Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

হামাসের ডানা ছেঁটে মাহমুদ আব্বাসের হাত শক্ত করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ মে, ২০২১, ৭:১৮ পিএম

ইসরাইল, অধিকৃত পশ্চিম তীর, মিশর এবং জর্ডানে তার তিনদিনের সফর শেষ করে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তার প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে ব্লিঙ্কেন খোলাসা করেছেন যে শান্তি আলোচনা নয়, বরঞ্চ তার এই সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির দীর্ঘমেয়াদ নিশ্চিত করা।

সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাইডেন প্রশাসন মনে করছে যে স্থবির হয়ে পড়া শান্তি আলোচনা শুরু করতে স্থিতিশীলতা জরুরি এবং তা নিশ্চিত করতে ব্লিঙ্কেন জেরুসালেম, রামাল্লাহ এবং কায়রোতে প্রকাশ্যে ও গোপনে তার পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন পক্ষের জন্য শর্তগুলো তুলে ধরেছেন। প্রকাশ্যে তিনি যেটা বার বার বলছেন তা হলো, আমেরিকা গাযার পুনর্গঠনে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসনে পয়সা দেবে, কিন্তু তা থেকে হামাস কোনওভাবেই লাভবান হতে পারবে না। অর্থাৎ ওই টাকা যেন হামাসের হাতে না যায়। একই সাথে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চার বছরে যেভাবে ফিলিস্তিনি প্রশাসনকে অব্যাহতভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে, দুর্বল করা হয়েছে, তার পরিবর্তন চায় আমেরিকা।

তারই প্রমাণ দিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অধিকৃত পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লাহতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের জন্য মার্কিন যে কনস্যুলেট সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বন্ধ করে দিয়েছিলেন তা আবার খোলা হবে। সেই সাথে, ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও)-র অফিস খুলে দেয়া হবে এমন ঘোষণাও দেন ব্লিঙ্কেন। জানা গেছে, মাহমুদ আব্বাস মঙ্গলবারের বৈঠকে ব্লিঙ্কেনকে বলেছেন যে, আল আকসা মসজিদ এলাকায় ইসরাইলের নতুন বিধিনিষেধ এবং পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের উদ্যোগ রাজনৈতিকভাবে তার জন্য বড় ধরণের সঙ্কট তৈরি করেছে। এগুলো বন্ধ করতে ইসরাইলের ওপর চাপ তৈরি করতে অনুরোধ করেছেন তিনি।

জেরুসালেমে মঙ্গলবার ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন ফিলিস্তিনিদের ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘সমান মর্যাদা’ পাওয়ার অধিকারের কথা বলেছেন। রামাল্লায় মাহমুদ আব্বাসের সাথে বৈঠকের পর তিনি বলেছেন যে ‘ফিলিস্তিনি আশা আকাঙ্ক্ষা’ পূরণে আমেরিকা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ বিষয়ে জেরুসালেমে সাংবাদিক হারিন্দার মিশ্র বলেন, ‘ট্রাম্পের শাসনে গত চার বছর ধরে ওয়াশিংটনের যে সুর আমরা শুনেছি, আর মঙ্গলবার জেরুজালেম এবং রামাল্লায় যা শুনেছি, তার মধ্যে মৌলিক তফাৎ। এটা পরিষ্কার যে বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের আস্থা অর্জন করতে চায়। বলতে চায় যে আমেরিকা নিরপেক্ষ একটি মধ্যস্থতাকারী, একচোখা নয়।’

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গাযায় হামাসকে পুরাপুরি অবজ্ঞা করে, কোণঠাসা করার যে সংকল্প বাইডেন সরকার করেছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত? ফিলিস্তিনি প্রশাসন এবং মাহমুদ আব্বাসের হাত কতটা শক্ত করা সম্ভব হবে? নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে জো বাইডেনকে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা কতটা বিশ্বাস করবে? এবং যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো - বাইডেনের এসব পরিকল্পনাকে ইসরাইল কতটা পাত্তা দেবে?

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক সাদি হামদি বলেন, ত্রাণের রাস্তা ধরে গাযায় হামাসের শক্তি খর্ব এবং সেখানে মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ ও ফিলিস্তিনি প্রশাসনের প্রভাব বাড়ানোর পথ নিয়েছেন জো বাইডেন। যুদ্ধবিরতির পর থেকেই গাযায় পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনে অনেক টাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু বলা হচ্ছে, কোনওভাবেই এই টাকা হামাস ছুঁতে পারবে না, বা এ থেকে হামাস লাভবান হতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘আমেরিকা জানে এই দাবি অবাস্তব, বাস্তবে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের কোন ভিত্তিই আর গাযায় নেই। কিন্তু তাদের শর্তে হামাস রাজী না হলে গাযার মানুষকে তারা বলতে পারবে যে তাদের কল্যাণ নিয়ে হামাসের কোনও মাথাব্যথা নেই, তাদের চিন্তা নিজেদের ক্ষমতা- প্রতিপত্তি।’

