Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদুল ফিতরের সংস্কৃতি

মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার শিক্ষা ও তাৎপর্য অপরিসীম। ঈদ মানে হচ্ছে খুশি, আনন্দ, উৎসব। ঈদুল ফিতর মুসলমানদের গৌরবময় সংস্কৃতি। শাওয়ালের প্রথম তারিখে পশ্চিমাকাশে নবচন্দ্রের উপস্থিতি ঈদুল ফিতরের আগমনী বার্তা জানান দেয়। বিশ্ব মানবতার কাণ্ডারী, মুক্তির দিশারী রাহমাতুল্লিল আলামীন কর্তৃক পবিত্র মদীনা নগরীতে উদ্ভাবিত সেই ঈদুল ফিতর আজ বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মুসলমানদের ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। তৎকালীন পরিবেশে মদীনায় প্রচলিত জাহেলিয়াতের অমানিশায় নিমজ্জিত কুরুচিপূর্ণ অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলোৎপাটন এবং সাম্য, মৈত্রী ও ভাতৃত্বের এক অনুপম আদর্শপূর্ণ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলাম। এই সংস্কৃতি দুই ঈদে প্রতিফলিত হয়েছে। হাদীস শরীফে ঈদের সূচনা ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, ‘হযরত আনাস ইবন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় শুভাগমন করলেন, তখন দেখতে পেলেন মদীনাবাসীরা দুইটি দিবসে খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব করে থাকে।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের এই দুই দিনের পরিবর্তে অন্য দুইটি উত্তম দিন দান করেছেন, তা-হলো ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। হযরত হাসান (রা.) এতে আরো বৃদ্ধি করে বর্ণনা করেন যে, ঈদুল ফিতর হলো নামাজ আদায় করা ও সাদকা করা। আর ঈদুল আজহা হলো সালাত আদায় করা ও কুরবানীর পশু জবেহ করা অর্থাৎ তোমরা কুরবানীর প্রাণী জবেহ করবে। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস: ৩৪৩৭)।

অন্য জাতির উৎসব ও মুসলমানদের আনন্দ উৎসব এক নয়:
মুসলমানদের প্রতিটি কর্ম হতে হবে ইসলামসম্মত। কুরআন সুন্নাহ কর্তৃক সমর্থিত। কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী আদর্শ ও চেতনা বিরোধী কোনো প্রকার অশ্লীল আনন্দ বিনোদন, ইসলাম অনুমোদন ও সমর্থন করে না। সুতরাং এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের শ্লোগান ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এ জাতীয় বক্তব্য ও শ্লোগান ইসলামসম্মত নয়। ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত মুসলমানদের আনন্দ উৎসব তাওহীদি চেতনায় উজ্জীবিত। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। হুব্বে রসূলের প্রেরণায় তেজোদীপ্ত।

মুসলমানদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনধারায় ঈদের মূল্যবোধ:
ঈদ মুসলমানদের আক্বিদা, বিশ্বাস ও একত্ববাদের চেতনায় হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। পবিত্রতা ও তাকওয়াভিত্তিক জীবনাদর্শের অনুসরণই মুসলমানদের মুক্তির পাথেয়। খলিফাতু রাসুলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাজিয়াল্লাহু আনহুকে নবীজি এ কারণেই বলেছিলেন, ‘হে আবু বকর, প্রত্যেক জাতির আনন্দ-উৎসবের দিন আছে আর এটা হলো আমাদের ঈদের দিন’ (বুখারী শরীফ, হাদীস : ৯৫২)।

বর্ণিত হাদীসে ইসলামী সংস্কৃতির স্বকীয়তা বিশেষত্ব ও আদর্শ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের মুসলিম সমাজ নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে পাশ্চ্যত্যের অন্ধ অনুকরণে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। আজকে মুসলিম পরিবারের শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতীরা আনন্দ বিনোদনের নামে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীলতায় ভরপুর নাটক, সিনেমা, অশ্লীল সঙ্গীত উপভোগে মত্ত হয়ে নিজেদের আদর্শিক ভিত্তি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিনিয়ত লংঘন করে যাচ্ছে।

ঈদুল ফিতর মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার উপহার:
ঈদুল ফিতর আনন্দের দিন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাধ্যমে অর্জিত তাকওয়া মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ উপহার। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদুল ফিতর পুরস্কার প্রাপ্তির দিন। (জামেউল আহাদিস, হাদীস: ৩৯২০৭)।
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে আমরা যেন এমন কোন অন্যায় অপরাধ ও গুনাহের কাজে জড়িত না হই, যা আমাদের অর্জিত তাকওয়া বিনষ্ট করে দেবে।

