দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
প্রয়োজনীয়তা:
(১) ‘তাকাফুল’ বা ‘ইনসিওরেন্স’ বা অনুরূপ কোন সমিতি বা সমবায় বা সংস্থা বা কয়েকজনের যৌথ উদ্দোগের মাধ্যমে যদি “তোমরা পরস্পরকে সৎ ও কল্যাণকাজে, তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা কর”(আল-মায়েদা: আয়াত নং-২) -এর আলোকে মুসলমানদের বা সমাজ ও দেশের লোকজনের কল্যাণ বা আংশিক কল্যাণ করা যায়, তা কি না-জায়েয হবে? তাতে কি কোন সওয়াব পাওয়া যাবে না?
(২) পাশ্চাত্যের বা অমুসলিম দেশগুলোর যারাই ‘ইনওিরেন্স’ নামের প্রচলিত সুদী বিনিয়োগ পদ্ধতি বা পারস্পারিক সহযোগিতার নামে জনগণকে, বিশেষ করে মুসলমানদের সুদের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে ফেলেছে; সেই মুসলমানদের সজাগ-সতর্ক করার পাশাপাশি বিকল্প হালাল ও বৈধ পন্থা-পদ্ধতি কি হতে পারে, তা দেখিয়ে দেয়া, কি একজন আলেম বা মুফতী হিসাবে, দীনের একজন দা‘য়ী হিসাবে, মুসলমানদের একজন নেতা ও শাসক-রক্ষক হিসাবে সকলের দায়িত্ব বর্তায় না? অবশ্যই যার যার শক্তি-সামর্থ মোতাবেক দায়িত্ব আছে। বিশেষত বিষয়টি যখন এমন হয় যে, তাতে সাধারণ জনগণ মুসলিম হোক আর অমুসলিম হোক; গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে অভ্যস্থ হয় এবং তাতে তাদের জাগতিক লাভ ও সম্বৃদ্ধির স্বপ্ন জড়িত হয়। “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব বিষয়ে জবাবদেহি করতে হবে” -এ সব হাদীস কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
(৩) তা ছাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন ‘ইনসিওরেন্স’ ইত্যাদির মত কোন সুদী ব্যবস্থা বা সিস্টেম, কারও ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক চালু হয়ে যায়। আমার দেশ ও জনগণ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে গিয়ে বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে, তাতে না জড়িয়ে উপায় থাকে না; তখন তো দেশ-প্রেমিক ও সমাজ সচেতন একজন নায়েবে-নবী হিসাবে তেমন ‘সুদী ইনসিওরেন্স’ এর একটা বিকল্প ‘সুদবিহীন ইনসিওরেন্স’ দাঁড় করিয়ে, দেশ ও দেশের জনগণকে সুদ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা, নৈতিক দায়িত্ব নয় কি?
(৪) ইনসিওরেন্স বা বীমা ব্যবস্থার ‘মূল শ্লোগান’ ও প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ বা কাছাকাছি অর্থের শব্দ দ্বারা, যে-ভাব-ব্যাখ্যা ও কল্যাণ বোঝানো হয়; সেই কল্যাণ সাধন বা কামনা তো ইসলামী আদর্শ, বোধ-বিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনা বিরোধী নয়। কেবল সমস্যা দাঁড়িয়েছে সুদী ব্যবস্থা, কর্ম-কৌশল ও সুদের সংশ্লিষ্টতার দরুন। আমরা সেই ব্যবস্থা ও কর্ম-কৌশল বাদ দিলাম! এবার দেখুন তো বীমা বা ইনসিওরেন্স এর মূল দাবী ও চাহিদা সম্পূর্ণ ইসলামী আদর্শেরও দাবী ও চাহিদা কি না? দেখুন! হযরত মাওলানা আবদুর রহীম এর ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’ (পৃ-৮৬-১২০, সংস্করণ-২০০৫খ্রি. খায়রুন প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা); প্রাক্তন সিএসপি ও সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর সাবেক মহাপরিচালক এ জেড এম শামসুল আলম এর ‘ইসলামী ইন্সুরেন্স (তাকাফুল’) নামক (পৃ-১৬-৬১, মাম্মী প্রকাশনী, প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার ,ঢাকা, সংস্করণ-সেপ্টেম্বর-২০০১খ্রি.) পুস্তকটি; এবং মালয়েশিয়া ইসলামী ইন্সুরেন্স কোম্পানীর অঙ্গ সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ট্রেইনিং’ (কুয়ালালামপুর, সংস্করণ-১৯৯৬) কর্তৃক সংকলিত ‘তাকাফুল’ শীর্ষক পুস্তকগুলো।
