বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
এবারের মাহে রমজান বিভিন্ন দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবং তজ্জনিত নানা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের দেশেও সর্বত্র এখনো একটি ভীতির আবহ বিরাজ করছে। এক আশ্চর্য মৃত্যুভীতিতে যেন কুঁকড়ে গেছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু এই ভয়ভীতির পরিবেশেও মাহে রমজানের জুমা-তারাবিতে মসজিদে মসজিদে বিপুল মুসল্লির সমাগম ছিল। নিঃসন্দেহে এই দেশের জন্য এটা অত্যন্ত ইতিবাচক ব্যাপার। আল্লাহ তায়ালা এই দেশ ও দেশের নাগরিকদের রক্ষা করুন। তিনিই একমাত্র রক্ষাকর্তা।
রমজানের শুরুর দিক থেকেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। ওখানে মিনিটে মিনিটে মানুষ মারা গেছে। অক্সিজেনের তীব্র সংকটে বহু মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে শোনা গেছে। ভারতের এই ভয়াবহ সংকটের মুহূর্তে মুসলিম দেশগুলোকে দেখা গেছে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে। এমনকি ভারতের ‘চির বৈরী’ রাষ্ট্র পাকিস্তানও এই সংকটে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
মুসলিম-রাষ্ট্রগুলোর এই মানবিক সহমর্মিতার অবস্থান শুধু এই এক ঘটনায় নয়, মানবতা ও সহমর্মিতার অসংখ্য দৃষ্টান্তে মুসলিম জাতির ইতিহাস উজ্জ্বল। এই সকল উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যখন জাতি হিসেবে আমাদের উদ্দীপ্ত করে, একইসাথে তা স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম জাতির সাথে ঘটে যাওয়া চরম অমানবিক আচরণগুলোও। আরাকানের মজলুম মুসলিমদের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের যে ন্যক্কারজনক বিমুখতা ও অমানবিকতা তা মানবতার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। একই কথা কাশ্মীরের মুসলমান, চীনের উইঘুর মুসলিম ও পৃথিবীর নানা প্রান্তের মজলুম মুসলমানদের ক্ষেত্রেও সত্য। ইহুদীবাদ সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের পবিত্র ঈদের দিনেও ফিলিস্তিনিদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি। ঈদের আগে পরে ইসরাইলী হামলায় ফিলিস্তিনের ২০০ ওপরে নিরপরাধ মজলুম মুসলমানদের শহীদ হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে নিগৃহীত মুসলিম জাতি যখন ধর্ম-বর্ণ বিচার না করে কোনো দেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে সহমর্মিতার পয়গাম নিয়ে দাঁড়ায় তখন তা এই জাতির উদার উন্নত মানবিক চেতনা-বিশ্বাসেরই পরিচয় বহন করে।
করোনা আতঙ্কের মধ্যেও মুসলিম জনগণের মসজিদে যাওয়ার যে আকুতি, কারো কারো কাছে তা যেমনই মনে হোক, এটাই আসলে মানুষের স্বাভাবিকতা। মানুষের অন্তরের গহীনে প্রচ্ছন্ন আছে আল্লাহমুখিতার গভীর চেতনা। সে কারণেই দেখা যায় চরম বিপদের মুহূর্তে মানুষ এক আল্লাহকেই ডাকে। দেশে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার যখন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে তখন এক আল্লাহকে ডাকার অসংখ্য দৃষ্টান্ত সামনে এসেছে। ভারতের সা¤প্রতিক পরিস্থিতিতেও দেখা গেছে এরকমের বেশ কিছু দৃষ্টান্ত।
আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদের বিভিন্ন জায়গায় এ সত্যের প্রতি মানুষকে সচেতন করেছেন। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই পারেন মানুষকে বিপদমুক্ত করতে। তাঁরই ইচ্ছায় বিপদ আসে, তাঁরই ইচ্ছায় তা বিদায় নেয়। মানুষের কর্তব্য, এইসকল বিপদ থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং ভুল স্বীকার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা! কিন্তু বঞ্চিত মানুষরা এই করণীয় সম্পর্কে উদাসীন থাকে।
কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ : আমি যদি তাদের প্রতি দয়া করি এবং তারা যে কষ্টে আছে তা দূর করে দেই, তবে তারা তাদের অবাধ্যতায় গোঁ ধরে উদ্ভ্রান্ত ঘুরে বেড়াবে। আমি তো তাদেরকে শাস্তিতে ধৃত করেছিলাম। তখনও তারা নিজ প্রতিপালকের সামনে নত হয়নি । তারা অনুনয়-বিনয় করে না। অবশেষে যখন আমি তাদের জন্য কঠিন শাস্তির দুয়ার খুলে দেব, তখন সহসা তারা তাতে হতাশ হয়ে পড়বে। (সূরা মুমিনূন : ৭৫-৭৭)।
এই পৃথিবী আল্লাহর, এখানে যা কিছু ঘটে তাঁর আদেশেই ঘটে। তাই এইসকল ঘটনা তাঁরই কুদরত ও শক্তিমত্তার এবং অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই একেকটি নিদর্শন। প্রতিটি ঘটনা মানুষের জন্য বড় গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। যে বার্তা মানুষ ও বিশ্বজগতের সৃষ্টির তাৎপর্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর তা হচ্ছে আখিরাতের জীবন সম্পর্কে সতর্কতা ও হুঁশিয়ারি।
দুনিয়ার ক্ষুদ্র ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের আরো ক্ষুদ্র বিপদাপদ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে থাকেন আখিরাতের ভয়াবহ ও চিরস্থায়ী বিপদ সম্পর্কে, দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট আখিরাতের দুঃখ-কষ্টকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করার উপায়। চোখের সামনে অন্যের মৃত্যু জীবিতের পক্ষে নিজ মৃত্যুকে স্মরণ করার উপকরণ। কাজেই এইসব বিপদাপদের বার্তা হচ্ছে ঔদ্ধত্য ও উদাসীনতা ত্যাগ করে আল্লাহর সামনে বিনীত হওয়া। এটিই বুদ্ধিমানের পরিচয়। চ‚ড়ান্ত সময় এসে পড়ার আগেই যে সতর্ক হতে পারে, নিজেকে ঠিকঠাক করে নিতে পারে সেই তো বুদ্ধিমান।
অন্যথায় সেই ভয়াবহ সংকট যখন এসে যাবে, আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবন যখন শুরু হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তায়ালার চূড়ান্ত আজাব থেকে আত্মরক্ষার আর কোনো উপায় থাকবে না। কোথাও কোনো আশার আলো দেখা যাবে না। চারদিকে শুধু হতাশা আর হতাশাই বিরাজ করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের হেফাজত করুন।
মাহে রমযানে করোনা-আকারে বিশ্বব্যাপী বিশেষত আমাদের পাশের দেশের যে ভয়াবহ অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি আল্লাহমুখিতার পথ অবলম্বন করতে পারি, সব ধরনের ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতা ছেড়ে আল্লাহর সামনে নিজেকে অবনত করতে পারি, তাহলে চারপাশের এই ভয়াবহ বিপদও আমাদের জন্য ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে। আমাদের রমজান-পরবর্তী জীবন তাকওয়ার আলোয় আলোকিত হোক- এই প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।