Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বাসায় স্ত্রীকে হত্যার পর সড়ক দুর্ঘটনার নাটক

শিল্পপতির ছেলে ঘাতক স্বামীসহ আটক ২ গুলশান থেকে মৃত অবস্থায়ই ঝিলিককে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল : ওসি হাতিরঝিল

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রথমে হত্যা, এরপর দুর্ঘটনার নাটক। যা হার মানাবে নাটক-সিনেমার গল্পকেও। এমনিভাবে স্ত্রী খুনের অভিযোগে রাজধানীতে আটক করা হয়েছে স্বামীকে। এখন পর্যন্ত পাওয়া আলামত ও সাক্ষীদের বক্তব্যেও মিলেছে একই তথ্য। এ ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার ঝিলিক আলম (২৩) নামের ওই নারীর স্বামী সাকিব আলম মিশু ও তার বাসার নিরাপত্তাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে একে হত্যাকান্ড মনে করছেন তারা। তদন্ত চলছে।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের গুলশান ৩৬ নম্বর রোডের বাসার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, শনিবার সকাল ৯টায় দোতলা থেকে চাদরে মোড়া গৃহবধূ ঝিলিকের লাশ নামাচ্ছেন দুই গৃহকর্মী ও বাসার কেয়ারটেকার। পরে তোলা হয় প্রাইভেটকারে। এর কিছুক্ষণ পরই হাতিরঝিলে ওই প্রাইভেটকারটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। তখন আহত অবস্থায় স্বামী সাকিব আলম জানিয়েছিলেন, নিজের গাড়ি চালিয়ে অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তবে, ঢাকা মেডিক্যালে নেয়ার পর চিকিৎসক জানান, দুর্ঘটনায় নয় শুক্রবার রাতেই মারা গিয়েছিলেন ঝিলিক। এতে আটক করা হয় স্বামীকে।

বাসার ম্যানেজার পুলিশকে জানান, সকালে যখন ঝিলিককে নামানো হয় তখন তাকে নড়াচড়া করতে দেখেনি তিনি।
নিহত ঝিলিকের দেবর ফাহিম হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, ঝিলিকের বাসাতেই মৃত্যু হয়েছে। তবে ভাই কেন দুর্ঘটনার কথা বলেছেন, তা তার জানা নেই। তাদের মধ্যে প্রায় সময় ঝগড়া হতো।
হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মহিউদ্দিন বলেন, সকাল ৯ টার দিকে হাতিরঝিলের আমবাগান এলাকায় একটি প্রাইভেটকার দুর্ঘটনার খবর পান। সেখানে গিয়ে আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগা একটি প্রাইভেট কার থেকে একজন পুরুষ ও একজন নারীকে উদ্ধার করা হয়। দু’জনকেই হাসপাতালে নেয়ার পর বেলা ১১ টার দিকে ঝিলিককে মৃত ঘোষণা করা হয়। গাড়িটি মিশু নিজেই চালাচ্ছিল। পরে মিশুকে আটক করা হয়। আটক মিশু পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন এবং তিনিও আহত হন। পরে ঝিলিককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর তিনি ওই হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।

নিহত ঝিলিকের মা তাহমিনা হোসেন আসমা বলেন, ঝিলিক ও মিশু ভালোবেসে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিয়ে করেন। মিশুদের আর্থিক অবস্থা ভালো। তার তুলনায় ঝিলিকের পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা কম। মিশু বাপের টাকায় চলত। সে মাদকাসক্ত ও বাসায় বেকার জীবন যাপন করত। বাসায় খাওয়া পরা নিয়ে ঝিলিককে প্রায়শই খোঁটা দিত এবং নানাভাবে নির্যাতন ও মারধর করত। ঝিলিকের মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যা উল্লেখ করে বাসায় স্বামীসহ আত্মীয়রা সবাই ছিলেন। এই অবস্থায় শুক্রবার রাতে ঝিলিককে মারধর করে হত্যা করে দুর্ঘনার নাটক সাজানো হয়েছে।

ঝিলিকের মামী ইসমিতা ইসলাম বলেন, ঝিলের শ্বশুরু জাহাঙ্গীর আলম পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি একজন শিল্পপতি। গুলশানে তার কয়েকটি বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাসায় শ্বশুর, শাশুড়ি ছাড়াও ঝিলিকের একজন ননদ ও দেবর রয়েছে। এছাড়া বাসায় বেশ কয়েকজন কাজের লোকও আছে।
ইসমিতা বিষয়টিকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড উল্লেখ করে বলেন, গরিবের মেয়ে হওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঝিলিককে মেনে নিতে পারেনি। বাসায় নির্যাতন করে তাকে হত্যার পর ইংরেজি ছবির শুটিংয়ের মতো হাতিরঝিলে নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার নাকট সাজিয়েছে।
ইসমিতা আরো বলেন, ঝিলিকের শ্বশুর বাড়ির লোকজন দুপুর ১২টা ১টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। তারা বলেছে সকালে ঝিলিককে নিয়ে বেড়াতে গেছে। বাসায় ৮ মাসের দুধের বাচ্চা রেখে নাইট ড্রেস পরে কেউ সকাল ৯টার দিকে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হবে কথাটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঝিলিককে উদ্ধারের সময় তার পরনে ছিল শুধু ম্যাক্সি। একজন শিল্পপতির ছেলের বউ সকালে শুধু ম্যাক্সি পরে দুধের বাচ্চা বাসায় রেখে ঘুরতে বের হবে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ঝিলিকের ছোট ভাই জাবির হোসেন বলেন, দুই দিন ধরে ঝিলিকের কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তার স্বামী বা অন্য আত্মীয়রাও ফোন ধরছিল না। শনিবার সকালে ঝিলিকের স্বামী ঝিলিকের মা আসমা বেগমকে ফোন দিয়ে তাদের জানায় ঝিলিক মারা গেছে। এইটুকু বলেই ফোন রেখে দেয় সাকিব। এরপর কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরেও তার কোনো খোঁজ পাইনি। পরে আমরা ৯৯৯-এ কল দিয়ে বিষয়টি জানাই। ৯৯৯ এ ফোন দেয়ার পর গুলশান থানা পুলিশ ঝিলিকের শ্বশুরের বাসায় যায়। তখন সাকিবের পরিবারের লোকজন জানায় ঝিলিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
জাবের আরো বলেন, সাকিবের পরিবার শিল্প পতি হওয়ায় সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। সপ্তাহখানেক আগে সাকিব পায়ের চিকিৎসা করানোর কথা বলে ভারত যায়। সেখান থেকে দেশে আসার পর ঝিলিক ও সাকিবের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। গত ২ দিন ধরে ফোন দিয়েও ঝিলিককে পাচ্ছিলাম না আমরা কেউ।

