চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সন্তান তরবিয়তের সঠিক পন্থা : এ সমস্ত সমস্যায় সন্তানের সংশোধন ও সঠিক তরবিয়তের সবচেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ পথ বলেছে ইসলাম। ইসলাম এটাও বলে দিয়েছে, তার তরবিয়ত কোত্থেকে শুরু হবে এবং কে তার মূখ্য দায়িত্ব পালন করবে। এজন্যই সর্বযুগে আদর্শ সন্তান গঠনে উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রমাণ রেখেছেন মুসলিম মায়েরা। অনেক মা মনে করেন, বাচ্চা পেটে আসা থেকে তার তরবিয়ত শুরু করতে হয়। কেউ মনে করেন, বাচ্চার কথা বলা থেকে তার তরবিয়ত আরম্ভ করতে হয়। আবার কেউ মনে করেন, বাচ্চা তার চারপাশের পরিবেশ বোঝা দিতেই তখন থেকে তার তরবিয়ত শুরু করতে হয়।
কিন্তু কোরআনে কারিমের শিক্ষা এবং সুন্নতে রাসুল (সা.)-এর আলোকে পরিষ্কার জানা যায়, শিশুর তরবিয়তের স্তর শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি থেকে। বিয়ের আগে সন্তানের জন্য আদর্শ মা নির্বাচন থেকে। অর্থাৎ একজন ছেলে ও মেয়ে যখন বিয়ের জন্য পা বাড়ায়, তখন থেকেই তাদের ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে তাদের সন্তানের কেমন বাবা ও মা নির্বাচন করা উচিত। কারণ এটাই সন্তান তরবিয়তের প্রথম ধাপ ও তার অধিকারসমূহের অন্যতম। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন-‘মানুষ সাধারণত নারীদের মাঝে চারটি গুণ দেখে বিয়ে করে- তার ধন-সম্পদ, বংশ-মর্যাদা, সৌন্দর্য এবং ধর্ম। কিন্তু তোমরা বিয়ের জন্য ধার্মিক নারীদেরকে অগ্রাধিকার দাও। তোমরা যদি ধার্মিক নারীদেরকে অগ্রাধিকার না দাও, তাহলে অবশ্যই তোমাদের দু’হাত ধূলোয় ধূসরিত হবে। (অর্থাৎ নিশ্চয়ই সেটা তোমাদের জন্য মন্দ ও অকল্যাণ ডেকে আনবে)।’
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন- রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন-‘যদি তোমাদের কাছে এমন পাত্রের সন্ধান আসে, যে দীনদার ও সৎচরিত্রের অধিকারী, তাহলে তোমরা বিয়ের জন্য অগ্রসর হও, অন্যথায় দুনিয়ায় ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’ এ হাদিস দুটি পড়ে বোঝা যায়, স্বামী-স্ত্রীকে কেমন গুণের হলে ভালো, আল্লাহর রাসুল (সা.) তা শিক্ষা দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, সন্তানের জন্য সঠিক পিতামাতা নির্ণয় করা থেকেই তার তরবিয়ত শুরু হয়। কিন্তু আফসোস, আজকাল বিয়েতে সম্পদ, কামাই, বাড়িঘর, খানদান, সবই দেখা হয়; কিন্তু দীনদারি দেখা হয় না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছেলেমেয়ে উভয়ে এ বিষয়ে ভালোভাবে নজর দেওয়া, আমি যাকে বিয়ে করছি, সে ভবিষ্যতে আমার সন্তানের অভিভাবক ও তরবিয়তের যোগ্য কিনা!
