তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
সেনাবাহিনী নিয়ে মানুষের যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে। এরা কী খায়, এরা কীভাবে ঘুমায়, এদের আবাস কেমন, এদের ভাষা কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলাদেশে যদিও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের কাতার থেকেই উঠে আসে, তথাপি যখন সৈনিক হয়ে যায় তখন সে এক ভিন্ন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতোই। তবে বলাই বাহুল্য যে, গঠনে, গড়নে, আদর্শে, প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আংশিক উত্তরসূরি। আংশিক বললাম এ জন্য যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে আমাদের সেনাবাহিনীর চালচলন, আচার-আচরণ ও মতাদর্শে প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়া বিগত বছরগুলোতে অন্যান্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার ইন্টারঅ্যাকশনের কারণে সেসব সেনাবাহিনীর বহু রেওয়াজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অভ্যাস বা আচার-আচরণ আমাদের সেনাবাহিনীকেও কিছু না কিছু প্রভাবান্বিত করেছে। পাঠক মাত্রই জানেন, জাতিসংঘের অধীনে পৃথিবীর বিভিন্ন উপদ্রত অঞ্চলে শান্তি রক্ষার নিমিত্তে যতগুলো দেশ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অবদান রেখেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থান নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। অতএব বলতেই হবে, আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিশ্বায়নের যুগের সেনাবাহিনী। আজকের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমসাময়িক বিশ্বের প্রশংসার পাত্র। তারপরেও প্রচুর সংখ্যক বিষয় আছে যেগুলো অনেক দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে কম-বেশি একইরকমভাবে বিদ্যমান। মিলিটারি ট্রেডিশন বা সামরিক ঐতিহ্য তথা সামরিক সংস্কৃতি একটি আলোচ্য বিষয়।
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমে জাঁকজমকের সঙ্গে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর তারিখটিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়, তথাপি এটাই সত্য যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম ২৫ মার্চ ১৯৭১ দিবাগত রাত বারোটার পর তথা ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখের প্রথম প্রহরে যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একাধিক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। তখনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোড়াপত্তন হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের মধ্য পর্যায়ে বিভিন্ন বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজগুলোর ওপর মাইন-হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর বীজ বপন হয়েছিল এবং একদম শেষের দিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, অ-যুদ্ধ (তথা বেসামরিক) বিমানগুলোকে এডহক ভিত্তিতে সাজিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে বোমা নিক্ষেপ-আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বীজ বপন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে রণাঙ্গনের মুক্তিবাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ফোর্সেস এবং এর কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন তৎকালীন কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ, যাদের পরিচিত নাম ছিল মুজিব বাহিনী, তারা বাংলাদেশ ফোর্সেস-এর অংশ ছিল না এবং প্রধান সেনাপতি বা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ ফোর্সেস নামক পরিচয় এবং সংগঠন বহাল ছিল। এ তারিখে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য আলাদা আলাদা চিফ অব স্টাফ নিয়োগ প্রদান করে বাহিনীগুলোকে আলাদা করেন। নবজাতক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জনবলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল এক সময়কার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত সৈনিক। