পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। এটি দেশের ৫০তম বাজেট। এবারের বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ।’ নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০২০-২১) এর আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের আকার বৃদ্ধি নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। এর সাথে জিডিপির সম্ভাব্য লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়। এবারের মোট বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে, ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতি নিয়ে এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘাটতি মেটানো হবে ব্যাংক থেকে ঋণ, বিদেশি ঋণ, দেশের ব্যাংকের বাইরে থেকে ঋণ ও বিদেশি অনুদানের মাধ্যমে। জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। বাজেট নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিরোধীদলগুলোও প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বরাবরের মতোই বাজেটের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আলোচিত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাজেট পুরোটাই ব্যবসাবান্ধব। সিপিডি বলেছে, বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছ রূপরেখা নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একে ‘গণবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করেছে। অর্থনীতিবিদরা যে বিষয়টির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তা হচ্ছে, এবারের বাজেটে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ‘নিউ পুওর’ বা ‘নতুন গরিবদে’র সহায়তা ও প্রণোদনার বিষয়ে প্রস্তাবনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্তদের কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকা।
সাধারণত বাজেটে দেশের আগামী এক বছরের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি কি হবে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়। কোন খাতে কত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তার ওপর উন্নয়নের মাপকাঠির ধারণা দেয়া হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাজেটের আকার যত বড়ই হোক না কেন তার যথাযথ বাস্তবায়নের ওপরই এর সার্থকতা নিহিত। বাজেট প্রণয়ন শেষ কথা নয়, তার যথাথথ বাস্তবায়ন না হলে সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের যেমন সক্ষমতার অভাব রয়েছে, তেমনি জবাবদিহিতা না থাকা এবং দুর্নীতি অন্তরায় হয়ে রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিগত দশ বছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নের হার গড়ে শতকরা ৮০ ভাগ হলেও তা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে। অর্থনীতিবিদরা বাজেট বাস্তবায়নের এই নিম্নগামীতার দিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কথা বলেছেন। তারা মনে করছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও ধীর গতির অর্থনীতির মধ্যে বাজেটের আকার বৃদ্ধি এবং তা বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতা বাজেট বাস্তবায়নে একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে রয়েছে। সরকার প্রতি বছরই জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ব্যাপক হারে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করছে। এবারের বাজেটেও বাড়ানো হয়েছে। অথচ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় গত বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন-ভাতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় কাতার ও ভিয়েতনাম। পরবর্তী সময়ে অন্য অনেক দেশ সরকারি ব্যয়ের খাত সংকুচিত করার পথে হেঁটেছে। আমাদের সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন কমানোর পরিবর্তে প্রতিবছরই বৃদ্ধি করছে। এ প্রেক্ষাপটে, সরকারের সবচেয়ে সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বাজেট বাস্তবায়নে বেশি সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিৎ। এবারের বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সুবিধা দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যবসায়ীরা এ সুবিধার সুযোগ নেবেন এবং তারা উৎপাদনে যাবেন। উৎপাদনে গেলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। তবে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করছেন, অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান সুযোগ নিয়ে তা কাজে লাগায় না। সুবিধা কুক্ষিগত রাখার প্রবণতা তাদের মধ্যে রয়েছে। এতে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। বাজেটে ব্যবসায়ীদের বিপুল সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলেও সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো কিছু নেই। বিশেষ করে নতুন গরিব হওয়াদের কথা, যারা মূলত মধ্যবিত্তের অংশ, তা বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি। এতে তারা নিদারুণ হতাশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। অথচ যেকোনো দেশের অর্থনীতি বিনির্মাণ, শিল্প-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার মূল কারিগর মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীসহ উদ্যোক্তা। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়টি আলাদা। তারা ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিরাপদে রয়েছে। করোনার কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীই সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে। আত্মসম্মানবোধের কারণে তারা যেমন কারো কাছে হাত পাততে পারে না, তেমনি সংসার চালাতে না পেরে সীমাহীন দুর্গতি ও দুঃশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে চাকরি ও ব্যবসার পুঁজি হারিয়েছে, অনেকের বেতন কমে যাওয়ায় দরিদ্র হয়ে গেছে। সংসারের খরচ যোগাতে না পেরে অসংখ্য মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। গ্রামে গিয়েও যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে, তারও সুযোগ নেই। আশা ছিল, সীমাহীন দুঃসময়ে পড়া জাতি গঠনে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য বাজেটে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকবে। বাজেটে তাদের জন্য কোনো সুবিধাই রাখা হয়নি। এমনকি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন গরিব হওয়াদের সংখ্যা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নতুন গরিব হওয়াদের নিয়ে গবেষণা ও পরিসংখ্যান করলেও সরকারিভাবে এর কোনো হিসাব করা হয়নি। নতুন দরিদ্রদের নিয়ে সরকারিভাবে কেন গবেষণা ও পরিসংখ্যান থাকবে না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, জাতির মেরুদন্ড হয়ে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণী যদি ধসে যায়, তবে জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিও ব্যাহত হবে। এদের উপেক্ষা করে বাজেটে কোনো সুবিধা না রাখা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে একমাস পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা মনে করি, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকা উচিৎ। এ সুযোগ না থাকলে এসব টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায় এবং যাবে। সেখানে বিনিয়োগ হবে, ঘর-বাড়ি হবে। আবার অনেক সংখ্যালঘু পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ করছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে এসব টাকা বিদেশে পাচার হবে না। ইতোমধ্যে শর্তযুক্তভাবে এ সুযোগ দেয়ায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। দেশের টাকা দেশে থেকেছে এবং দেশেই খরচ হচ্ছে। হাউজিং ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে। এতে অর্থের প্রবাহ বাড়ছে। কাজেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার কোনো কারণ নেই।
প্রস্তাবিত বাজেটে সংশোধন ও পরিমার্জনের সুযোগ থাকে। আমরা মনে করি, মধ্যবিত্ত শ্রেণী, নতুন দরিদ্রদের ব্যাপারে বাজেটে প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তাদের কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বর্তমানে এ শ্রেণীই সবচেয়ে বিপদে রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী যাতে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপনে ফিরতে পারে এজন্য বাজেটে দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে। দেশে কত সংখ্যক নতুন দরিদ্র হয়েছে এ নিয়ে সরকারিভাবে গবেষণা করে তা নিরূপণ করে তাদের জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অবহেলা করলে সামাজিক ভারসাম্য যেমন বিনষ্ট হবে, তেমনি জাতির সার্বিক কল্যাণ ব্যাহত হবে। করোনা সংকটের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেট হোক জনকল্যাণমুখী এবং অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের হাতিয়ার, আমরা এই কামনা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।