দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
তাকওয়া অর্থ খোদাভীতি। মহান আল্লাহ তায়ালার ভয়ে শরীয়ত নির্দেশিত বিধানানুযায়ী জীবনযাপন করা। ইসলামের নিষেধাজ্ঞা অমান্য না করা। যাপিতজীবনের প্রতিটি ক্ষণ, শাখা ও কার্যক্রমে ইসলামী বিধি-বিধান মান্য করা। সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা করা। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আলি (রা.) তাকওয়ার সংঙ্গা এঁকেছেন এভাবে, ‘তাকওয়া হলো আল্লাহকে ভয় করা, কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা ও বিচার দিবসের পাথেয় সংগ্রহ করা।’ যে অব্যর্থ রীতি একজন মানুষকে পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ও সীমাহীন মর্যাদাবান করে তোলে তার নাম তাকওয়া। খোদাভীতির অমোঘ নীতিমালা মহান আল্লাহর নিকট প্রিয়পাত্র হওয়ার প্রধানতম পদ্ধতি। অন্যায়-অনাচারের মোক্ষম কার্যক্ষেত্র হলো নির্জনতা। সাধারণত প্রকাশ্যে যেসব অন্যায়-অপরাধ করতে মানুষ লজ্জাবোধ করেন সেগুলো নির্জনে করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু তাকওয়ার শক্তিটা এমন প্রভাবশালী, নির্জনতার ভেতরেও অপরাধ প্রবণতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে মানবজাতিকে তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য বিশেষ বিশেষ পুরস্কার ও ফজিলতের কথা। মানব অন্তকরণকে তাকওয়া সমৃদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে ছত্রে ছত্রে।
তাকওয়ার গুরুত্ব: খোদভীতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহান রব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে যেমন ভয় করা দরকার ঠিক তেমন ভয় করতে থাকো এবং পূর্র্ণ আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ কর না।’ (আলে ইমরান: ১০২)
তাকওয়া অবলম্বনকারীর পুরস্কার: তাকওয়া অবলম্বনকারীর পুরস্কার ও ফজিলত ঘোষণা করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্র্থক্য করার শক্তি দেবেন। তোমাদের পাপ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়।’ (আনফাল: ২৯)
উক্ত আয়াতে তিনটি পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (এক) ‘ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য শক্তি। (দুই) পাপের প্রায়শ্চিত্ত। (তিন) মাগফিরাত ও পরিত্রাণ। তাকওয়া অবলম্বনকারীকে ফুরকান দান করা হবে, কথাটির মর্ম অধিকাংশ তাফসিরকারকের মতে এই যে, তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার সাহায্য-সহায়তা থাকে এবং তিনি তাদেরকে হেফাজত করেন। কোনো শত্রু তাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে না। যাবতীয় উদ্দেশ্যে তারা সাফল্য লাভে সমর্থ হন। (মাআরিফুল কুরআন: ৫২৮)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিস্কৃতির পথ বের করে দেবেন এবং তার ধারণাতীত স্থান থেকে তাকে রিজিক দান করবেন।’ (তালাক: ২-৩)
আলোচ্য আয়াতে খোদভীতির দুটি কল্যাণ বর্ণিত হয়েছে। (এক) তাকওয়া অবলম্বনকারীকে যাবতীয় সংকট ও বিপদ থেকে এবং পরকালের সব বিপদাপদ থেকে নিস্কৃতি। (দুই) তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা কল্পনায়ও থাকে না। এখানে রিজিকের অর্থ ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু। (মাআরিফুল কুরআন: ১৩৮১)
তাকওয়ার মানদন্ডকে মানুষের সত্যিকার আভিজাত্য ও সম্মানের প্রকৃত মানদন্ড স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’ (হুজুরাত: ১৩)
খোদাভীতি অর্জনের পদ্ধতি: খোদাভীতি অর্জনের পদ্ধতি বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’ (তাওবা: ১০৯)
আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সত্যবাদীদের সাহচর্য এবং তাদের অনুরূপ আমলের মাধ্যমেই তাকওয়া অর্জন হয়। খোদার অবাধ্য নাফারমানদের সংস্রব মানুষকে খোদাভীতির পথ থেকে স্খলন ঘটায়। তাই গোনাহগারদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে সত্যবাদী সৎকর্মীদের সান্নিধ্য অবলম্বন করা জরুরি।
তাকওয়া অর্জনের শেষফল:তাকওয়া অর্জনকারীগণই প্রকৃত সফল। খোদাভীতির সম্পদই মৌল সম্পদ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে তারাই কৃতকার্য।’ (নুর: ৫২)
মসজিদে নববিতে হজরত উমর (রা.) এর নিকট একজন রুমি গ্রাম্য ব্যক্তি এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। উমর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? লোকটি উল্লিখিত আয়াত পাঠ করে বললেন, এই আয়াতের ভেতর সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থের বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত আছে। আমার মনে বিশ্বাস জন্মেছে, এটি অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। ‘যারা আল্লাহর আনুগত্য করে’ বাক্যটি ফরজ হুকুমের সাথে, ‘রাসুলের আনুগত্য করে’ অংশটি সুন্নাতের সাথে, ‘আল্লাহকে ভয় করে’ বাক্যটি অতীত জীবনের সাথে, ‘আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে’ বাক্যটি ভবিষ্যত জীবনের সাথে সম্পর্ক রাখে। মানুষ যখন এই চারটি বিষয় পালন করবে, তখন তাকে ‘সফলকাম’ হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হবে। সফলকাম ওই ব্যক্তি, যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতে স্থান পায়। উমর (রা.) একথা শুনে বললেন, নবি করীম (সা.)-র কথায় এর সমর্থন পাওয়া যায়। (মাআরিফুল কুরআন: ৯৪৯)
তাকওয়া এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের চরিত্রকে ভেতর-বাহির উভয় দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদান ও মাধ্যম হলো আল্লাহর ভয়। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আল্লাহর বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনের একমাত্র নিয়ামক হল তাকওয়া। খোদাভীতি এমন বিষয়, যা জনমানবহীন প্রান্তরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, সাগরের গভীর অতলান্তে মানুষকে অপরাধে লিপ্ত হতে বাধা দেয়। সমাজ জীবনে অপরাধ সংগঠনের পথে মারাত্মক বাধা তাকওয়া। তাই সমাজের সুখ ও সমৃদ্ধি নাগরিকদের তাকওয়ার উপর নির্ভরশীল।
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ
শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।