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমবিকাশে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেওয়াজ দস্তুর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আংশিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ দিবাগত রাত ১২টায় জাসদপন্থী একটি গোপনীয় সংগঠন (যার নাম ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা) সেনাবাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ও সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ শুরু করেছিল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সৈনিক সম্প্রদায়ের বৃহদাংশ এই বিদ্রোহকে কাউন্টার করে এবং তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেছিল। সেই ঘটনাকে সিপাহী জনতার বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয় এবং দিবসটিকে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস নামে পালন করা হয়। এর পরপরই দেশের শীর্ষ ক্ষমতার প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি কিছু সেনাবাহিনীর অফিসার-সৈনিক সম্পর্ক এবং সৈনিকগণের ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে কিছু সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলের কয়েকটি প্রথাকে পরিশীলিত করেছিলেন।
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ ঢাকা মহানগরীর পিলখানায় অবস্থিত তৎকালীন বিডিআর-এর সদর দফতরে, বিডিআর সদস্যদের বিদ্রোহে বহু সংখ্যক অফিসার এবং বেসামরিক ব্যক্তি শাহাদাতবরণ করেন। ঘটনা ঘটার স্থান ছিল পিলখানার অভ্যন্তরে অবস্থিত বিডিআর দরবার হল। ঘটনার পর থেকে এ দরবার শব্দটির সঙ্গে সারা বাংলাদেশের পত্রিকাপাঠক ও টিভিদর্শক তাৎক্ষণিক নিবিড়ভাবে পরিচিত হয়ে গেলেন। তাই আজকের কলামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই ‘দরবার’ নিয়ে লিখি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শত রেওয়াজ বা সেনা-সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম রেওয়াজটি হল দরবার। তবে সব জায়গায় দরবারের জন্য সুনির্দিষ্ট হল নেই। দরবার উন্মুক্ত জায়গাতেই হয়। এ প্রক্রিয়ার ঐতিহ্যগত জন্ম দিল্লিতে অবস্থিত শাসকদের আমল থেকে। সুলতান বা সম্রাটরা প্রজাদের বা তাদের প্রতিনিধিদের দর্শন দিতেন যেই স্থানে এবং যেই নিয়মে, সেটাকে বলা হতো দরবার। আবার দশ বা বারোশ বছর আগে থেকেই প্রখ্যাত সুফি সাধকগণের যে আস্তানা এবং যেই প্রক্রিয়ায় সুফি সাধকরা তাদের মুরিদ সন্তান বা তাদের দর্শনার্থী সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন, সেটিকেও দরবার বলা হতো। এ নিয়মেই সেনাবাহিনীর অধিনায়করা মাসে একবার নিজস্ব কমান্ডের দরবার নিতেন; এখনও নেন। এটি একটি আনুষ্ঠানিক কর্ম কিন্তু বাস্তবসম্মত। অধীনস্থ সৈনিকরা অকপট চিত্তে সরাসরি তার অধিনায়কের কাছে কোনো নালিশ বা মন্তব্য উপস্থাপন করার সুযোগ পায় এবং অধিনায়কও সরাসরি সব সৈনিকের সামনে তার মনের কথা বা কোনো পরিকল্পনা, কোনো সার্বজনীন নির্দেশ ইত্যাদি উপস্থাপনের সুযোগ পায়। ব্যাটালিয়ন তথা রেজিমেন্ট পর্যায়ে দরবার প্রতি মাসে হয়। কদাচিৎ ব্রিগেড পর্যায়ে দরবার হয়। কদাচিৎ ডিভিশন পর্যায়েও দরবার হয়। বিশেষ প্রয়োজনে সেনাবাহিনী প্রধানের দরবার হয় বিভিন্ন এলাকায় বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দরবার হয় বিভিন্ন এলাকায়।
সেনা-সংস্কৃতির আরেকটি বড় কর্ম হল, প্রীতিভোজ বা বড়খানা। এ বড়খানা নামকরণের কারণ হল, স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান থেকে এ অনুষ্ঠানে অংশীদারের উপস্থিতি বেশি, খাওয়ার আইটেমের সংখ্যা বেশি, উপস্থিত মেহমানদের জ্যেষ্ঠতা বেশি, সে জন্য এ খাওয়াগুলোর নাম হতো বড়খানা। এ বড়খানার রেওয়াজও ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত। কিছু কিছু অনুষ্ঠান আছে যেগুলোতে বড়খানা সমগ্র সেনাবাহিনীতে অনুষ্ঠিত হয় যথা দুইটি ঈদের দিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি। কোনো কোনো সময় কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্টের বা ব্রিগেডের বা ডিভিশনের সুনির্দিষ্ট অজুহাতে বড়খানা বা প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হয়। যেমন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠা দিবসে, কক্সবাজার জেলার রামুতে অবস্থিত রামু সেনানিবাসের পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিনটিতে, মাননীয় সেনাবাহিনী প্রধান যদি দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ভিজিট করেন, তাহলে সেই ভিজিটের দিনে বড়খানা বা প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হয়।