ঝিলিকের শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম শিল্পপতি এটা জানেন কিন্তু তার গ্রুপের নাম কি সেটা জানাতে পারেননি জাবের। আরমান আলম সাজিদ নামে ঝিলের ৮ মাস বয়সী একটি ছেলে আছে। ঝিলিকের বাবার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ লৌহজং উপজেলায়। অনেক আগে থেকেই তারা রাজধানীর মোহাম্মদপুর নুরজাহান রোডের বাসায় থাকেন। ঝিলিকের বাবা আনোয়ার হোসেন গত বছর এপ্রিল মাসে মারা যান। তার মা তাহমিনা হোসেন আসমা গৃহিনী। ৩ ভাই ১ বোনের মধ্যে ঝিলিক তৃতীয়। তিনি মোহাম্মদপুর গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকের বরাত দিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, ওই নারীর পা, মাথা ও গলায় আঘাতের চিহ্ন আছে। বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হলে যে ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, এখানেও সে ধরনের লক্ষণ রয়েছে।

গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম জানান, আমরা তার বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছি। স্বামীসহ দু’জনকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ আটক করেছে। নিহতের লাশের ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। নিহতের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম রয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। এছাড়া আটক দু’জনকে গুলশান থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও তিনি জানান।

তবে হাতিরঝিল থানার ওসি আবুল হোসেন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক মিশু স্বীকার করেছে বাসায় থাকতেই তার স্ত্রী ঝিলিকের মৃত্যু হয়েছে। গুলশান থেকে মৃত অবস্থায়ই ঝিলিককে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। যেহেতু ঘটনাস্থল গুলশান থানায় তাই আসামিদের ওই থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবে মামলা তদন্তের স্বার্থে।
হাতিরঝিল থানার এসআই গোলাম কুদ্দুস জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। গিয়ে দেখি হাতিরঝিল আমবাগান মুল সড়কে একটি প্রাইভেটকার আইল্যান্ডের উপড়ে উঠে আছে। গাড়ির পেছনের সিটে এক নারীকে শায়িত অবস্থায় পাই। পরে দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক নারীকে মৃত ঘোষণা করেন।
এসআই আরো জানান, তারা দু’জন স্বামী স্ত্রী। স্বামী সাকিব আলমের বাম হাতে আঘাত লেগেছে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তবে নিহত নারীর সড়ক দুর্ঘটনার কোনো আঘাত পাওয়া যায়নি। তাকে আগেই হত্যা করা হয়েছে বলে আমার ধারণা বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।



 

Show all comments
  • Farhana Yasmin ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৬ এএম says : 0
    কত বড় অমানুষ!!! সত্য জাগ্রত হয় একদিন না একদিন তাই নাটক করেও সত্য চাঁপা রাখতে পারেনি। কঠোর শাস্তি হোক অমানুষটার।
    Total Reply(0) Reply
  • ShArMiN HaSsaN PaKHi ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    এগুলো মানুষরুপি অমানুষের দ্বারাই সম্ভব এদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Kazi Robiul ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    হায়রে মানবতা ..... এই জাতির উদয় বুদ্ধি কখন হবে,, আল্লাহ ভালো জানেন
    Total Reply(0) Reply
  • Shahin Reza Mithu ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    ক্রাইম পেট্রোল দেখে শিখছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Hasan ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    পি বি আই কে দায়িত্ব দেওয়া হক
    Total Reply(0) Reply
  • Emran Hossen Kaber ৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
    তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ দুলাল মিয়া ৪ এপ্রিল, ২০২১, ৫:০০ এএম says : 0
    শিল্পপতি আমি সব সময় এই দরনে ঘটনা দেখি।কিন্তু বিচার হয়েছে কখনে দেখি নাই।..........
    Total Reply(0) Reply
  • Towhid ৪ এপ্রিল, ২০২১, ৭:৪৩ এএম says : 0
    This husband should be executed without any trial. He is already addicted to drugs and this addiction habit is inducing smuggling drugs into the country and local communities. So he should be accountable for drugs possession and murdering his wife. His parents also should be brought into justice for not raising the son properly. Husband and his family should have known that her family is not rich like him and should not have marrying her if he desired money. Whole family should be brought to justice without their financial pressures to the judicial and investigative system. He definitely deserves death sentence
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