ভালোবাসি মাতৃভাষা
‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা...’আমার ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।জন্মেই মাকে মা বলে
ইসলাম এবং বাংলাভাষাই বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি
অধ্যাপক আবদুল গফুর ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসেনানী। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের শুরু থেকে সক্রিয় নেতা এবং ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি দেশের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক। পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী জাতির এই কৃতী সন্তান অধ্যাপক আবদুল গফুরের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন দৈনিক ইনকিলাবের সহ-সম্পাদক সৈয়দ ইবনে রহমত।
সৈয়দ ইবনে রহমত: স্যার, কেমন আছেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। বয়সের কারণে কিছু সমস্যা তো থাকেই। তবে এখনো চিন্তা করতে পারছি, লিখতে পারছি, এটাই বড় কথা।
সৈয়দ ইবনে রহমত: আপনার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি আমাদেরকে কিছু বলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: আমার জন্ম ১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি রাজবাড়ি জেলার দাদপুর গ্রামে। আব্বা আলহাজ মুনশী হাবিল উদ্দিন ছিলেন একজন কৃষক। তিনি আমাদের গ্রামে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে এটি প্রাইমারি স্কুল। আমি আমার আব্বার প্রতিষ্ঠিত মক্তবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। তারপর পাবনায় তালিম নগর মাদরাসায় ভর্তি হই। সেখানে পড়েছি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় ভর্তি হই সপ্তম শ্রেণিতে। সেখান থেকেই ১৯৪৫ সালে হাই মাদরাসা ম্যাট্রিকুলেশনের সমমান পরীক্ষায় পাস করি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম। আসাম ও বাংলায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় আমার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ঢাকায় এলেন কখন? কোথায় ভর্তি হয়েছিলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে হুগলি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া আমার ভালো লাগেনি। কলকারখানার ধোঁয়া আমার সহ্য হয়নি। তাই চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় এসে গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হই, এখন যেটা সরকারি কবি নজরুল কলেজ হিসেবে পরিচিত। থাকতাম কলেজের প্যারাডাইস হোস্টেলে। মেধাবী এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট হিসেবে কলেজে আমার টিউশন ফি এবং হোস্টেল ফি মাফ ছিল, শুধু খাওয়াবাবদ মাসিক ৮ টাকা দেওয়া লাগত। হোস্টেল ছিল বুড়িগঙ্গার কাছেই। তখন নদীর পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল, আমরা দল বেঁধে গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ঢাকায় তখন পরিচিত কেউ ছিলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: আবদুর রহমান নামের এক লোক ছিলেন আমাদের এলাকার। তিনি লালবাগে থাকতেন। ঢাকায় এসে প্রথমে তার বাসাতেই উঠেছিলাম। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর হোস্টেলে চলে আসি। আর ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন, নাম এনামুল হক। তিনিও ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি আসার পর এনামুল হক খুব খুশি হয়েছিলেন। সবার সাথে গর্বের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেন, আর বলতেন, এই দেখো, আমার এলাকার আবদুল গফুর, অত্যন্ত মেধাবী স্টুডেন্ট, ম্যাট্রিকুলেশনে স্ট্যান্ড করা ছাত্র।
সৈয়দ ইবনে রহমত: পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হলেন কখন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম আরো আগেই। ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায় থাকতেই পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। মাদরাসায় আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন হাফেজ মতিউর রহমান, এনামুল হক প্রমুখ। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাদরাসার হোস্টেলে থাকতাম, মেধাবী স্টুডেন্ট হিসেবে আমার কোনো খরচ দিতে হতো না। সেখানেই তাদের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতাম। ফরিদপুরের হালিমা জুনিয়র গার্লস মাদরাসায় একবার পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে দুই সপ্তাহের একটা ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তান আন্দোলন কেন প্রয়োজন সে সম্পর্কে নেতৃবৃন্দ আমাদের লেকচার দিতেন। বিশেষ করে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্তৃতা করতেন। তার তীক্ষè যুক্তিযুক্ত বক্তব্য শুনে শুনেই আমরা তখন পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: পাকিস্তান আন্দোলনের সময় তো সিলেটেও গিয়েছিলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: হ্যাঁ, সিলেট রেফারেন্ডামের সময় সেখানে গিয়েছিলাম। আমার চাচাত ভাই ইসাহাক আলীর সাথে আমি গিয়েছিলাম। মুসলিম লীগের আরো অনেক নেতাকর্মীও গিয়েছিলেন। আমাদের কাজ ছিল, সেখানকার মুসলমানরা যেন পাকিস্তানের সাথে থাকার ব্যাপারে ভোট দেয় সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা। দুই দিন ব্যাপী গণভোট হয়েছিল, কিন্তু আমরা যে এলাকায় প্রচার চালিয়েছিলাম সেটা শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়াতেই পড়েছিল।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল? কারা এর সাথে জড়িত ছিলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। পাকিস্তান আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করার আগেই তিনি পাকিস্তানের কালচারাল মুভমেন্ট কী হবে সেটা নিয়ে ভাবছিলেন। সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে একটি ইসলামি বিপ্লবী কালচারাল অর্গানাইজেশনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১ সেপ্টেম্বর আবুল কাসেম সাহেব সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরে মুজিনগর সরকারের অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন), শামসুল আলম এবং ফজলুর রহমান ভূঁইয়াকে (১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছিলেন) নিয়ে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস’ গঠন করেন। পাকিস্তানের জাতীয় সাংস্কৃতি বিকাশের জন্যই মূলত এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। আবুল কাসেম সাহেব ছিলেন ফাউন্ডার সেক্রেটারি। শুরুতে তমদ্দুন মজলিসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো পদ ছিল না, সেক্রেটারি জেনারেলই ছিলেন সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ভাষা আন্দোলন বা তমদ্দুন মজলিসের সাথে যুক্ত হলেন কীভাবে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: সিলেট রেফারেন্ডমের সময় আবুল কাসেম সাহেবেরও সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় তিনি যেতে পারেননি। কাসেম সাহেব যেতে না পারলেও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলে দিয়েছিলেন, সিলেটে যদি আমাদের চিন্তাধারার কাউকে পান তাহলে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। সেখান থেকে কথাশিল্পী শাহেদ আলীকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন আবুল কাসেম সাহেবের কাছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় তখন গল্প লিখতেন শাহেদ আলী। সেসব গল্প পড়ে আমি তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমি আইএ পাস করি, তারপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হই। জায়গীর থাকি ভাটি মসজিদের কাছে। আমার জায়গীর বাড়ির কাছেই আজিমপুর রোডের ১৯ নম্বর বাসাটি ছিল আবুল কাসেম সাহেবের। সেই বাসাতেই উঠেছিলেন শাহেদ আলী। ১৯৪৮ সালের কথা, একদিন দেখি চায়ের দোকানে শাহেদ আলী বসে আছেন; আমি চা খাই না, শুধু উনার কাছে যাওয়ার জন্যই দোকানে গিয়ে বসলাম। সেখানেই পরিচিত হই, তারপর থেকে মাঝে মাঝেই কথা হতো। একদিন তার সাথে কাসেম সাহেবের বাসাতেও যাই। সেখানে তখন নিয়মিত যেতেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, কাজী মোতাহের হোসেনসহ আরো অনেকেই। এভাবেই কখন যে তমদ্দুন মজলিসের সাথে জড়িয়ে যাই, নিজেও বুঝতে পারিনি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিসের সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ কীভাবে শুরু হলো?