আমার ধারণা মতে, অবহিত মহল সেসবকে পুরোনো কথা ও চর্বিত চর্বন ভাবতে পারেন, তাই সংক্ষেপ করলাম।
(৫) এ ছাড়া, যারা শুধু পাশ্চাত্যের সুদী উদ্দোক্তাদের সেই প্রচলিত সুদী বীমা নিয়েই কেবল আলোচনা করে থাকেন এবং সেই আদলে প্রতিষ্ঠিত নিজ দেশের সুদী ইনসুরেন্স এর বাইরে আদৌ চিন্তা করেননি; তাঁদের তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। এমনকি তাঁরা বরং নিজ রাষ্ট্রীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বহুমুখী নির্যাতনের মুখে, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায়, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে, সেই সুদী ব্যবস্থাকেই নিজেদের স্বধর্মীয় সংখ্যলগু মুসলিমদের নিরাপত্তা বিবেচনায় ‘জায়েয’ মর্মে ফাতওয়া দিয়ে রেখেছেন (দ্র. জাদীদ ফিকহী মাবাহিস: খ-৪, পৃ-১৬৭-৩০৮, সম্পাদনা: মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী, ইদারাতুল কুরআন ওয়াল-উলূমুল ইসলামিয়া, ৪৩৭-ডি, গার্ডেন ইস্ট, করাচী-৫, পাকিস্তান; একইভাবে ভারত থেকে প্রকাশিত ১৯৬৫খি. থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় বড় ফাতওয়া গ্রন্থ রয়েছে, তার সবগুলোতেই প্রায় একই ফাতওয়া আলোচিত হয়েছে)।
যেহেতু স্থান-কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষ প্রয়োজনে ফাতওয়া পরিবর্তন হতে পারে; সে হিসাবে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যালগু মুসলিমদের ক্ষেত্রে উক্ত ফাতওয়া সঠিক আছে বা ছিল। তাতে আমাদের দ্বিমতের কিছু নেই। তাঁদের প্রথম দফার গবেষণা ছিল ‘মজলিসে তাহকীকাতে শরঈয়্যাহ লখনৌ’ এর অধীনে, যার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে মোট ১০জন আলেম ও মুফতী স্বাক্ষর করেছিলেন। যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৫খ্রি. সালে। বিষয় ছিল ভারতীয় মুসলিমদের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ইন্সুরেন্স এর বৈধতা; ‘ইসলামী ইন্সুরেন্স’ বা ইন্সুরেন্স এর ইসলামীকরন সম্ভব কি না? তেমন কিছু নয়।
দ্বিতীয় দফা’র গবেষণা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯-১২/৮/১৯৯২খ্রি.মোট চারদিনে এবং তাতে প্রশ্নোত্তরের জবাব আকারে মোট ২২জন, অভিমত আকারে মোট ২২জন ও প্রব›দ্ধ উপস্থাপন করেন মোট ২৪জন। সর্বমোট ৬৮ জনের লেখা উক্ত গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। আর এটি ছিল ‘ইসলামিক ফিকহ একাডেমী, ইন্ডিয়া’ এর চতুর্থ সম্মেলন। এ সম্মেলনের পূর্বে সকলের কাছে পাঠানো প্রশ্নাবলিতে এবং প্রথমদিনের স্বাগত ভাষণের উপসংহারে বলা ছিল, “উল্লেখ্য, আলোচনা ও গবেষণার বিষয় এটি নয় যে, ইনসুরেন্স বা তাতে অংশগ্রহণ জায়েয কি না? এ মুহূর্তে লক্ষণীয় বিষয় হল, শুধু এটি যে, ইন্সুরেন্সকে না-জায়েয ধরে নিয়ে, ফিকহগত বিবেচনায় ঠেকা হিসাবে তাতে জড়িত হওয়ার অনুমতি প্রদান করা যায় কি না?...”