পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কথায় বলে, ‘আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, পরে অন্য কিছু।’ এদেশে তার উল্টো। ভাষা রক্ষার জন্য গেছে প্রাণ। করতে হয়েছে সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের সোপান বেয়ে এসেছে স্বাধীনতা। সে ভাষা আজ অবহেলিত, অবজ্ঞার শিকার। গ্রাম বাংলার চিত্রও পাল্টে গেছে। সবচেয়ে বেদনার ব্যাপার হলো, ইদানিং দেখা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কার্ড, নিমন্ত্রণ পত্র ইংরেজিতে ছাপানো হয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণির মধ্যেই এটা দেখা যায়। মোটামুটি অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছে এমন লোকেরা বিবাহ, আকিকা, সুন্নাতে খাতনার কার্ড ইংরেজিতে করেন। এর মধ্যে দিয়ে তারা তাদের আভিজ্যত্য এবং বড়লোকি জাহির করেন। বাংলা ভাষায় করলে, আভিজাত্য প্রকাশ পায় না। লোকে বলাবলি করে, অমুকের পোলার বিয়ে কার্ড ইংরেজিতে করেছে।
যে ভাষার জন্য শহীদেরা রক্তদিলো, তারা কী পেলেন? তাদের মর্যাদা কি আমরা দিতে পেরেছি? মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য যারা নিজের জীবনকে কোরবানি দিলেন, তাদের জীবনের মূল্য আমরা কতটুকু দিতে পারলাম। দীর্ঘ প্রায় সত্তর বছর কেটে গেলো, আমরা তাদের আত্মদানের কোনো মূল্য দিতে পারলাম না। ক্ষমতার মসনদে বসে আমরা তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকার সমূহের কথা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ ক্ষমতা পাকা পোক্ত করার জন্য তাদের এই বলিদানকে আমরা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছি নির্ধিদায়। একবার ভাবছি না যে, পাওনাদারের পাওনা শোধ করা হয়নি।
কোর্ট কাছারি অফিস, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ সর্বত্র বাংলাভাষা উপেক্ষিত। সবাই বাংলার পরিবর্তে, ইংরেজিতে কাজকর্ম করতে ভালোবাসেন। কথা ছিল, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সকল কাজ বাংলায় চলবে। সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রাধান্য থাকবে। দুর্ভাগ্য যে, বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। যে সকল কর্তা ব্যক্তির কাছে, সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলনের দায়িত্ব, তারা সবাই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে কর্মকান্ডের পক্ষে। এমন কি সাধারণ আলোচনায়ও তারা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাছন্দ্য বোধ করেন।
যাদের হাতে নিয়মনীতি বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা, তারা যদি তা না করেন, তবে অবস্থা কি দাঁড়াবে, তা সহজে অনুমেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি আসলে শহীদের জন্য কান্নাকাটি শুরু হয়। শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সারাদিন আলোচনা মিটিং, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম। সর্বত্র বাংলাভাষার প্রচলন করার আলোচনা। কর্তাব্যক্তিদের কথার ফুলঝুরি আর সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দেয়ার খেলা। সর্বত্র বাংলা ভাষায় কার্যক্রম পরিচালনার শপথ। বাস্তবে শুভংকরের ফাঁকি। ২১-এর পরে শহীদ মিনারগুলো ও অরক্ষিত হয়, অপবিত্র হয়। বিভিন্ন অপকর্মের নিরাপদ জায়গায় পরিণত হয়।
দেশের সর্বত্র চোখ রাখলে দেখা যায়, ইংরেজির খেলা। সরকারি, বেসরকারি সাইনবোর্ড, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বড় বড় সপিংমলের দোকানগুলোর সাইনবোর্ড এবং দোকান, প্রতিষ্ঠানের আশি ভাগের নামই ইংরেজিতে। যেখানে সরকারি সংস্থাগুলোর সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা হয়, সেখানে অন্যদের বেলায় কী বলার আছে? কিছু কিছু সাইনবোর্ড, ব্যানার বাংলায় লেখা হয়, তাও আবার বানান ভুল। রেডিও জোকি নামে একটি শ্রেণি গজিয়ে উঠেছে। তারা বাংলা নয়, বাংরেজি ভাষা চালু করেছেন। এভাষা তারা কোথায় পেয়েছেন, জানি না। তাদের উপস্থাপনার ঢং চলন, বলন, বাংলা ভাষাকে কবরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের টেলিভিশন মিডিয়ার উপস্থাপনা ও বাংলা ভাষাকে বিকৃত, ভুল উচ্চারণের মাধ্যমে ভাষার মানকে নিম্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একুশ আসলে জমে ওঠে একুশের বই মেলায়। কাড়ি কাড়ি কাব্য, সাহিত্য, গল্প, নাটকের বই বের করার তোড় জোড় শুরু হয় অনেক আগে থেকেই, যা সত্যি ভাল লাগার। এ মেলায় ওঠা বইয়ের বেশিরভাগই মানোত্তীর্ণ নয়। এভাবেই আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা দিচ্ছি। বাংলা ভাষার সর্বত্র প্রতিষ্ঠার কাজ কতটুকু হয়, তা জানা হলো না।
লেখক: শিক্ষক, শ্রমিক নেতা ও সাংস্কৃতিককর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।