Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সুলতানি ও মুগল আমলের স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন কিশোরগঞ্জের ‘কুতুব শাহ মসজিদ’

মোহাম্মদ আবদুল অদুদ | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২১, ৯:৫৫ এএম

চমৎকার স্থাপত্যকীর্তিসমৃদ্ধ এবং সুলতানি ও মুগল আমলের নিদর্শন হিসেবে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্র‍ামে এখনও মুসলিম স্থাপত্যকর্মের উদাহরণ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কুতুব শাহ মসজিদ।বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদটি তৎকালীন বাংলার মুসলিম-স্থাপত্যকর্মের এক অনন্য নিদর্শন।  একটি দীঘির পাড়ে ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি দর্শকদের আকর্ষণ করছে বেশ।  প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অপরূপ উদাহরণ এই মসজিদটি সুলতানি আমলে নির্মাণ করা হয় বলে সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়।

মসজিদ ও পাশের মাজারের খাদেম মাওলানা আবদুল আজিজের সাথে কথা হয় ইনকিলাবের এই প্রতিবেদকের।  তিনি জানান, প্রায় সাড়ে ৯শ বছর আগে ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত কুতুব শাহ রহ. ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশে আসেন।  তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়।  তিনি বলেন, সাংবাদিকরা ইনকিলাবসহ বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির কারণে এখন দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক আসেন মসজিদটি দেখতে।  মাজারের কমিটির উদ্যোগে বার্ষিক ওরশ মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  তখন হাজার হাজার মানুষ আসেন, যেন লোকে লোকারণ্য। মাজারের আয় সম্পর্কে তিনি অনেকটা সংকোচ বোধ করেন।  মসজিদটি পরিদর্শনের পর যে কোনো মুসলিম পর্যটকেরই ভালো লাগবে বলে জানান তিনি।  মসজিদটির বহির্ভাগে উত্তর-দক্ষিণে ৪৫ ফুট লম্বা, আর পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট চওড়া।  অভ্যন্তরে প্রায় ৩৬ ফুট লম্বা, আর ১৬ ফুট চওড়া।  অর্থাৎ চারদিকের দেয়ালই প্রায় ৫ ফুট করে পুরু।  মসজিদটির পাশে একটি কবর রয়েছে।  কবরটিকে অনেকে কুতুব শাহ-এর বলে ধারণা করেন।  কুতুব শাহের নামানুসারেই মসজিদটিকেও কুতুব মসজিদ বা কুতুব শাহ মসজিদ বলা হয়।  ১৯০৯ সালে তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত হিসেবে নথিভুক্ত করে।  কুতুব মসজিদটি আবিষ্কারের সময় কোনো শিলালিপি পাওয়া না যাওয়ায় এর সঠিক নির্মাণকাল সম্পর্কে তেমন ধারণা পাওয়া যায় না।  তবে স্থাপত্য রীতি ও আন্যান্য দিক বিবেচনায় প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন এটি ১৬শ শতকে সুলতানি আমলে নির্মাণ করা হয়েছে।

কুতুব মসজিদের ৪টি কোণে ৪টি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজ রয়েছে।  এগুলো বলয়াকার স্ফীত রেখার মাধ্যমে অলঙ্কৃত।  সাধারণত এ ধরনের মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট হয়।  যেখানে মধ্যবর্তী গম্বুজের উভয় পাশে একটি করে তুলনামূলক ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজ থাকে।  কিন্তু এ মসজিদের স্থাপত্য-নিদর্শনের বিন্যাস ভিন্ন ধরনের।  বৃহদাকৃতির একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজের চার কোণে চারটি ক্ষুদ্র গম্বুজ স্থাপিত রয়েছে। ফলে গম্বুজের উল্লিখিত বিন্যাস মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে অসম তিনটি অংশে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যবর্তী অংশটির পরিমাপ ১৬ ফুট ১৬ ফুট এবং এর দুই পাশে রয়েছে ২ ফুট মার্জিন এলাকা।  আর পার্শবর্তী অংশদ্বয়ের পরিমাপ ৮ ফুট ১৬ ফুট। অষ্টভূজাকৃতির বুরুজের উপর রয়েছে ৪টি মিনার।  এছাড়াও মসজিদটিতে রয়েছে মোট ৫টি গম্বুজ।  মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণ দিকে লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রশস্ত।  পশ্চিম দেয়াল ব্যতীত বাকি তিনটি দেয়ালেই কৌনাকৃতির খিলানকৃত প্রবেশপথ রয়েছে ৫টি।  ৩টি পূর্বে এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে। প্রতিটি খিলানে গোলাকার ফুলবিশিষ্ট টেরাকোটার অলঙ্কার রয়েছে।  এতে এ অঞ্চলের অলঙ্কার কারিগরদের দক্ষতা ও রুচিবোধ ফুটে ওঠেছে। পূর্ব দেয়ালের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটির উপরিভাগে সাড়ে ২৬ ফুট লম্বা ও এক ফুটের অধিক পরিমাণ চওড়া একটি অলঙ্কারহীন ফাঁপা স্থান রয়েছে।  যেখানে লিপিযুক্ত কোনো ফলক ছিল বলে মনে হয়। সুলতানি আমলের মসজিদের কার্নিশে এবং বাংলার দোচালা ঘরের কার্নিশে যে স্বাভাবিক বক্ররেখা পরিলক্ষিত হয়, এই মসজিদের ক্ষেত্রে তা মাত্রাতিরিক্ত।

