির ভাষায়, একটি দেশের সুষম উন্নয়ন হতে হয় পিরামিড আকৃতিতে। পিরামিড যেমন নিচ থেকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে উপরের দিকে সরু হয়ে উঠে গেছে তেমন। অর্থাৎ অতি দরিদ্র ও দরিদ্র শ্রেণিকে তা থেকে বের করে অর্থনৈতিক ভিত্তি দিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পর্যন্ত অর্থনীতি অগ্রসর হবে। আমাদের দেশে অর্থনীতির এ নিয়মের কোনো বালাই নেই। এখানে গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে। সরকার দরিদ্র শ্রেণিকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় এনে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে কেবল খাদ্য সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। অতি দরিদ্র ও দরিদ্রের সংখ্যা কমানোর জন্য কর্মসংস্থানের জন্য যে উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন, তা নিচ্ছে না। বলা হয়ে থাকে, প্রতিদিন একজনকে মাছ দিয়ে সহায়তা করার চেয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়, তা শিখিয়ে দিলে তাকে আর সহায়তা করার প্রয়োজন নেই। সে নিজেই মাছ ধরে খেতে পারবে। তদ্রুপ অতি দরিদ্র ও দরিদ্রকে ত্রাণ বা সহায়তা না দিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়ের ব্যবস্থা করে দিলে এ শ্রেণিটি থাকবে না। এর ফলে পিরামিডের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে আয় বৈষম্য কমে আসবে।

তিন.
বিগত দেড় বছর ধরে চলমান করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। যে গতিতে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছিল, সে গতি শ্লথ হয়ে গেছে। এর মধ্যেও উচ্চবিত্তের আয় কমেনি বরং বেড়েছে বলে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। অন্যদিকে দারিদ্র্যের সীমারেখাটি এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতে অসংখ্য চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছে, যাদের চাকরি আছে তাদের অনেকের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিবার নিয়ে বসবাসরত অনেকে সংসার খরচ চালাতে না পেরে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভাসমান ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এমনকি বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটের অনেক ব্যবসায়ী দোকান ভাড়া ও স্টাফ খরচ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে দোকান ছেড়ে দিয়েছে। ফলে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির বিভিন্ন খাত দুর্বল হয়ে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। প্রতি মুহূর্তে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দামের এই ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। তারপরও দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২২২৭ ডলার হয়েছে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, নিউ পুওর বা নতুন দরিদ্র হওয়াসহ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি দরিদ্র হয়ে যাওয়ার মধ্যে মাথাপিছু আয় কিভাবে বাড়ল, তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। তবে এই বৃদ্ধির পেছনে যে উচ্চবিত্তের আয় বৃদ্ধি জড়িয়ে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। করোনা তাদের আয়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কারণ, গত বছরের লকডাউনে পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও যখন লকডাউন উঠে যায়, তখন যে ক্ষতি হয়েছে তা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে। তারা আগের চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। ফলে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ধনী শ্রেণির আয় গড় হিসাব হয়ে একজন বেকারের উপর গিয়ে পড়েছে। আয় বৈষম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা এ থেকেই বোঝা যায়। সরকার গত বছর করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পঞ্চাশ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ প্রণোদনা দেয়। দেখা গেছে, এই প্রণোদনা পেয়েছে ৩৬ লাখ পরিবার। বাকিরা পায়নি। অভিযোগ রয়েছে, যারা পেয়েছে, তাদের বেশিরভাগই সরকারি দলের লোকজন কর্তৃক নির্ধারণ করে দেয়া। এর বাইরে খুব কম পরিবারই এই প্রণোদনা পেয়েছে। ফলে দরিদ্র সহায়তায় সরকারের এ উদ্যোগ ভাল হলেও তা পুরোপুরি সফল হয়নি। সরকার অতি দরিদ্র ও দরিদ্র জনসংখ্যার ক্ষতি পোষাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও জাতির মেরুদন্ড হয়ে থাকা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। করোনার কারণে সম্পন্ন মধ্যবিত্তরা ক্ষতির শিকার হয়ে নীরবে যে ক্ষয়ে যাচ্ছে, তা সরকার উপলব্ধি করছে না। তবে করোনার ধাক্কায় দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন এবং নতুন দরিদ্র হয়েছে, তা এখন একবাক্যে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন। তাদের আশা ছিল, এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তদের প্রণোদনা ও সহায়তামূলক দিকনির্দেশনা থাকবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বাজেটে এ নিয়ে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বিপুল সংখ্যক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত যদি দরিদ্র হয়ে যায়, তবে অর্থনীতির মেরুদন্ডই ভেঙ্গে যাবে। বিপুল দরিদ্র শ্রেণির বোঝা টানতে গিয়ে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে পড়বে। সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাজেটে মধ্যবিত্তদের নিয়ে কিছু না থাকার বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, অর্থমন্ত্রী তার বড় বাসে যাত্রী তুলতে ভুলে গেছেন। পিছিয়ে পড়া বা নতুন দরিদ্র হওয়া মানুষ তার যাত্রী হতে পারেননি। তার এ মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, দেশের মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্ররা এবারের বাজেটে উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী স্বীকার করে বলেছেন, মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্র হওয়াদের সংখ্যা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। প্রশ্ন হচ্ছে, ধনী-দরিদ্রের যদি পরিসংখ্যান থাকতে পারে, তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের পরিসংখ্যান থাকবে না কেন? এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো গবেষণা নেই কেন? দেশে কত সংখ্যক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রয়েছে, তা জানার অধিকার মানুষের রয়েছে। এই যে মধ্যবিত্ত চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে, তাদের ব্যাপারে কি সরকারের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ধনী ও দরিদ্রদের নিয়ে চিন্তা করলে হবে? সরকার ইতোমধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও নানা সুযোগ-সুবিধা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত এক দশকে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে ২২১ শতাংশ। অথচ করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় গত বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় কাতার ও ভিয়েতনাম। পরবর্তীতে অন্য অনেক দেশ সরকারি ব্যয়ের খাত সংকুচিত করার পথে হাঁটে। অথচ আমাদের দেশে সংকটের মধ্যে যেখানে প্রতিনিয়ত নতুন দরিদ্র হচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে, বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কমছে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা বেড়েই চলেছে। তাদের সুরক্ষায় সরকার সবকিছু করছে। সাবেক এক সচিব বলেছেন, আগে সরকারি চাকরিতে পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য প্রতিযোগিতা চলত। এখন এ প্রতিযোগিতা করতে হয় না। এমনিতেই বছর শেষে বেতন-ভাতা নির্ধারিত নিয়মে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার যদি মনে করে, আমলারা সরকার টিকিয়ে রাখার মূল নিয়ামক শক্তি এবং ধনীরা দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি, তাহলে এ চিন্তা পুরোপুরি অমূলক। শরীর ছাড়া শুধু মাথা দিয়ে কাজ করা যায় না। মাথা যদি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে তবে তা যেমন কখনো পূর্ণাঙ্গ হয় না, তেমনি দেশের শরীর হয়ে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।