২. পরিপূর্ণ ইসলামি পন্থায় বিয়ে হবার পর স্ত্রী যখন শ্বশুরবাড়ি চলে আসে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পরিচয় ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং উভয়ে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষ আমলের জন্য মিলিত হয়, তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করা-‘হে আল্লাহ! আমাদের কাছ থেকে শয়তানকে দূরে সরিয়ে দিন এবং যে সন্তান আমাদের দান করবেন, তার কাছ থেকেও হটিয়ে দিন।’ দোয়া করা উচিত হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো-‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে নেকসন্তান দান করুন।’ দোয়া করা উচিত হজরত জাকারিয়া (আ.)-এর মতো-‘হে আল্লাহ! আমাকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া কবুলকারী।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৮)।
দুঃখের বিষয় হলো, শরিয়ত আমাদের সংশোধনের জন্য যেখানেই কোনো বিশেষ হুকুম দিয়েছেন, ঠিক সেখানেই কিছু না কিছু কমবেশি করা হয়েছে। আজ সবাই দোয়া করেন, আল্লাহ আমাকে চাঁদের মতো সুন্দর সন্তান দান করুন। কিন্তু নেকসন্তানের দোয়া কম লোকই করেন। যদি নেকসন্তানের দোয়ায়ই না করা হয়, তাহলে সন্তান সুন্দর হওয়াসত্তে¡ও বখাটে ছাড়া কিংবা হবার আশা করা যায়। আর যদি সন্তান মা-বাবার অশান্তির কারণই হয়, তাহলে তার সৌন্দর্য দুনিয়া ও আখেরাতে মা-বাবার কী উপকারে আসবে। এ পর্যন্ত ছিলো সন্তান জন্মের পূর্বেই তার তরবিয়তের জন্য পিতামাতার পূর্বপ্রস্তুতি।
৩. আল্লাহর কাছে দোয়া করার পর যখন তিনি সেই নেয়ামত মায়ের কোলে ঢেলে দেবেন, তখন ইসলামি পন্থায় নবাগতকে স্বাগত জানানো।
হিন্দুয়ানি বা অনৈসলামি পন্থায় স্বাগত না জানানো। কারণ সন্তানের শিক্ষাদীক্ষার পাঠগ্রহণ জন্ম থেকেই মায়ের কোলে আরম্ভ হয়ে যায়। মায়ের কোলই তার প্রথম বিদ্যালয়। আর পিতামাতা হলেন তার এ বিদ্যালয়েল যৌথ শিক্ষক। পরবর্তীতে মাদরসা-স্কুল হয় তার পাঠগ্রহণের দ্বিতীয় বিদ্যালয়। তাই রাসুল (সা.) পাঁচটি কাজের মাধ্যমে নবাগতকে স্বাগত জানাতে বলেছেন- ১. জন্মের পর কোনো বুজুর্গ ব্যক্তির দ্বারা তার কানে আজান ও ইকামত দেয়া এবং তার দ্বারা খেজুর চিবিয়ে তাকে খাওয়ানো। ২. বাচ্চার জন্য বরকতের দোয়া করা। রাসুল (সা.) নিজে আমল করে তা উম্মতকে শিখিয়েছেন। তার কাছে কোনো নবাগত শিশুকে আনা হলে তিনি কোলে নিতেন, মহব্বতভরে তাকে চুমু খেতেন। দোয়া করতেন-‘হে আল্লাহ! একে দিনের সঠিক বুঝ দান করুন। দীনের ওপর অটল রাখুন। হে আল্লাহ তাকে হেদায়েতপ্রাপ্ত বান্দা এবং অন্যের হেদায়েতের পথপ্রদর্শনকারী বানান।’ মা-বাবা দোয়া করবেন বাচ্চার নেকআমলের জন্য, তার (তাকওয়া) আল্লাহভীতির জন্য, আল্লাহর অনুগত হবার জন্য, এরপর পিতামাতার অনুগত হবার জন্য। ৩. বাচ্চার জন্য সুন্দর নাম রাখা। কারণ ব্যক্তির ওপর তার নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে। আমরা বর্তমানে আধুনিক, আনকমন, এবং খেলোয়াড়, নায়ক-নায়িকাদের নাম আনন্দবোধ করি। অথচ নাম রাখার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ছেলেদের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে আমাতুল্লাহ, জুওয়াইরিয়াহ, আবিদা, এসব নাম রাখা।
অর্থাৎ আল্লাহর গুণবাচক নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা, আম্বিয়ায়ে কেরামের মতো নাম রাখা, এমন নাম না রাখা যার মাঝে শিরিকের মিশ্রণ থাকে, মন্দ গুণ থাকে। অথচ বর্তমানে অনেকেই আনকমন নাম রাখতে গিয়ে এমনও নাম রাখেন, যে নামে আগুন, আগুনের শিখা, বক্র, ইত্যাদি গুণ থাকে। পরবর্তীতে সে ব্যক্তির ওপর এসব গুণের প্রভাব দেখা দেয়।
৪. আকিকা করা। এ বিষয়ে বর্তমানে চরম অবহেলা দেখা যায়, কেউ তো অলিমার সঙ্গে আকিকা করেন। কারো বাবা-মা সন্তান বড়ো হলে আকিকা করেন। সুন্নত তরিকা হলো সাত, চৌদ্দ বা একুশ দিনের মাথায় আকিকা করা।
অথচ অন্যদিকে মুসলমানি দেওয়ার সময় ঠিকই বড়ো বড়ো আয়োজন করা হয়। ইসলামে যার কোনো প্রমাণ নেই। ৫. বাচ্চার মাথার চুল মুন্ডিয়ে সোনারুপোর পরিমাপে সদকা করা। শরিয়তের দেখানো পন্থায় আমল করলে খুব সহজে সন্তানের তরবিয়ত করা সম্ভব। শরিয়ত বর্জন করে তার আদর্শ তরবিয়ত কখনোই হতে পারে না। বরং শরিয়ত বিবর্জিত কাজ সন্তানের ওপর অত্যন্ত মন্দ প্রভাব ফেলে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।