পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। দেশীয় অনেক শিল্পেই ধ্বস নেমেছে। তবে বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক শিল্পে করোনার আঘাতটা এসেছে অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে মারাত্মক হয়ে। করোনাকালীন সময়ে বস্ত্র এবং বস্ত্রপণ্যের চাহিদা কমেছে। বিদেশি ক্রেতারা তৈরি পোশাকের অর্ডার বাতিল করছে শিপমেন্ট স্থগিত করেছে। এমনকি পণ্যের দামও কমিয়েছে। জনগণের আয় কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে বস্ত্রের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের বস্ত্রখাতে বৃহত্তম তিনটি উপখাত স্পিনিং, উইভিং ও ড্রাইং-ফিনিশিং এবং তৈরি পোশাক শিল্প লোকসান গুণতে গিয়ে কোনটি বন্ধ হয়ে গেছে; আবার কতক চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে এই উপখাতগুলোয় কর্মসংস্থান হওয়া প্রায় ২৫ লাখ কর্মকতা-কর্মচারীর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমরা জানি, এ তিনটি খাত দেশীয় অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যার কারণে পোশাক শিল্পখাত ৭৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতা, অর্থাভাব, সুদের উচ্চ হার, বাড়তি কর-ভ্যাটের বোঝা আর গ্যাস-বিদ্যুত সংকটে বিপর্যস্ত এ খাতকে দেশের স্বার্থেই বাঁচানো প্রয়োজন।
বস্ত্রখাত শক্তিশালী করার স্বার্থে সবার আগে টেক্সটাইল (তাঁত এবং স্পিনিং) শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। পত্রিকান্তরে জানা যায়, দেশে প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা, দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এ পরিপ্রেক্ষিতে, দেশীয় শিল্প রক্ষার স্বার্থে সরকারের উচিত বস্ত্র ও সুতা খাতে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা। দেশের সুতা উৎপাদনের খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে জর্জরিত। অথচ এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে চারশ’র মতো সুতার মিল রয়েছে। অনেক স্পিনিং মিলই এখন বন্ধ রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাব যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বস্ত্রখাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। উদ্বেগের বিষয়, দীর্ঘমেয়াদি চাপে পড়া বস্ত্র খাতের ব্যাপারে সরকারও তেমন কিছু বলছে না। একের পর এক ট্যাক্স, ভ্যাট চাপিয়ে দেয়া, শিল্পখাতে আকাশচুম্বি গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
বস্ত্রখাতের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা ও উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক আছে। অথচ করোনাকালে বস্ত্রশিল্পে দুর্দশার চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। কেবল তৈরি পোশাক খাতে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। সরকারি আদেশে উৎপাদন বন্ধ ও ব্যাহত হওয়ায় দেশীয় বাজারে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত স্পিনিং, উইভিং ও ড্রাইং-ফিনিশিং মিল। এসব কারখানাও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বস্তুত, করোনায় সুতা উৎপাদন, বস্ত্র তৈরি এবং কাপড় প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা, বকেয়া ঋণ পরিশোধের সুবিধা, প্রয়োজনীয় সুদ মওকুফসহ এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বাস্তবোচিত পদক্ষেপের বিকল্প ইেন।
এ কথা বলতে হয়, নানা ষড়যন্ত্র আর চড়াই-উৎড়াই পার করে দেশীয় বস্ত্রখাত একটা অবস্থা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়েছে এ শিল্প। দেশীয় অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের ভূমিকাও রাখছে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের একটা বিশাল অংশ টেক্সটাইল শিল্প ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা ঠিক রাখতে যে কোন মূল্যে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে। বেকার হয়ে পথে বসবে লাখ লাখ কর্মজীবী মানুষ। ইতোমধ্যে এ শিল্পের অনেকেই বেকার হয়ে পথে বসেছে। এছাড়া সরকারী বস্ত্র এবং পাট কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হওয়ায় এ শিল্পে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আজকের এ প্রবন্ধে বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্পখাত তথা বস্ত্রখাত রক্ষায় আগামী বাজেটে কী থাকা উচিত আর কী থাকা উচিত নয়, তা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।