চার.
এবারের বাজেটের সবচেয়ে আলোচিত দিক হচ্ছে, মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্রদের নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকা। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বেশ সরব। তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। অন্যদিকে, বাজেটকে অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি ব্যবসা বান্ধব বললেও এর সুফল সাধারণ মানুষ পাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ, ব্যবসায়ীরা যত সুবিধা পায় তার খুব সামান্যই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে। বেশির ভাগ সুবিধাই তারা নিজেদের জন্য কুক্ষিগত করে রাখে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাজেটে ব্যাপক সুবিধা রাখার বিষয়টি প্রশংসা পেলেও নতুন দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য কোনো কিছু না থাকার বিষয়টি সমালোচিত হচ্ছে। আমাদের কথা হচ্ছে, বাজেটে শুধু উঁচু ও নিচু শ্রেণির কথা ভাবলে হবে না, বিপুল সংখ্যক নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। এই শ্রেণি যদি ধসে যায়, তবে উন্নয়ন-অগ্রগতি, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার চরম ঘাটতি দেখা দেবে। পরিবার ও সমাজ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটবে। এর প্রভাব রাষ্ট্রের উপর পড়বে। এ উপলব্ধি থেকেই সরকারকে বাজেটে মধ্যবিত্ত ও নতুন দরিদ্রদের রক্ষায় সহায়তামূলক কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এখনো যেহেতু সময় আছে, তাই বাজেটে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
[email protected]



 

Show all comments
  • Dadhack ১১ জুন, ২০২১, ৬:৩০ পিএম says : 0
    আল্লাহর আইন থাকলে মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ,চিকিৎসা, শিক্ষা, জীবনের সুরক্ষা মানুষ হিসাবে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকা সবি হত, যেহেতু আল্লাহর আইন নাই সেহেতু তারা নিজের ইচ্ছামত আমাদের টাকাগুলো ব্যবহার করবে আর আমরা সবসময় কষ্ট করেই মরবো.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন