মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
ভারতে ভয়াবহ করোনা মহামারির মধ্যেও রাজধানী দিল্লিতে পুরোদমে চলছে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের কাজ। এটি একটি বিশাল নবায়ন পরিকল্পনার কাজ। এর অধীনে একটি নতুন পার্লামেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন বাসভবন এবং বহুতল অফিস ব্লক নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এসব কার্যক্রমে খরচ হতে পারে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি রুপি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্পের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, এই অর্থ দিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণে আরো উন্নততর উপায়ে অথবা দিল্লির বাতাস পরিষ্কার করার কারণে ব্যবহার করা যেতো। উল্লেখ্য, দিল্লির বাতাস বিশ্বের পঞ্চম দূষিত বাতাস। তবে এসব সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত সরকার। তারা বলেছে, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। নগর উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি বলেছেন, এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং সব ভারতীয়কে গর্বিত করবে এই প্রকল্প। উল্লেখ্য, ভারত যখন করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখনও এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। এর ফলে জনগণের মধ্যে আরো ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। তারা মোদিকে তুলনা করেছেন ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’-এই বাক্যের সঙ্গে। বিরোধী দলীয় নেতা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এই প্রকল্পকে ‘ক্রিমিনাল ওয়েস্ট’ বা অপরাধমূলকভাবে অপচয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এর পরিবর্তে করোনা মহামারি মোকাবিলায় দৃষ্টি দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন মোদিকে।
বিজ্ঞজনরা মোদির এই প্রকল্পের সমালোচনা করে তার কাছে একটি খোলাচিঠি লিখেছেন। তাতে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পদের অপব্যবহার করা হচ্ছে। এই অর্থ দিয়ে অনেক জীবন রক্ষা করা যেতো। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন বাসভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তা নারায়ণী গুপ্ত বিবিসিকে বলেছেন, এটা হলো পুরোপুরি এড়িয়ে চলা। যখন মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন, শ্মশানগুলো লাশে সয়লাব, কবরস্তানে কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, তখন বাতাসের ওপর সরকার প্রাসাদ নির্মাণ করছে।
সব দিক থেকে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে বাসভবন তা খুব চমৎকার। ১২ একর জায়গার ওপর নির্মিত লোক কল্যাণ মার্গে মোদি এখন বসবাস করছেন। এতে আছে ৫টি বাংলো, বিস্তৃত লন। এর তিন কিলোমিটারের মধ্যে আছে প্রেসিডেন্টের বাসভবন এবং পার্লামেন্ট। এর ভিতরে প্রধানমন্ত্রীর আবাসিক কোয়ার্টার ছাড়াও আছে অতিথিদের জন্য ভবন, অফিস, মিটিং রুম, একটি থিয়েটার এবং একটি হেলিপ্যাড। কয়েক বছর আগে, নিকটবর্তী সফদারগঞ্জ বিমানবন্দরের সঙ্গে এই ভবনের সংযোগ স্থাপনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ভূগর্ভস্থ একটি টানেল।
কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান বাসভবন ‘নট ওয়েল লোকেটেড’ বা সুন্দর স্থানে নয়। এই বাসভবনকে নিরাপত্তা দেয়া কঠিন। এ জন্য উন্নত অবকাঠামো প্রয়োজন, যেখানে থাকবে স্বস্তিকর অবস্থা, দক্ষ কার্যক্রম, রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হবে এবং কম খরচের হবে। এ জন্য তার বাসভবন তার অফিসের খুব কাছাকাছি হওয়া প্রয়োজন। কারণ, বর্তমান বাড়ি থেকে অফিসে যেতে তাকে শহরের বড় জ্যাম মোকাবিলা করে যেতে হয়। কিন্তু মোহন গুরুস্বামী বিশ্বাস করেন নতুন যে বাসভবন নির্মিত হচ্ছে সেটা মোদির উচ্চাভিলাষ ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, সব বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। তার আছে কয়েক শত স্টাফ। তারা প্রতিদিন ৩০০ ফাইলের কাজ সম্পন্ন করেন। মোদির আছে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার সৃষ্টি করছেন এবং এ জন্য তার হোয়াইট হাউজ বা ক্রেমলিনের মতো বিশাল ভবন প্রয়োজন। গুরুস্বামী আরো বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা সব সময়ই ‘বিল্ডিং অ্যাট দ্য ব্যাক’ বা পশ্চাতের এই ভবনগুলোতেই বসবাস করেছেন। কিন্তু নতুন বাসভবনের মাধ্যমে মোদি নিজেকে দিল্লির ক্ষমতার করিডোরের কেন্দ্রে বসাতে চাইছেন। গুরুস্বামী বলেন, কিন্তু ক্ষমতার বিচ্ছেদ বা আলাদাকরণ হতে হবে দৈহিকভাবেও। মোদি শুধু একটি নতুন বাসভবনই নির্মাণ করছেন এমন নয়, তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে সাজিয়ে তুলছেন। আর্কিটেকটারাল পরিবর্তন হলো ক্ষমতার প্রকৃতি।
