পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনের যোগ্যতা অর্জন করেছে। খবরটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচকের মানদন্ডে জাতিসংঘ একটি দেশের উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভূক্ত হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারন করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে মাথাপিছু আয় হতে হয় ১২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। উন্নয়নশীল হতে হলে মানব সম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ৭৫.৩ পয়েন্ট অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে কোন দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে এলডিসি এবং ৩২ এ আসলে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৫ দশমিক ২। বাংলাদেশ উক্ত তিন সূচকেই কাংখিত যোগ্যতা অর্জন করেছে। কোভিড-১৯ মহামারীর বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা, মানব সম্পদ ও মাথাপিছু আয় সূচকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছে। তবে সার্বিকভাবে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ও বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে বলা যায়, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন সূচকে আমাদের অগ্রগতি হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেমন, মানুষের জীবন যাত্রার মান, বেকারত্ব, দূর্নীতি, সুশাসনের অভাব উৎপাদনের কাঁচা মালের সহজ লভ্যতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে নানা ঘাটতি রয়েছে। অর্থনৈতিক ভিতকে আরো মজবুতির জন্য বাংলাদেশ সিডিপির কাছে সময় চেয়েছে সিডিপি তা মূল্যায়ন করে আরও ২ বছর বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের ৪৭ টি দেশ স্বল্পন্নোত দেশের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত। এই সব দেশে ৮৮ কোটি মানুষের বাস। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে সেই তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ এ তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। এলডিসি ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে সবদিক থেকে ভাল অবস্থানে আছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুপারিশ আমাদের জন্য নিঃসন্দেহ বড় অর্জন। তবে এর ফলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মূখীন হতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হলে এলডিসি হিসাবে যে সব বানিজ্য সুবিধা বাংলাদেশ পায় তা পাবে না। যেমন, আন্তর্জাতিক বানিজ্যে সুল্ক সুবিধা হারাবে, ঔষুধ শিল্পের মেধা স্বত্তে¡র আন্তর্জাতিক আইন কানুনে অব্যাহতি ও থাকবে না, কৃষিতে ভূর্তকি সুবিধা কমাতে হবে। ঋণের সুদের হার বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতার উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। উন্নয়শীল দেশ হলে আমরা বেশ কিছু সুবিধা পাবো। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা জোটগুলোতে বাংলাদেশের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়বে, ভাবমূতি ভালো হওয়ার কারনে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুুবিধা হবে। দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করা হবে। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা মূল্যায়ন পাবো, দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে, বড় বাজার সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। করোনা মহামারির মাঝে ও আমাদের অর্থনীতির স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পিছনে বড় আবদান রয়েছে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের আয় ও কৃষি। এছাড়া পোশাক শিল্প আমাদের রপ্তানী বানিজ্যে বড় অবদান রেখে যাচ্ছে। এখন আমাদের উৎপাদনশীলতায় সক্ষমতা বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। সরকার এ বছর (২০২১-২০২৫) যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাকেও এলডিসি থেকে উত্তরনের কৌশল হিসাবে জোরালো ভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের আমদানি রপ্তানী ব্যয় কমানো ক্ষেত্রে পরিবহন, বন্দর ও আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি জোর দেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। দেশীয় শিল্পে উন্নয়ন ও বিকাশ লাভের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো ও কার্যকরী কৌশল বহন করা উচিত। সিএমএসএমই বিনিয়োগ বাড়ানো ও এখাতের কাঠামোভাবে উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চীন, জাপান, ভারতসহ অন্যান্য দেশের সাথে দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ক আরোও জোরদার করা উচিত। আমাদের রপ্তানী ক্ষেত্রে শুধু গার্মেন্ট শিল্পের উপর নির্ভর না হয়ে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানী, রপ্তানীমূখী পণ্যসমূহের উৎপাদন ও গুনগতমান উন্নয়নের প্রতি জোর দেওয়া উচিত। ঔষুধ শিল্পের কাঁচামালে আমদানী নির্ভরশীলতা কিভাবে কমানো যায় সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। আমাদের পাট শিল্প, চামড়া শিল্প সহ চিংড়ি উৎপাদন, কৃষি পণ্যকে প্রক্রিয়াজাত করনের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে থাকতে না পারলে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার বিষয়টি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো সমস্যা এখনও প্রকট। জালানী ও অবকাঠামোগত ঘাটতি দূর করা উচিত। একটি দেশের শুধু জিডিপি দেখেই সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা যায় না। জিডিপি বেশি হলেও টেকসই উন্নয়ন দূর্বল হতে পারে। মাথাপিছু আয় বেশি হলেও সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জীবনমান নি¤œ হতে পারে। যে সমাজে বৈষম্য বেশি থাকে সেখানে এসব সমস্যায় পড়তে হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এটা অস্বীকার করার জো নেই। বৈষম্য বেশি হলে গড় আয়ের হিসাব বরং বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। তাই ভারসাম্য ও কল্যানমুখী অর্থনীতির জন্য বৈষম্য অবশ্যই কমাতে হবে। দূর্নীতি ও অপচয়ের কারনে প্রকল্প সমূহের ব্যয় বাড়ে। সু-শাসনের অভাব, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে দূর্নীতির জন্ম হয়। তাই টেকসই উন্নয়ন ও উন্নত জীবনমানের জন্য এসব ক্ষেত্রে সংস্কারের বিকল্প নেই। বিগত ৫০ বছরের বাংলাদেশ অনেক চড়ায় উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন প্রশংশনীয়। আমাদের কৃষক, শ্রমিক এমনকি প্রবাসী শ্রমিকেরা ও অনেক পরিশ্রমী। অথচ শ্রমজীবি মানুষের আয় ও জীবনের নিরাপত্তা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত। উন্নয়নের প্রচারনায় আমরা তাদের কথা ভুলে যাই। এখন আমাদের এ সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।