। অর্থাৎ এতেও ইসলামী ইন্সুরেন্সের কোন প্রসঙ্গ নেই। সুতরাং আমরা বাংলাদেশের আলেম ও মুফতিগণ কোন্ বিবেচনায় তাঁদের ফাতওয়ার কিতাবগুলোর কয়েক লাইন অধ্যয়ন করেই গণহারে ‘ইনসুরেন্স’ বলতেই না-জায়েয বলে ফেলি বা ফাতওয়া দিয়ে বসি? আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বা ইসলমী দেশ বিবেচনায় আমাদের ফাতওয়া হবে ভিন্ন , আমাদের গবেষণা হবে ভিন্ন , আমাদের দায়-দায়িত্ব ও কর্মপন্থা হবে ভিন্ন! যেমনটি বিজ্ঞ উস্তাদ মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী প্রমুখও আলোচ্য বিষয় না হওয়া সত্তে¡ও, উক্তসব সেমিনারে মৌখিক ও লিখিতভাবে উল্লেখ করেছেন (দ্র. পৃ-২১২-৫৯৬)। আমাদের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে যারা ইসলামী ইন্সুরেন্স চালু করেছেন এবং সফল হয়েছেন, যেমন বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও সুদান। এমনকি লুক্সেমবার্গ, বাহামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও (এ. জেড. এম শামসুল আলম, ইসলামী ইন্সুরেন্স, পৃ-১২); তাঁরা কিভাবে বীমা’র ইসলামীকরন করেছেন, তা আদ্যপান্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করা এবং নিজেদের অর্জিত ইলম-কালামের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া।
শুধু নাম দেখেই হালাল-হারাম বলা যায় না:
শরী‘আ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহকে সহীহ নির্দেশনা বা সঠিক সিদ্ধান্তদানের মত যথাযোগ্য একজন আলেম বা মুফতির কাজ হচ্ছে, মৌলিক বোধ-বিশ্বাসকেন্দ্রিক বিষয় হোক বা ইবাদত-আমল হোক বা বিয়ে-শাদী ও সামাজিক বিষয়াদি হোক বা লেনদেন ও ব্যবসায়-বাণিজ্য বিষয়ক কিছু হোক; তা যদি নামে ও কাজে সর্বোত্তম তিনযুগে এবং গবেষক ইমামগণের যুগে পরিচিত ও জানাশোনা বিষয় হয়ে থাকে; তা হলে তাঁরা যেভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে ফায়সালা-সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহ্ ও তা‘আমুল (পারস্পারিক আমল ও আচরিত রীতি) মোতাবেক যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন; ঠিক সেভাবেই আমাদেরকে হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধ ফায়সালা দিয়ে যেতে হবে। তার ব্যতিক্রম করার কোন সুযোগ শরীয়তে নেই; যেমন সালাত, সওম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি বিষয়ে।
বিষয়টি যদি এমন হয় যে, দেশ-দেশান্তরের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিক কারণে নামে পরিবর্তিত হয়েছে বটে, তবে বাস্তব কাজে সেই একই বিষয়, একই আমল; তা হলে সেক্ষেত্রে সেই মূলের অনুরূপ তা-ও বৈধ বা অবৈধ বলে গণ্য হবে। যেমন ‘সালাত’, ‘সওম’ আমল দু’টির নাম পরিবর্তিত হয়ে, পারশ্য অঞ্চলে ও উপমহাদেশে ‘নামায’ ও ‘রোযা’ নামে পরিচিত ও প্রচলিত হয়ে আছে। এতে শরীয়তে কোন সমস্যা নেই। কারণ, মূল কাজ বা অমল সেই একই।
আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, মনে করুন! একটা লোকের নাম ‘নির্মল’ বা ‘বিমল’ বা ‘বিপ্লব’ যার অর্থও একেবারে খারাপ বা তেমন মন্দ নয়! পরিস্কার বা পরিচ্ছন্ন, ময়লামুক্ত ও ইনকিলাব-সংগ্রাম। আমাদের কুরআনের শব্দ ‘তাযকিয়া’ বা ‘তাসফিয়া’ ও জিহাদ-সংগ্রাম এর কাছাকাছি অর্থ। এখন এই নামের কেউ যদি মুসলমান হয় বা একজন মুসলমান এমন নাম ধারন করেন; কিন্তু তার কাজ-কর্ম, ইবাদত-বন্দেগী সব শরীয়ত মতে ঠিক থাকে; (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।