হামদি আরও বলেন, হামাস এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে ইসরাইলকে প্রতিরোধের যে শক্তি তারা অর্জন করেছে এবং এই লড়াইতে তার যে নমুনা দেখিয়েছে সেটা নষ্ট করারই আমেরিকা এবং ইসরাইলের এখন মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা এখন আমেরিকাকে একবারেই বিশ্বাস করে না। বাইডেনকেও তারা ইসরাইলের সমর্থক হিসাবে দেখে। তারা ভয় পাচ্ছে, হামাসের শক্তি খর্ব করতে ত্রাণকে কৌশল হিসাবে নেয়ার পরিকল্পনা করছে আমেরিকা। স্থিতিশীলতার জন্য ইসরাইল নয়, ফিলিস্তিনিদের ওপরেই শুধু শর্ত চাপানো হচ্ছে।’

হামাসের সাথে ইসরাইলের সর্বশেষ এই লড়াইয়ের শুরুর দিকে জো বাইডেন যেভাবে বার বার ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ কথা বলেছেন তা নিয়ে ফিলিস্তিনিরা ক্ষিপ্ত। এরপর যুদ্ধবিরতির কথা বাইডেন তখনই বলেছেন যখন দলের ভেতর থেকে তার ওপর চাপ বেড়েছে এবং মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে যখন দু’পক্ষ প্রায় রাজী হয়ে গেছে। তাদেরকে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের বিশাল অংশের মধ্যে এই যে অবিশ্বাস-সন্দেহ, তা মাথাব্যথার কারণ হবে আমেরিকার জন্য।

সেই সাথে, ফিলিস্তিনিদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে যে ব্যক্তির শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা তারা করতে চাইছে সেই মাহমুদ আব্বাসের গ্রহণযোগ্যতা এমনকি পশ্চিম তীরেও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।হারিন্দর মিশ্র

বলেন, ‘পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইল নির্বাচন করতে দিচ্ছে না - এই যুক্তি দিয়ে মাহমুদ আব্বাস নির্বাচন স্থগিত করে দিলেন। কিন্তু সবাই জানে, নির্বাচন হলে তিনি হারবেন এবং পশ্চিম তীরেও হামাস জিতবে।’

মাহমুদ আব্বাস ১৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের ক্ষমতায়। এই সময় পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা দেখেছে যে দিনকে দিন ইহুদি বসতি বাড়ছে এবং তাদের জায়গা কমছে। সেই সাথে, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা এবং তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগের কারণে আব্বাসের সমর্থন ক্রমাগত কমছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আল আকসা মসজিদ এবং পূর্ব জেরুসালেম থেকে ফিলিস্তিনি পরিবার উৎখাত নিয়ে ইসরাইলি প্রতিশোধের ঝুঁকি সত্ত্বেও যেভাবে হামাস হস্তক্ষেপ করেছে, তাতে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর আল আকসা চত্বরে ফিলিস্তিনিদের উল্লাসে হামাসের একাধিক পতাকা দেখা গেছে। হামাসকে প্রশংসা করে স্লোগান দেয়া হয়েছে। অথচ সেখানে মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ দলের কোনও পতাকা দেখা যায়নি। মাঠে ফিলিস্তিনিদের এই বাস্তবতা কতটা বদলাতে পারবেন জো বাইডেন, তা অনিশ্চিত। আর এই বাস্তবতা বদলাতে ইসরাইলের সমর্থনও বা কতটা পাবেন তিনি, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

এদিকে, হামাসের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এবং সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ এবং উদ্বেগ তৈরি হলেও, ইসরাইলি জনগণের বিপুল সমর্থন ছিল এই অভিযানের পেছনে। হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইলে ১২ জনের মৃত্যু নিয়ে তৈরি হওয়া শোক এবং ক্রোধের রেশ না কাটতেই গাযায় কোটি কোটি ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, আর জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের জন্য কনস্যুলেট খোলার ঘোষণা পছন্দ করছে না ইসরাইল।

নির্ভরযোগ্য ইসরাইলি সূত্র উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখছে যে, মঙ্গলবারের বৈঠকে রামাল্লায় ফিলিস্তিনি প্রশাসনকে বাড়তি কিছু সাহায্য দেয়ার জন্য ব্লিঙ্কেনের একটি অনুরোধ ইসরাইল কার্যত নাকচ করে দিয়েছে। তারা বলেছে, তেমন সাহায্য তখনই সম্ভব যদি ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরাইলের সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি আব্বাস তার সমর্থন প্রত্যাহার করেন।

মঙ্গলবার দিনভর বৈঠকগুলো শেষ করে সন্ধ্যায় জেরুসালেমে ফিরে ব্লিঙ্কেন সাংবাদিকদের বলেন, ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কিছুদিন পরপর ‘সহিংসতার এই চক্রের’ পেছনের কারণগুলো দূর করতে চান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তিনি সে সময় মন্তব্য করেন, ‘আমেরিকা কী বলছে, কার সাথে বলছে, কী করছে - এর গুরুত্ব অনেক।’ কিন্তু এটাও সত্যি যে গত ৫০ বছরেও ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের বিরোধের স্থায়ী একটি সুরাহা করে দিতে পারেনি আমেরিকা। বাইডেন যে পারবেন - তা নিয়ে বাজি ধরার ঝুঁকি সম্ভবত কেউই নেবেন না। সূত্র: বিবিসি।



 

Show all comments
  • Dadhack ২৭ মে, ২০২১, ১০:২৫ পিএম says : 0
    May Allah wipe out PLO and Mahamud Abbas. Amen
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