Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাণ হারাচ্ছে চলনবিল

সৈয়দ শামীম শিরাজী, সিরাজগঞ্জ থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০১ এএম

আগের সেই চলনবিল এখন আর তেমন অবস্থায় নেই। ক্রমেই এর আয়তনসহ সকল সুবিধা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। মাছের গুতোয় যে চলনবিলে নৌকা চলতে পারত না, সেই চলন বিল এখন মাছ শূন্য হতে চলেছে। সেই সাথে শস্য ভান্ডার নামের সেই পরিচিত শস্য উৎপাদনে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে পানি শূন্যতার কারণে। ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যহত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন চলনবিল তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
ইম্পিরিয়াল গেজটিয়ার অব ইন্ডিয়ার তথ্যে, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল বা ১ হাজার ৪২৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে এই আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। হিসাব অনুযায়ী, ৮২ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ৪০৮ বর্গমাইল। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বর্তমানে চলনবিলের আয়তন ১৬৮ বর্গকিলোমিটার। এই হিসাবে ১৯০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ১১২ বছরে চলনবিলের আয়তন কমেছে ১৯৯ বর্গকিলোমিটার। প্রতিবছর গড়ে বিলের আয়তন কমছে ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
চলনবিলে পানিপ্রবাহের প্রধান উৎস হচ্ছে বড়াল নদ, গুমানী ও আত্রাই। পদ্মা-যমুনার পানি এ তিন নদ-নদীর মাধ্যমেই বিলে প্রবেশ করে। ১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রথম এই পানি কমতে থাকে। ১৯৮৫ সালে বড়াল নদের উৎসমুখ রাজশাহীর চারঘাটে স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে বড়াল নদ পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় থেকে চলনবিলও পানিশূন্য হতে শুরু করে।
কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পানাসি প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, চলনবিলের পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ অংশে ২১টি নদ-নদীর অধিকাংশই এখন ভরাটের দিকে। বর্তমানে বড়াল নদ মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিলে ৭১টি খাল ও নালা রয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৪১০ কিলোমিটার। প্রায় ৬৬২৪০ জন কৃষক এসব খাল ও নালা থেকে সেচের পানি পেতেন। বর্তমানে ৩৬৮ কিলোমিটার পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। যা মোট নালা ও খালের ৯০.২৪ শতাংশ। বাকি ৪২ কিলোমিটার নালা ও খাল পুনরায় খনন করে নাব্যতা ফেরানোর কাজ চলছে। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, চলনবিলে ১৯৮২ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এরপর ১৯৮৭ সালে ২৪ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন, ১৯৯২ সালে ১৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন, ১৯৯৭ সালে ১৫ হাজার ৪২১ মেট্রিক টন, ২০০২ সালে ১২ হাজার ৪৬০ মেট্রিক টন এবং ২০০৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। এই হিসাবে ২৫ বছরে চলনবিলে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ। গড় উৎপাদন কমেছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রতিবছর উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ।
মার্চ ও এপ্রিলে কয়েক দফা চলনবিল ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল জলরাশির চলনবিল এখন পানিশূন্য। চলছে ফসলের আবাদ। বিলের চাটমোহর অংশে বড়াল নদে পানি নেই। কচুরিপানা ও ময়লা আবর্জনায় ঠাসা। উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের হান্ডিয়াল বোথর মাঠ। পানির জন্য হা-হুতাশ কৃষকের। মাঠের পর মাঠ আবাদ হয়েছে বোরো ধান। চলছে সেচের পানির সঙ্কট। পানি পেতে ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে বসানো হয়েছে সেচযন্ত্র। তবু যেন পানি মিলছে না।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুম বিলাহ বলেন, একদিকে ভূ-উপরিস্থ পানি না থাকা, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণেই পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সঙ্কট মোকাবেলায় আপাতত মাটি খুঁড়ে কিছুটা নিচে সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে কৃষককে বোরো আবাদে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে।
চলনবিল নিয়ে গবেষণা করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚গোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম। তিনি জানান, চলনবিল এলাকার তিনটি আবহাওয়া কেন্দ্রের ১০০ বছরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিলের আবহাওয়া প্রতিবছর বিরূপভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিক‚লতার কারণে আবহাওয়ার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রতিবছর গড় বৃষ্টিপাত কমছে, বাড়ছে তাপমাত্রা। এতে একদিকে পানিতে অক্সিজেন কমে মাছের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে বাতাসে আদ্রতা বেড়ে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চলনবিল

১১ জানুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