সবারই জানা যে, আন্তর্জাতিক চালে আটকে যাচ্ছে এ শিল্প। গত কয়েক বছরে অসংখ্য টেক্সটাইল মিল (তাঁত) বন্ধ হয়ে গেছে। এখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুতা কলগুলো। প্রতিবেশী দেশ ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে বাংলাদেশে পুরো বস্ত্রখাতকে করায়ত্তে নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পিতভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে অহরহ দাবি করা হচ্ছে। তারা যেভাবে সুতা, বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাতকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, তাতে আগামীতে ভারতের একচেটিয়া ব্যবসার হাতে বাংলাদেশকে পুতুল হয়েই থাকতে হবে। ভারতীয় আগ্রাসনের ফলে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের স্পিনিং, টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত ধ্বংস হয়ে ভারতনির্ভর হয়ে পড়বে। বেশি দামে আমদানিকৃত তুলা দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে মিল মালিকরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছে। ক্রেতার অভাবে তাদের গুদামে দীর্ঘদিন ধরে জমে আছে লাখ লাখ টন সুতা। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণ ও সুদ গুণতে গিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিল। আর দেশীয় সুতা ও বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পেও পড়তে শুরু করেছে নেতিবাচক প্রভাব। এ শিল্পকে বাঁচাতে আগামী ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার স্বার্থে কর অবকাশ সুবিধা অত্যাবশ্যক । গোবালাইজেশন, সুতার মূল্যবৃদ্ধি, ইউ রুলস অব অরিজিনসহ অন্যান্য কারণে সৃষ্ট অসম প্রতিযোগিতা মোকাবিলার মাধ্যমে ওভেন উপখাতকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিকল্প নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা দরকার। এর ফলে বস্ত্রখাত উপকৃত হয়ে অর্থনীতিতে আরো অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
যেসব কারখানা পরিবেশ দূষণ করতে পারে বিশেষ করে বস্ত্রখাতের ড্রাইং-ফিনিশিং খাতের জন্য ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক। কারণ শিল্পকারখানা এসব বর্জ্য পদার্থ ও দূষিত পানি পরিবেশকে নষ্ট করে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ইটিপি স্থাপন বেশ ব্যয়বহুল, যার পরিকল্পনা ব্যয়ও অনেক। তাই ছোটখাটো শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করতে পারে না। অন্যদিকে ইটিপি স্থাপনের পর যে কেমিক্যাল প্রতিদিন ব্যবহৃত হয় এর ফলে শিল্পকারখানার জন্য উৎপাদন খরচ বাড়ে। শিল্প কারখানায় ইটিপিতে যে কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, তার আমদানি ও মূল্যসংযোজন কর যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। এই দুটি কেমিক্যালের আমদানি ও মূল্যসংযোজন কর প্রত্যাহার করলে ইটিপি স্থাপনের ব্যয় হ্রাস পাবে। তাতে ব্যবসায়ীরা ইটিপি স্থাপন ও পরিচালনা নিয়মিত করবেন। এ ক্ষেত্রে যে দুটি কেমিক্যালের অগ্রিম আয় করের বিধান রয়েছে, তা অগ্রিম আয় কর প্রত্যাহার করা উচিত। বস্ত্র খাতকে বাঁচাতে এ শিল্পের জন্য আয়কর হার ১৫ শতাংশ অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা, বিকল্প নগদ সহায়তার উপর ধার্যকৃত কর প্রত্যাহার করা, বিকল্প নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা, পুরাতন মূলধনী যন্ত্রপাতিকে পিএসআই’র (প্রাক জাহাজিকরণ পরিদর্শন) আওতার বাইরে রাখা, বস্ত্রশিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, সাইজিং ম্যাটেরিয়াল ও রং রসায়নের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা, এক্রেলিক টপসের উপর শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা, পলিয়েস্টার, স্ট্যাপল ফাইবারের এইচ এস কোড (পণ্য পরিচিতি কোড) সংশোধন করা অত্যাবশ্যক। বর্তমানে বস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সুতার মিল, সুতা ডায়িং, ফিনিশিং, কাপড় তৈরি, কাপড় ডায়িং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিংয়ের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয় কর দিচ্ছে। যদিও তৈরি পোশাকশিল্পের উৎসে আয়কর হার হচ্ছে ০.৪০ শতাংশ এবং পোলট্রি খাতে আয়কর হার ৫ শতাংশ। বিটিএমই তাদের বাজেট প্রস্তাবে অন্য শিল্পের মতো প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতেও আয় কর নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। রুগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাগিয়ে তুলতে কর অব্যাহতি প্রয়োজন।
আমরা আশা করব, বস্ত্রখাতে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব জোরেশোরে পড়ার আগেই নীতিনির্ধারকরা এ খাতকে রক্ষার পদক্ষেপ নেবেন। এর অংশ হিসেবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য কাঁচামাল আমদানির বিলম্ব মূল্য পরিশোধের সুযোগ আরও বাড়ানোসহ সরকার যৌক্তিক সকল সুবিধাদী প্রদান করবেন এটাই আমাদের কাম্য।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।