রমজানের আনন্দ ও ঈদের আনন্দের তুলনা হয় না:
মুমীন জীবনে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার নিমিত্তে ব্যয়িত প্রতিটি মুহূর্তই ইবাদত। দৈনিক যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, কিয়ামুল লায়ল, তাহাজ্জুদ আদায়, হালাল উপায়ে উপার্জিত রিজিক ভক্ষণ, সেহেরী, ইফতারী গ্রহণ, একাধারে বিশ রাকাত তারাবীহ আদায়, দিবারাত্রি মহাগ্রন্থ আল কুরআন তিলাওয়াতের সৌভাগ্য অর্জন, দরিদ্র, অসহায়, দুঃস্থ, মানুষের কল্যাণে সাধ্যমতো দান-সাদকা, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ ইত্যাদি কল্যাণধর্মী মহৎ কার্যাবলী সম্পাদন যেন তাকওয়াভিত্তিক জীবন গড়ার এক মাসব্যাপী ট্রেনিং কোর্স। এ প্রশিক্ষণ আত্মশুদ্ধির, এ প্রশিক্ষণ মহাআনন্দের, এ আনন্দের তুলনা হয় না। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা একে অপরের সাথে আনন্দ ভাগাভগি করে নেয়, এতে ইসলামের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ফুটে উঠে।

ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ:
ঈদকে কেন্দ্র করে মার্কেটিং করা, শপিং করা, ঈদ উপলক্ষে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করা এসব কিছু দোষের না। এতে পরিবার-পরিজন, ছেলে, সন্তানদের আনন্দ রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলায় শরীয়তসম্মত পন্থায় আনন্দ উদযাপনের জন্য আমাদের জন্য এ দুটো ঈদ দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। আনন্দ উদযাপনের নামে আমরা যেন মাত্রাতিরিক্ত, সীমালংঘন না করি, বাড়াবাড়ি না করি। আমাদের চারপাশে কতো অসহায় ক্ষুধার্ত, বঞ্চিত, দুঃস্থ, অবহেলিত মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে, চিকিৎসার অভাবে কতো বনী আদম ধুকে ধুকে মরছে, তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা লাঘবে, অভাব মোচনে, চাহিদা পূরণে আমরা কি তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি? অথচ, আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে দেশের নামী দামী মার্কেটে গিয়ে সপ্তাহব্যাপী শপিং করে খোদা প্রদত্ত নিয়ামত ও সম্পদের অপব্যয় ও অপচয় করে যাচ্ছি সিয়াম সাধনার সংযমের মাসে। এ আচরণ কি ইসলামী শরীয়ত সমর্থন করে? রমজান ও ঈদকে কেন্দ্রকে এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্যে বাড়িয়ে দিয়ে এক মাসেই যেন সারা বছরের মুনাফা তুলে নেন। বড় বড় শপিংমলগুলোতে মাসব্যাপী অপ্রয়োজনীয় লাইটিং করে জাতীয় সম্পদ বিদ্যুতের যে অপচয় করা হচ্ছে তা দেখে দেশকে কেউ গরিব দেশ বলে ধারণাও করতে পারবে না।

ঈদের রাতের ফজিলত:
মুসলিম নরনারীর জন্য ঈদের রজনীর গুরুত্ব অপরিসীম। ঈমানদার বান্দাগণ, এ রজনীকে স্বীয় প্রভূর ক্ষমা লাভের প্রত্যয়ে ইবাদত বন্দেগী, জিকির, আজকার, ও নবীজির উপর অধিক হারে দরুদ শরীফ পাঠ ও নফল ইবাদতে নিয়োজিত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রত হন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত উবাদা ইবন সামিত রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রজনীতে রাত জেগে ইবাদত করবে তার অন্তর সেদিন মরবে না, যেদিন অন্তরসমূহ মরে যাবে। (তাবরানী, হাদীস: ১৫৯, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ৪র্থ, পৃ: ১০৫)
ঈদের নামাজ সম্পর্কে জ্ঞাতব্য:

১. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজ ওয়াজিব। ঈদের নামাযে আজান ও ইকামত নেই। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৭৭৯)।
২. জুমার জন্য খুত্বা শর্ত, ঈদের জন্য খুত্বা সুন্নাত। জুমার খুত্বা নামাজের আগে, ঈদের খুত্বা নামাজের পরে। (দুররে মোখতার, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৬০)।

৩. ঈদের নামাজের সময় সূর্যোদয়ের ২০/২৫ মিনিট পর থেকে শরয়ীভাবে অর্ধদিন পর্যন্ত। ঈদুল ফিতর একটু দেরীতে ঈদুল আজহার নামাজ তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব। (দুররুল মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃ: ৬০)।

গুনাহমুক্ত দিনই ঈদ:
ঈদ মানে আনন্দ, মুমিনের প্রকৃত আনন্দ-অনূভূতি প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাজিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন, ১. যেদিন মুমীনের জীবন গুনাহ থেকে মুক্ত হবে সেদিনটি হবে তাঁর জন্য ঈদের দিন।
২. মু’মীন যেদিন ঈমান সহকারে মৃত্যু বরণ করবে, সেদিন হবে তাঁর প্রকৃত ঈদের দিন। (ফকীহ আবুল লাইস, আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ১০২)।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়:
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের প্রাচীনতম ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাহাবাগণ ঈদের দিন পারস্পরিক সাক্ষাতে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’, আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঈদুল ফিতরের সংস্কৃতি
আরও পড়ুন