Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষায় ভোগান্তির ইঙ্গিত

তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানির নিচে রাজধানী অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলেই ঢাকা আজ মুমূর্ষু : ড. শামছুল হক

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট ডুবে যায়। সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতার। গত মঙ্গলবার ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে পাল্টে যায় রাজধানীর চেহারা। রাস্তায় পানি জমে থাকায় যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে সৃষ্টি হয় যানজটের। পুরান ঢাকার কোনো কোনো এলাকা ড্রেনের ময়লা পানিতে একাকার হয়ে যায়। সব মিলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী।

রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে যুগ যুগ ধরে কাজ চলছে। যানজটের এ শহরে শিগগিরই মুক্তি মিলবে পানিবদ্ধতার বিড়ম্বনা থেকে- এমন প্রতিশ্রুতি প্রতিবছরই শুনছে ঢাকার মানুষ। এ শহরের মানুষকে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশন বুঝে নিয়েছে প্রায় পাঁচ মাস আগে। কিন্তু মঙ্গলবার সকালে মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই বেরিয়ে এসেছে পানিবদ্ধতার পুরোনো চিত্র।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যবস্থাপনা না থাকায় ঢাকায় পানিবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। শুধু খাল উদ্ধার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ঢাকার গাছপালা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মধ্যে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় জরুরি। তা না হলে অপরিকল্পিত ভূমি উন্নয়ন, দখল ও ভরাটের ফলে খাল বা লেক কমে যাওয়ার মাশুল হিসেবে পানিবদ্ধতা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এটি নিরসনে সেই অর্থে কোনো রোডম্যাপই নেই। ফলে ঢাকার মেয়রদের প্রতিশ্রুতি শুনে শুনেই দিন পার করতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পানি প্রবাহের ব্যবস্থাপনা ২০ বছর আগেই পরিবর্তন করেছে। আমাদের দেশে শুধু খাল পরিষ্কার আর উদ্ধারের মধ্যেই ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলেই ঢাকা আজ মুমূর্ষু। শুরুতেই ভুল করা হয়েছে। একের পর এক ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু পানি প্রবাহের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। পানিবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নেই। আর যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয় সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত নয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনের জন্য কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও সমাধান হচ্ছে না। কারণ, ঢাকার জলাধার ভরাট করা হয়েছে। সরকারের চোখের সামনেই তা হয়েছে। খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এখন খাল উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল দেখা যাচ্ছে না। মাটিতে পানি শোষণের ব্যবস্থাও ধ্বংস করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার রাস্তা। বনানী, খিলক্ষেত ছাড়াও উত্তরা, কাজীপাড়া, মতিঝিল, মালিবাগ, রাজারবাগ, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১২, মগবাজার, শান্তিনগর এলাকায় পানিবদ্ধতা ও যানজটের সৃষ্টি হয়। মিরপুরের এক বাসিন্দা জানান, বৃষ্টির পানিতে মিরপুরের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যায়। বর্ষা আসার আগেই এমন দশায় এলাকার মানুষ আতঙ্কিত সামনের দিনগুলোর চিন্তা করে। পুরান ঢাকার অলিগলিতে বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়েছিল। কোনো কোনো এলাকায় আবার ড্রেনের ময়লা পানিতে পুরো এলাকা সয়লাব হয়ে যায়। গতকাল বুধবারও অনেক এলাকার পানি নামেনি। বৃষ্টিপাতের কারণে অভিজাত এলাকা উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর অংশে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে যান চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটে। অন্যদিকে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে গুলশানের দিকে যাতায়াতের রাস্তা সকাল থেকে যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে। কুড়িল বাস স্ট্যান্ড ও রেডিসন হোটেলের আশপাশের রাস্তায় বৃষ্টির ফলে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। একদিকে যান চলাচল বন্ধ থাকায় এর প্রভাব বিমানবন্দর সড়কেও। অন্যদিক, মতিঝিল গোপীবাগ থেকে শুরু করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন সড়ক, শান্তিনগর, কাকরাইল, মানিকনগর, মান্ডা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, রামপুরা, বনশ্রী এলাকার রাস্তাও ডুবে যায়।

