পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৮ দিনের মাথায় ১৮ জানুয়ারি তাঁর সঙ্গে গুলশান কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আলহাজ¦ মাওলানা আবদুস সালাম ও কাপাসিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ওয়ারেছ আলীর সাক্ষাৎ ঘটে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে বঙ্গভবনে এ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো ভাবছে, বঙ্গবন্ধুর সরকার মাদরাসা শিক্ষার পক্ষে নয়। কিন্তু আমি তো মুসলমানের ছেলে। মাদরাসা শিক্ষা কি বলছেন, আমি স্কুল কলেজেও কোরআন হাদিসের শিক্ষাক্রম চালু করবো। তবে ইসলাম নিয়ে যারা বণিজ্য করেছে তাদেরকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেবো না।’ তিনি বলেন, ‘আপনাদের ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মদ, জুয়া, রেস-এর মতো অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কাজকেও আইন করে হালাল করে দিয়েছিলো। দেখবেন, সহসাই আমি এসব বাতিল করে দেবো। আমার ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও কী করে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, বসে বসে শুধু দেখবেন।’ অতঃপর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে অবিলম্বে মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার এবং পাকিস্তান আমলে শিক্ষকগণ যেভাবে যা পেতো (সরকারি অনুদানসমূহ) সেভাবেই তাদের সকল পাওনা পরিশোধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি অন্যায়ভাবে কোনো আলেমের প্রতি যাতে কোনো অবিচার না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখার কথাও বলেন।
গুলশান মসজিদের খতিব ও পরবর্তীতে ‘মসজিদে গাউসুল আজম’ মসজিদের খতিব এবং ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’ এর সিনিয়র সহসভাপতি (মরহুম) আলহাজ¦ মাওলনা আবদুস সালাম তার স্মৃতি থেকে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃত বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘আপনাদের ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান তো মুখে শুধু ইসলাম ইসলাম করেই গেলো- আর আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদশে আইন করে আমি মদ, জুয়া ও রেস খেলা বন্ধ করে দিলাম। এই রেস খেলে হাজার হাজার গরিব নিঃশেষ হয়ে গেছে। বলেন, কাজটা কি ভালো করলাম না খারাপ করলাম।’ আরেকবার তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বললেন, ‘শুনেছেন তো বোধ হয়, আমার ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আমি অর্ডিন্যান্স করে অটোনোমাস করে দিয়েছি।’ তারপর মাদরাসার খোঁজ-খবর নিতেন, ‘মাদরাসা চলছে তো ঠিক মতো?’ ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে গৃহীত এ সাক্ষাৎকারটি বঙ্গবন্ধুর ইসলাম প্রীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতা শিরোনামে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’ গ্রন্থের ২৫২ ও ২৫৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।
প্রবন্ধকার সেলিম রেজা তাঁর এ রচনায় বঙ্গবন্ধুর ইসলাম প্রীতির বিবরণ নানা আঙ্গিকে প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে প্রবীণ জননেতা (মরহুম) মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের ভ‚মিকাও তুলে ধরা হয়েছে। রচনার এক পর্যায়ে মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ পরিষদের মুখপত্র ‘মহানাগরিক’-এর ৪র্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় একটি নিবন্ধ থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার লেখক বর্তমান লেখক। ওই লেখায় বলা হয়েছে,
‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু তাতে মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোনো কথা না থাকায় বিভ্রান্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ মাদরাসা শিক্ষা পুনর্জীবিত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং সরকারের সহযোগিতায় শিক্ষা কমিশনের একটি ইসলামী শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি গঠিত হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় ইসলামী শিক্ষা সংস্কার সংস্থা। এই কমিটির চেয়ারম্যান হন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় আলাউদ্দীন আল আজহারীকে। এই কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. মুহাম্মদ ইসহাক, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, আহমদ হোসাইন, আকবার আলী, শামসুল আলম, মাওলানা বেলায়েত হোসাইন, মওলানা এম জালাল উদ্দীন ও চট্টগ্রামের মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। এই কমিটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশমালা গৃহীত হয়। এভাবে মাদরাসা শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অভিন্ন অঙ্গ রূপে পরিগণিত হয়।’
বর্ণিত দীর্ঘ উদ্ধৃতাংশের আলোকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও ধর্মীয় ভাবধারা বিশ্লেষণযোগ্য। বিষয়টি নিম্নরূপে বিশ্লেষণ করা যায়।