সেনাবাহিনীর ভেতরে খেলাধুলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজয়ী দল তথা তাদের ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্ট বা ব্রিগেড বিজয়ের আনন্দে বড়খানা বা প্রীতিভোজে অংশ নিতে পারেন। বড়খানা সাধারণত উন্নত চাল যথা পোলাওয়ের চাল দিয়ে ভাত রান্না হবে এবং মুরগি ও গরুর মাংসসহ একাধিক তরকারির আইটেম থাকবে। বড়খানার আনুষ্ঠানিকতায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির উপস্থিতি। ব্যাটালিয়ন হলে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বা কোনো একজন ব্রিগেড কমান্ডার প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। অথবা কোনো একজন জিওসি অধীনস্থ কোনো ব্যাটালিয়নে প্রধান অতিথি হতেই পারেন। প্রধান অতিথি সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করবেন, প্রথমে নিজে বিসমিল্লাহ বলে আহার নিজে মুখে তুলে নেবেন এবং অতঃপর সবাই বিসমিল্লাহ বলে আহার তুলে নেবেন। বড়খানা বা প্রীতিভোজের ঐতিহ্যের আরও একটি আঙ্গিক হল, অংশগ্রহণকারী সবার জন্য একই মেন্যু হবে এবং সবাই একইসঙ্গে খাবে। পঞ্চাশ বছর আগে সবাই টেবিলে বসে খাওয়ার জায়গা বা সুযোগ হতো না কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর বর্তমানে সবাই টেবিলে বসেই খেতে পারেন।
সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের মধ্যে আরেকটি হল, খেলার মাঠের আনন্দ। যে কোনো খেলায় দুটি পক্ষ থাকে এবং উভয় পক্ষের সমর্থকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে নিজ নিজ প্রতিযোগী দলকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। ফুটবল বা হকি খেলা হয় বড় মাঠে তাই অনেক সমর্থক বসতে পারে। ভলিবল বা বাস্কেটবল খেলা হয় ছোট মাঠে তাই চতুর্দিকে বসার জন্য সমর্থকের সংখ্যাও কম হয়। বক্সিং বা মুষ্ঠিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় চার-পাঁচ ফুট উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত বেদিতে। এটারও চতুর্পাশে সমর্থকরা বসে। মজার বিষয় হল, সমর্থকদের সমর্থনটিও ছন্দময় হয়, তালে তালে হয়, স্লোগানে স্লোগানে হয় এবং সেসব জায়গায়ও দিক নির্দেশক থাকে যারা স্লোগানের পথিকৃৎ হয়। ব্যান্ড পার্টির অংশ থাকে এবং জিতলেই ব্যান্ড বাজানো শুরু হয়। এটা গেল প্রকাশিত বক্তব্য। খেলাধুলা নিয়ে অপ্রকাশিত বক্তব্য হল, খেলোয়াড়রা বা প্রতিযোগীরা নিজস্ব পরিমণ্ডলে অতীব প্রিয়পাত্র, অতীব খাতিরের পাত্র। অধিনায়ক এবং অন্য সবাই তাদের খাওয়া-দাওয়ায় অতিরিক্ত আয়োজন করে দেয়, তাদের স্বাভাবিক কর্তব্য কমিয়ে দেয়, তাদের সাফল্য সাপেক্ষে দ্রুত প্রমোশন দেয় এবং পরীক্ষার সময় পরীক্ষকরা শিথিল হয়। বহু সংখ্যক সৈনিক থাকে, তারা আট-দশ বছর বিভিন্ন খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং তারা সমগ্র সেনাবাহিনীতেই খেলোয়াড় হিসেবে সুপরিচিত থাকে। অধিনায়কদের কর্মকাণ্ডের অন্যতম একটি অঙ্গন হল খেলার অঙ্গন। কোনো ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্ট খেলাধুলায় যদি দুর্বল হয়, তাহলে সেই ব্যাটালয়নের বা সেই রেজিমেন্টের সৈনিকদের মনোবলও দুর্বল হয়। খেলাধুলার কথা বলতে গিয়ে আমাকে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, কিছু প্রশিক্ষণ পর্যায়ের প্রতিযোগিতাও থাকে যেখানে একইরকম স্পিরিট কাজ করে। যেমন আন্তঃব্যাটালিয়ন ফায়ারিং কমপিটিশন, আন্তঃব্যাটালিয়ন এসল্ট কোর্স কমপিটিশন বা আন্তঃব্যাটালিয়ন ৩৬ মাইল হাঁটা প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। সবক্ষেত্রেই অফিসারদের অংশগ্রহণ অলিখিত বাধ্যতামূলক। অফিসারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে খেলোয়াড় বা প্রতিযোগী দলগুলোর মনোবল উচ্চ থাকে। তাই যে ব্যাটালিয়ন বা রেজিমেন্টের অফিসাররা বেশি খেলোয়াড়ি মনোভাবাপন্ন, তাদের মনোবল অনুরূপ উচ্চ থাকে। ফায়ারিং করার সময় অফিসাররা যদি উজ্জ্বল তথা সাফল্যের দৃষ্টান্ত রাখতে না পারেন, তাহলে ওই টিম দুর্বল হয়ে যায়।
সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের একটি আঙ্গিক হল অফিসার ও সৈনিকের সম্পর্ক। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। বর্তমান গাজীপুর জেলা সদরে অবস্থিত ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজার বাজবাড়িতে সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যেদিন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করলেন, সেই তারিখটি ছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। সেদিন আমার বয়স ২২ বছর শেষ হতে এক মাস বাকি। নতুন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রথম এক মাস বা দুই মাস থাকা, খাওয়া, ঘুমানো সবকিছুই হয় সৈনিকদের সঙ্গে এবং এ সময়কালটিকে বলা হয় রেজিমেন্টেশন পিরিয়ড। বিভিন্ন র্যাংকের সৈনিকদের একজন হয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের অভ্যাস করা হয়। সৈনিকদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুর প্রত্যক্ষ একজন সাক্ষী হয়ে ওঠেন প্রত্যেকটি নবীন অফিসার। এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে ছোট বা বড় স্তরের অধিনায়কত্ব গড়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর তথা সৈনিকদের মনোবল উঁচু রাখায় যেসব উপাত্ত অবদান রাখে, তার মধ্যে অন্যতম হল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। যেমন, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান, মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান, তরুণ অফিসারদের বিয়েশাদির আয়োজন ইত্যাদিতে সৈনিকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। এসব অনুষ্ঠানে মিলিটারি ব্যান্ড বড় একটি ভূমিকা পালন করে। মিলিটারি ব্যান্ড শুরু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য নয়। হাজার বছর আগে থেকেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিত্যসঙ্গী ছিল ব্যান্ড। ব্যান্ডের তালে তালে মার্চ করা, ব্যান্ডের মাধ্যমে প্রেরণাদায়ক গানের সুরের মূর্ছনা তুলে সৈনিকদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসক্ত রাখা, ইত্যাদি সেনাবাহিনীতে অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। জুমার নামাজে সব অফিসার অংশ নেয়া এটাও একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। বছরে দুই ঈদের দিনে, সব স্তরের অধিনায়ক পরিকল্পিতভাবে হাসপাতালে গিয়ে সব রোগীকে দেখবেন এবং তাদের হাতে মিষ্টি তুলে দেবেন, এটাও আরেকটি ঐতিহ্য।
সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যগুলোকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রেজিমেন্ট সেন্টার যথা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, চট্টগ্রামের হালিশহর সেনানিবাসে অবস্থিত আর্টিলারি রেজিমেন্টাল সেন্টার, খুলনা জাহানাবাদ সেনানিবাসে অবস্থিত আর্মি সার্ভিস কোর সেন্টার, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সেনানিবাসে অবস্থিত কো অব মিলিটারি পুলিশ সেন্টার, যশোর সেনানিবাসে অবস্থিত সিগন্যাল কোর সেন্টার ইত্যাদি ভূমিকা রাখে। ঐতিহ্যের একটি নমুনা হল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিনায়ককে বলা হয় পাপা টাইগার। অর্থাৎ বাঘের পিতা। কারণ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব অফিসার ও সৈনিক টাইগার নামে পরিচিত। যা হোক, সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের মধ্যে আরও ছোট ছোট অনেক বিষয় আছে যেগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে উন্নত মনোবলসম্পন্ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।