বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
গত আলোচনায় হাদিস থেকে সদাকায়ে ফিতরের আলোচনা করা হয়েছিল। এবার দেখা যাক মাজহাবের ইমামগণ উত্তম সদকা ফিতর হিসেবে কোনটিকে গ্রহণ করেছেন।
উত্তম সদকা ফিতর : ইমাম শাফেয়ীর মতে, উত্তম হলো হাদিসে বর্ণিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেয়া। অন্য সব ইমামের মতও এমনই। ইমাম মালিক রহ.-এর নিকট খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ‘আজওয়া’ খেজুর দেয়া উত্তম। আজওয়া খেজুরের ন্যূনতম মূল্য ১০০০-১২০০ টাকা প্রতি কেজি।
ইমাম আহমদ রহ.-এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। -আলমুগনী ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮।
ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। সাহাবায়ে কেরামের যুগে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক সা খেজুরের সমপরিমাণ ছিল। নবী করিম (সা.) এর যুগে মদিনায় গমের ফলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীকালে হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর যুগে ফলন বৃদ্ধি পেলেও মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে, সেকালে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক সা খেজুরের সমপরিমাণ ছিল।
হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা’ গমকে সদকা ফিতরের অন্যন্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হতো। (আলইসতিযকার : ৯/৩৫৫)। ইবনুল মুনযির বলেন, সাহাবিদের যুগে যখন গম সহজলভ্য হলো তখন তারা আধা ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ যবের সমতুল্য গণ্য করলেন। (ফাতহুল মুলহিম : ৩/১৫; আওজাযুল মাসালিক : ৬/১৩)।
তাহলে বুঝা গেল যে, হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর যুগে গম দ্বারা সদকা ফিতর আদায়ের প্রচলন বেড়েছিল। এর কারণ হলো, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যমানের খাদ্য। এ সময় হযরত ইবনে ওমর সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করতেন। তখন তাকে আবু মিজলায রাহ. বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম। অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্তু সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।
যাক আমাদের কথা ছিল, সাহাবায়ে কেরাম গম দ্বারা এজন্যই সদকা ফিতর আদায় করতেন যে, এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। হাদিসে পাঁচ প্রকারের খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সব শ্রেণির জন্য এমনকি সম্পদশালীদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে?
বড়ই আশ্চর্য! পুরো দেশের সব শ্রেণির লোক বছর বছর ধরে সর্বনি¤œ মূল্যের হিসেবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকলেই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা করে। মনে হয় সবাই ভুলেই গেছে যে, গম হচ্ছে ফিতরার ৫টি দ্রব্যের একটি (যা বর্তমানে সর্বনি¤œ মূল্যের)।
সুতরাং আমরা এদেশের ফিতরা আদায়কারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি তারা যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদিসে বর্ণিত দ্রব্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক উচ্চমূল্যের দ্রব্যটির হিসাবে ফিতরা আদায় করেন। পনির, কিশমিশ, খেজুর কোনোটির হিসাব যেন বাদ না পড়ে। ধনী শ্রেণির মুসলিম ভাইদের জন্য পনির বা কিশমিশের হিসাবে ফিতরা আদায় করা কোনো সমস্যাই নয়।
যেখানে রমজানে ইফতার পার্টির নামে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়, ঈদ শপিং করা হয় অঢেল টাকার, সেখানে কয়েক হাজার টাকার ফিতরা তো কোনো হিসাবেই পড়ে না। যদি এমনটি করা হয় তবে যেমনিভাবে পুরো হাদিসের ওপর মুসলমানদের আমল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত জিন্দা করা হবে, তেমনি এ পদ্ধতি দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক অবদান রাখবে। সর্বোপরি এই করোনার এই দুঃসময়ে মানুষ কিছু দান অতিরিক্ত পাবে। গরিব-দুঃখীগণের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে ঈদের পবিত্র দিনে।
আরেকটি আবেদন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের সম্মানিত মুফতীগণ, মাশায়েখ হযরত ও দারুল ইফতাগুলোর কাছে, তারা যেন সদকতুল ফিতরের পরিমাণ ঘোষণা দেয়ার সময় হাদিসে বর্ণিত সকল দ্রব্যের হিসাবেই পৃথক পৃথকভাবে বলে দেন এবং মানুষকে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যের ফিতরা আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।