এদিকে, লালবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দি ছিলেন মানুষ। কোথাও ছিল কোমর সমান পানি, কোথাও ছিল হাঁটুপানি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলছেন, ঢাকার জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন করা হয়েছে। জলাধার কমে যাওয়া ও খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আগে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৪টি খাল ছিল। সেগুলো উদ্ধার করা হয়নি। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে কিন্তু পানিবদ্ধতার সমাধান হচ্ছে না। কারণ এখানে সমন্বয় নেই।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, প্রকৌশল এখানে কাজ করছে না। শুরুতেই ভূমি উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বিত ছিল না। ব্যক্তি উদ্যোগকে সমন্বয় করা হয়নি। সরকারি সংস্থাগুলো নিজেই জলাভূমি ভরাট করেছে। আমরা আগের ভুলের ফলে এখন খাঁচার মধ্যে বন্দি হয়ে আছি। খাল পরিষ্কার করলেই সমাধান আসবে না। পানি ধারণ ও সরানোর ব্যবস্থার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাবস্থাপনা থাকতে হবে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান বলেন, বর্ষার সময় পানিবদ্ধতার বিষয়টি সামনে আসে, তারপর আবার একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই। প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। বৃষ্টির পানি পড়ার পর মাটি শোষণ করবে কমপক্ষে ২০ শতাংশ, গাছপালা ধারণ করবে কিছু অংশ। কিন্তু ঢাকায় সবুজের বদলে বাড়ছে কংক্রিট। ফলে বৃষ্টির পানি শোষিত হচ্ছে না। তার ওপর পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শুধু ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করলেই হবে না। সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে ব্যবস্থাপনায় না গিয়ে আমাদের ভুল ব্যবস্থাপনার ফলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে না। পানিবদ্ধতা এ কারণে আরও প্রকট রূপ নেবে।

কিছুদিন আগ পর্যন্তও ঢাকা মহানগরীর প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার এবং শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের। ঢাকা শহরের মোট ড্রেনেজ লাইনের ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এছাড়া ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ঢাকা ওয়াসার ছিল। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস গত ১৯ মে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আগে কেউ কখনও এই সমস্যার গভীরে যাননি। খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি। ঢাকার লেক ভরাট করা হয়েছে। সরকারের চোখের সামনেই তা হয়েছে। লেক কমে যাওয়া ও খাল দখলের ফলে অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এখন খাল উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তার ফলাফল বেশি দেখা যাচ্ছে না।

ওয়াসার কাছ থেকে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন খাল থেকে স্কেভেটর ব্যবহার করে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করেছে। ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার স্ট্রর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেনের মধ্যে ৯৪.৭১ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫টি আঞ্চলিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ, পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও সামনের বর্ষায় পানিবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ যে মিলবে না তার প্রমান পেয়ে গেছে রাজধানীবাসী। অনেকের মতে, মাত্র তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতেই সামনের বর্ষায় বড় রকমের ভোগান্তির ইঙ্গিত মিলেছে।



 

Show all comments
  • মোঃ+দুলাল+মিয়া ৩ জুন, ২০২১, ২:২৩ এএম says : 0
    দুই জন মেয়র দুই দিকে একজন দক্ষিণ অন্য জন উত্তর। তিন চার দিন আগেও মেয়র বলেছিলেন শহর লন্ডনের মতো ঢাকা শহর এমন কাজ করিয়াছে আর কোনো সমস্যা নেই। এখন এই গুলি কি দেখতেছে জনগণ। এরা সব লুঠ পাঠ করে খেয়ে ফেলেছে।তাই তাদের বড় বড় কথা বলার জন্য তাদেরকে উচিত জনগণ পানি মাঝে গাঢ় ছেপে দরে রাখা যতে ও সব চোরের খুনি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষা

৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