দিল্লির একপ্রান্তে রাষ্ট্রপতি ভবন এবং অন্যপ্রান্তে সুপ্রিম কোর্ট। এর মাঝে পাওয়ার করিডোরের মধ্যে হবে এই ভবন। আর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিক উল্টোপাশে থাকবে পার্লামেন্ট। সরকারি ডকুমেন্ট অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে সাউথ ব্লকের মধ্যে ১৫ একর জায়গার ওপর প্রধানমন্ত্রীর দখলে থাকবে ১০টি চারতলা বিশিষ্ট ভবন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অফিস ওই সাউথ ব্লকে অবস্থিত। ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশরা যে সারিবদ্ধ ব্যারাক নির্মাণ করেছিল এবং বর্তমানে তা অস্থায়ী অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা ভেঙে ফেলা হবে। তবে এই বাসভবন নিয়ে আরো তথ্য পাওয়া বিরল।
এ বিষয়ে এক ইমেইলের জবাবে প্রজেক্ট আর্কিটেক্ট বিমল প্যাটেলের অফিস থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কারণে বিস্তারিত তথ্য আমরা শেয়ার করতে পারবো না। নির্মাণ খাতে খরচ কত হবে তাও স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। ফলে স্বচ্ছতার অভাবের জন্য এ প্রকল্প নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন অন্য আর্কিটেক্ট, সংরক্ষণবাদী এবং পরিবেশবিদরা। অনুজ শ্রীবাস্তব নামে একজন আর্কিটেক্ট বলেছেন, এ বিষয়ে কোনো জনশুনানি হয়নি। এমনকি প্রকল্প বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে কোনো স্বচ্ছতা দেখানো হয়নি।
মাধব রমন নামে একজন বলেছেন, সাউথ ব্লকের এত কাছে এত বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু করা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সাউথ ব্লক হলো একটি সুরক্ষিত স্থাপনা, যা বিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ আর্কিটেক্ট এডউইন লুটিয়েন্স এবং হার্বার্ট বেকারের ডিজাইনে নির্মিত হয়েছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আইন বলে, নৃতাত্ত্বিক অবকাঠামো থেকে কমপক্ষে ৩০০ মিটার দূরে অন্য কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন যে বাড়ি নির্মাণ করার কথা তা মাত্র ৩০ মিটার দূরে। এ ছাড়া ওই জমিতে প্রচুর গাছপালা আছে, তার কি হবে?
এছাড়া, মানুষের মধ্যে অবসাদ দূরীকরণের জন্য, প্রতিবাদ বিক্ষোভ বা মোমবাতি প্রজ্বলনের স্থান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে রাজপথ। সরকার বলেছে, রাজপথ একটি পাবলিক প্লেস বা উন্মুক্ত স্থান হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এর খুব কাছে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। ফলে সেখানে বড় কোনো সমাবেশের অনুমতি দেয়া হবে না বলেই মনে হয়। ইতিহাসবেত্তা নারায়ণী গুপ্ত বলেন, ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য আর্টস, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, ভারতের আধুনিক ইতিহাসের ভান্ডার ন্যাশনাল আর্কাইভসের স্থানে গড়ে উঠবে বহুতল বিশিষ্ট ভবন। এর ফলে ইন্ডিয়া গেট ঢাকা পড়বে এবং মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হবে না। এ ছাড়া বিরল সব পান্ডুলিপি এবং ভঙ্গুর জিনিসপত্র অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কিভাবে আমরা জানবো যে, এসব জিনিসের কোনো ক্ষতি হবে না?
থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্সের কাঁঞ্চি কোহলি বলেন, দিল্লির ভূমি সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশে ডিজাইন করা হয়েছে। যেমন অবকাশ যাপন, আধা সরকারি বা সরকারি হিসেবে। ফলে সরকার চাইলেই কোনো এলাকাকে নিয়ে নিতে পারে না এবং তার ব্যবহার পাল্টে ফেলতে পারে না। এটা যদি করা হয় তাহলে তা হবে ভূমি গ্রাস।
এ প্রকল্পের পক্ষে কথা বলেছেন, নগর উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরি। করোনা মহামারিকালে সরকারের অগ্রাধিকার নিয়ে সমালোচনাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন, কয়েক বছর ধরে এই প্রকল্পের কাজ চলবে। এর খরচ ধরা হয়েছে ২০০০০ কোটি রুপি। পক্ষান্তরে করোনার টিকাদান কর্মসূচিতে সরকার এর প্রায় দ্বিগুন অর্থ বরাদ্দ করেছে। সম্প্রতি তিনি ধারবাহিকভাবে টুইট করে চলমান সেন্ট্রাল ভিস্তা এভিনিউয়ের কাজ নিয়ে ভুয়া ছবি ও গুজব বিশ্বাস না করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, সেন্ট্রাল ভিস্তা হবে একটি বিশ্বমানের পাবলিক স্পেস। এর জন্য প্রতিজন ভারতীয় গর্ববোধ করবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, অসমর্থনযোগ্য বিষয়ের পক্ষ অবলম্বন করছেন মিস্টার পুরি। তার ভাষায়, আমার সন্দেহ নেই যে এই প্রকল্প শেষ হলে প্রতিজন ভারতীয় গর্বিত হবেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এ প্রকল্প যে সময়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা এক ভুল সময়। যখন আমাদের চারপাশে মানুষ মারা যাচ্ছেন, তখন আমরা আরেকটি ভবন নির্মাণে কতই না ব্যস্ত হয়ে পড়েছি! সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।