পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাকালে যারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে তাদের মধ্যে আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রমজানে ঘোষিত দীর্ঘ লকডাউনে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এখন হেফাজতের নামে চলছে পুলিশের উড়োতাড়া ও ধরপাকড়। রমজান এবাদতের মাস হলেও কওমী ধারার আলেম-ওলামার অধিকাংশের পক্ষে শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে এবাদত-বন্দেগী করা সম্ভবপর হচ্ছে না। গ্রেফতার আতংকে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। অনেককেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পবিত্র মাহে রমজানে মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন, মাদরাসার শিক্ষকদের এই আতঙ্ক ও দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা কেউ কখনো কল্পনা করতে পারেনি। ওদিকে কওমী ও নূরানী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ অসহায় ও নিরালম্ব হয়ে পড়েছে। তাদের বেশির ভাগ লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থেকে লেখাপড়া করে। মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ লিল্লাহ বোর্ডিংও চলছে না অর্থাভাবে। কওমী ধারার মাদরাসাগুলো দানশীল ব্যক্তিদের দানে চলে। সে দানও এখন বন্ধ। সরকার এসব মাদরাসায় কোনো সহায়তা প্রদান করে না। কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে গরীব, সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ছেলেমেয়ে ও এতিমরাই প্রধান। এরা ফ্রি বা অত্যন্ত স্বল্প বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ পায়। অধিকাংশের থাকা-খাওয়া চলে লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে। এরা অনেকে রমজানে পবিত্র কোরআন ও তারাবীর নামাজ পড়িয়ে কিছু আয়-রোজগার করার সুযোগ পায়। মাদরাসাগুলোও এ সময় জনসাধারণের দান-সাদগা-জাকাত-ফিররা ইত্যাদি পায়। অনুরূপভাবে ঈদুল আযহায় দান ছাড়াও কোরবানীর পশুর চামড়া পেয়ে থাকে। এভাবেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় অর্থের সিংহভাগ সংগৃহীত হয়। করোনাকারণে লকডাউন এবং হেফজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন ও কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এমন একটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে যা, অতীতে কখনোই হতে দেখা যায়নি।
করোনার দ্বিতীয় অভিঘাতের মধ্যেই এবার এসেছে মাহে রমজান। হেফাজতের বিরুদ্ধে পুলিশী অ্যাকশনও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে হেফাজতের অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অনেকের নাম গ্রেফতারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। তাদের পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হতে হচ্ছে। হেফাজত ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বরাতে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। এসব কথা কতটা সত্য, কতটাই বা গালগল্প, কারো পক্ষেই এখন তা সাবুদ করা সম্ভব নয়। পুলিশ-গোয়েন্দারা আসামী ধরে অনেক কথা-কাহিনীই বর্ণনা করে। কিন্তু আখেরে এসব কথাকাহিনীর বেশিরভাগই টেকে না। হেফাজত নেতাদের কারো কারো সঙ্গে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের জঙ্গীদের সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকার এমনো খবর প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে যে, হেফাজতের কর্তৃত্ব নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জেহাদের হাতে চলে গেছে। সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে হেফাজত কাজ করছে, এমন কথাও বলা হচ্ছে। হেফাজতের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সম্পর্কের অভিযোগ তো বহু পুরানো। যাদের পক্ষ থেকে ও বরাত দিয়ে এসব অভিযোগ ও দায়ী করা হচ্ছে, জনগণকে তা তথ্য প্রমাণসহ জানানো তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মনে রাখতে হবে, উদ্দেশ্যমূলক তথ্য-বক্তব্য কিংবা আষাঢ়ে গল্প হীতে বিপরীত ফলই দিয়ে থাকে। আমাদের পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সম্পর্কে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন-একটি অভিযোগ হলো, তাদের ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। ‘আল ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’ কিংবা ক্ষমতার অন্যায় ব্যবহারের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে আছে। তাদের এহেন আচরণ ও কর্মের জন্য শেষ পর্যন্ত দায় সরকারের ঘাড়ে গিয়েই পড়ে। পর্যবেক্ষকদের মতে, হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে ইসলামী রাজনৈতিকগুলোর বিরুদ্ধেই মূলত অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের আরো অভিমত, ইসলামী রাজনীতি ও ওয়াজ-নসিহত নিরুৎসাহিত করা এবং বিশেষভাবে ইসলামী শিক্ষাসহ মাদরাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার দূরভিসন্ধিও এর পেছনে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। ইসলাম থেকে, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে মানুষকে দূরে রাখা ও বঞ্চিত করার মাধ্যমে জাতির মৌলিক সত্তা ও শক্তি খর্ব করার অপপ্রয়াস দেশে অনেকদিন ধরে চলছে। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আবশ্যক ইসলামিক শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছে কৌশলে। মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধেও চলছে নানা চক্রান্ত। কেনা জানে, ইসলাম আমাদের জাতিসত্তার অপরিহার্য উপাদান। ইসলাম ও তার কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মানুষ কখনো, কোনো কারণে সরে গেলে দেশের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা থাকবে না, তার প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে। যখন ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামী শিক্ষা ও মাদরাসার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলে তখন সঙ্গতকারণেই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। পুলিশ আজ যে অবস্থা তৈরি করেছে তাতে গোটা জাতি বিচলিত। আলেম-ওলামা ও মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনরা দৌড়ের ওপর আছে। কওমী-মাদরাসার শিক্ষার্থীরা পড়েছে গভীর সংকটে। এ অবস্থার দায় কে নেবে? অনেকদিন ধরে লাগাতার বলা হয়েছে, জঙ্গীবাদের উৎস মাদরাসা। কিন্তু বাস্তবে তা প্রমাণিত হয়নি। দেশে কওমী, আলিয়া, হাফেজী, নুরানী ইত্যাদি মাদরাসা আছে হাজার হাজার। সেখানে লাখে লাখে শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসকে তারা মনে প্রাণে ঘৃণা করে। মাদরাসা আদর্শ নাগরিক তৈরির একটা বড় ক্ষেত্র, এটা প্রমাণিত। দেশে যে কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে মাদরাসা শিক্ষার্থী নেই। এটা কী প্রমাণ করে? দেশে মাদরাসা শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে আলেম-ওলামার। একথা রাজনীতি যারা করেন, পুলিশে কিংবা প্রশাসনে যারা আছেন, যারা নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের উপলব্ধি করতে হবে। কী কারণে জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদ ও সৃষ্টি হয় তা কারো অজানা নয়। অন্যায়-অত্যাচর, দমন-পীড়ন, জুলুম-নির্যাতন এবং আবদ্ধকর পরিস্থিতি জঙ্গীবাদ সৃষ্টিতে প্ররোচণা জোগায়। এখন যা বলা হচ্ছে, তা ব্যাকফায়ার হতে পারে, এ কথা তাদের স্মরণে রাখতে হবে। সরকারের শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে পরিস্থিতি উত্তরণে অবিলম্বে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, এটা আমরা আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।