অভ্যন্তরীণ পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে।  এগুলো সর্পিল নকশাবিশিষ্ট অলঙ্করণ দ্বারা মনোরমভাবে সুসজ্জিত। এখানে ব্যবহৃত অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি টেরাকোটার নকশা এ মসজিদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মসজিদের বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা করা রয়েছে। মসজিদটির ছাদের কার্নিশ বক্রাকার।  ধারণা করা হয়, তৎকালীন ময়মনসিংহ অঞ্চলে সুলতানি আমলের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ এটিই।
কেউ যদি মসজিদ দেখতে ঢাকা থেকে যেতে চান ট্রেনে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক।  প্রতিদিন সকাল ৭ টায় এগারসিন্দুর প্রভাতি (বুধবার বন্ধ) কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ছাড়ে।  এছাড়াও গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া থেকে বিআরটিসি বাসে করে কুলিয়ারচর যাওয়া যায়।  ভৈরব হয়ে যেতে চাইলে, ভৈরব নেমে সিএনজিতে করে কুলিয়ারচর যেতে হবে। 
কুলিয়ারচর নেমে একটা রিক্সা নিয়ে লঞ্চঘাট।  এখান থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা, ৮টা, ৯টা, ১১টা এমনি করে ৩টা পর্যন্ত লঞ্চ ছেড়ে যায় অষ্টগ্রাম, ভাড়া ১০০ টাকা করে।  অষ্টগ্রাম পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে ৩ ঘন্টা ।  ফিরতি পথে বাজিতপুর হয়েও আসা যায়।  বিআরটিসির এসি বাস পাওয়া যায় সারাদিন।  

স্থানীয় খাদেম আবদুল আজিজ জানান, ২৪ আগস্ট ২০২০ সরকার থেকে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং কিছু কাজ করেছে। কিন্তু পুর্ণাঙ্গ সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা খুব জরুরি। শিগগিরই এ মসজিদটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও স্থাপতকীর্তিগুলোর সংরক্ষণ না হলে নষ্ট হবে প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের পুরনো এই মসেজিদটির পর্যটন আকর্ষণ।  দেশের প্রত্নসম্পদের তালিকা থেকে হয়তো হারিয়ে যেতে পারে আরও একটি নিদর্শন। বর্তমানে মসজিদটির শোভাপ্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে এর দক্ষিণ ও পূর্বপাশে দেয়া বিশালাকার ত্রিপাল।  সংস্কার কাজের আগে লাগানো হলেও এখনও সেটা নামানো হচ্ছে না স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর চাপে। ফলে মসজিদের সৌন্দর্য় অবলোকন করা যাচ্ছে না ঠিকভাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, মসজিদের গ্রীল রং করা এবং রিপেয়ারিংয়ের কাজ সম্পন্ন না করেই মাসখানেক আগে স্থানীয় এমপি রেজোয়ান আহমেদ তৌফিক কে দাওয়াত দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা উপলক্ষে মিলাদও করা হয়ে গেছে। সুতরাং সুলতানী ও মুগল আমলের প্রত্নসম্পদটি যথাযথভাবে সংরক্ষণের তাগিদে অভিযুক্ত বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে বলে স্থানীয়দের দাবি । 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঐতিহ্য

৮ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