১। মুসলিম সাধক প্রচারকের অধঃস্তন বংশের কৃতি সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। এ পর্যায়ে প্রথমেই বলা দরকার, ইসলামের অন্যতম ভিত্তি (রোকন) হজের প্রতি তার ভক্তি বিশ^াস থাকায় এ দেশের মুসলমানদের হজ আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকে তিনি মেনে নিতে পারেনি। ঘটনাটি ছিল এই যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ স্বাধীন দেশের মুসলমানগণ স্বাধীনসত্তা নিয়ে ক‚টনৈতিক ও আইনগত সংকটে পতিত হয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত সউদী সরকার এদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় এ দেশের হজ গমনেচ্ছুগণ আইনগত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত প্রভাবে সউদী সরকারের বিশেষ অনুমোদন পাওয়া যায় এবং হজ প্রতিনিধি দল মক্কায় গমন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হজ প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ।
২। মক্কা ও মদীনায় এ হজ প্রতিনিধি দল অনুক‚ল সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। নতুন স্বাধীন দেশের হজ যাত্রী হিসেবে সারা মুসলিম বিশ্বের হজ যাত্রীগণের সাধুবাদ ও মর্যাদা লাভ করেন এবং পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মহল কর্তৃক অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির ফলে বাংলাদেশ এবং এ এদেশের মুসলমানদের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝির অনেকটা অবসান ঘটে এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও অনেকের ধারণার পরিবর্তন ঘটে।
৩। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হজ প্রতিনিধিদলের নেতা মাওলানা তর্কবাগীশ এই ধারণা নিয়ে আসেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব শ্রোতার জন্য আরবিতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান রেডিও’র মাধ্যমে প্রচার করা হলে সেখানে তার অনুক‚ল প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। হজ হতে প্রত্যাবর্তন করে মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুকে এ পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু তা বাস্তবায়নের জরুরি নির্দেশ দান করেন। রেডিও বাংলাদেশের বহির্বিশ^ কার্যক্রম প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু চালু করেন এবং আরবি অনুষ্ঠানটি তারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ১৯৭৩ সালের অক্টোবর হতে এখন পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চালু রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব শ্রোতাদের কাছে বাংলাদেশের পরিচিতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে এর ভ‚মিকা অনন্য।
৪। বঙ্গবন্ধু ওআইসি (ইসলামী সম্মেলন সংস্থা)’র শীর্ষ সম্মেলন যোগদান করেন এবং বাংলাদেশকে এই সংস্থার সদস্যভুক্ত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার পরিচায়ক। ফলে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার-প্রচারণার সকল চক্রান্ত বাঞ্চাল হয়ে যায় এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মুসলিম দুনিয়াসহ বিশে^ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ক‚টনৈতিক স্বীকৃতি লাভের সাথে সাথে ঢাকায় বহু মুসলিম রাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপতি হয়ে যায়।
৫। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু জাতীয়ভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার, প্রকাশনা ও গবেষণা চর্চার এক নব দিগন্তের সূচনা করেন। এটি বর্তমানে মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম ইসলামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপই সক্রিয় ছিল। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা সমগ্র দেশের সকল জেলায় চালু হয়েছে। অনুবাদ, রচনা, প্রকাশনা, গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক তৎপরতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। কোরআনের তর্জমা, অসংখ্য তফসীর, হাদীসের অনুবাদ ছাড়াও ইসলামের নানা দিকের উপর অসংখ্য গ্রন্থ-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বিশ^খ্যাত এনসাইক্লোপেডিয়ার মতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে বিরাট বিরাট খন্ডের বহু ভলিউমে ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’। আরো নানাভাবে এ প্রতিষ্ঠান গবেষণা ধারা অব্যাহত রেখেছে। এ সকল বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার সুফল।
৬। এদেশে হাজার বছরের ইসলামী ঐতিহ্য মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব যখন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক ছাঁচে ঢেলে সাজান ও পুনর্জীবিত করেন এবং তা ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করেছে।
পরিশেষে বলে রাখা দরকার যে, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের আমলে মাদরাসা ছাত্রদের সর্বোচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ দীর্ঘ প্রত্যাশিত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার পিতার ইসলামী শিক্ষাপ্রীতিই অনুসরণ করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।