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: কালচারাল সংগঠন হলেও শুরু থেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার হয় তমদ্দুন মজলিস। কিন্তু সদ্য পাকিস্তান পেয়ে অধিকাংশ মানুষ এতটাই আবেগপ্রবণ ছিল যে, রাষ্ট্রভাষার দাবির বিষয়ে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। বরং, অনেক ক্ষেত্রে তারা উল্টো রাষ্ট্রভাষার দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধাও দিত। একারণেই ভাষার দাবিতে জনসচেতনতা ও জনমত গঠনে আবুল কাসেম সাহেবকে খুবই পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন হলে নিয়মিত সাহিত্য সভা-সেমিনার করে ভাষার দাবিতে বক্তৃতা দিতেন। অনেক ছাত্র-শিক্ষক সেখানে যোদ দিতেন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ আরো অনেকেই তখন এসব সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করেছেন। ভাষার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস কখনো প্রতিদিন, কখনো প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো প্রোগ্রাম করছিল, প্রোগ্রামের নিউজ বিভিন্ন পত্রিকাতেও পাঠানো হতো। কিন্তু বেশিরভাগ নিউজই ছাপা হতো না। কোনো কোনো পত্রিকাতে আবার ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেও লেখা ছাপা হতো। এসব দেখেই আবুল কাসেম সাহেব চিন্তা করলেন, আমাদের চিন্তাধারাকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে নিজেদের একটি পত্রিকা লাগবে। তারপর ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে প্রকাশ শুরু হলো তমদ্দুন মজলিসের নিজস্ব পত্রিকা সাপ্তাহিক সৈনিক। এর প্রকাশক ছিলেন আবুল কাসেম সাহেব, প্রধান সম্পাদক ছিলেন শাহেদ আলী, অন্যতম সম্পাদক ছিলেন এনামুল হক, আর আমি ও সানাউল্লাহ নূরী ছিলাম সহকারী সম্পাদক। পরে শাহেদ আলী চাকরি নিয়ে চলে যান বগুড়া আজিজুল হক কলেজে এবং এনামুল হক সাহেবও সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তারা চলে যাওয়ার পর আমিই সম্পাদক হই। ৫২ সালের চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় আমার সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হতো সৈনিক পত্রিকা। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পর পর তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল সৈনিক পত্রিকার। এর একটা অফিস ছিল ৪৮ নম্বর কাপ্তান বাজারে আর আরেকটা অফিস ছিল ১৯ নম্বর আজিমপুর রোড আবুল কাসেম সাহেবের বাসায়। শুরুতে এটা বিভিন্ন প্রেস থেকে ছাপা হতো, বছর দুই পরে নিজেদের একটা প্রেস হয়। কবি শামসুর রাহমান তখন ছাত্র। তার লেখাসহ সেসময়ের প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিকের লেখা ছাপা হতো সৈনিক পত্রিকায়।
সৈয়দ ইবনে রহমত: আপনার লেখালেখি কীভাবে শুরু হয়েছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ফরিদপুর মাদরাসায় থাকতেই লেখালেখি করতাম। সেসব লেখা কোথাও প্রকাশ হয়েছিল কিনা এখন সেটা মনে নেই। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত লেখার বিষয় ছিল ‘পাকিস্তানে গণতন্ত্র’। আমি লেখাটা লিখে শাহেদ আলী সাহেবের হাতে দিয়েছিলাম; ভাবছিলাম, কাঁচা হাতের লেখা হয়তো ছাপা হবে না। কিন্তু দেখলাম, শাহেদ আলী সাহেব মাত্র কয়েকটা শব্দ এদিক সেদিক করে পুরো লেখাটাই ছাপতে দিয়ে দিলেন। বাহবা দিয়ে বললেন, অত্যন্ত ভালো হয়েছে। লেখা চালিয়ে যেতে হবে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ পুস্তিকা সম্পর্কে কিছু বলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেটা নিয়ে তখনো স্থির সিদ্ধান্ত হয়নি। এর মধ্যেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জিয়া উদ্দিন দাবি করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তার পক্ষে আরো অনেকেই মত ব্যক্ত করেছিলেন। পক্ষান্তরে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে এবং সাহিত্য সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তার পক্ষেও অনেকে মতামত দিচ্ছিলেন। কিন্তু সেটার সমাধান হওয়ার আগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। আগেই বলেছি, ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস গঠিত হয়। ইতোমধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’ এতে তিনজনের লেখা স্থান পেয়েছিল। মজলিসের পক্ষ থেকে ‘আমাদের প্রস্তাব’ শিরোনামে লিখেছিলেন আবুল কাসেম সাহেব। আর লিখেছিলেন কাজী মোতাহের হোসেন এবং রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। কিন্তু তমদ্দুন মজলিসের দাবি সত্তে¡ও দেখা গেলো, সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার শুরু করে দেওয়া হলো। এই প্রেক্ষাপটে মজলিস ও ছাত্রদের আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া উপায় থাকে না।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তখন কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: সাহিত্য সভা-সেমিনার, হ্যান্ডবিল বিলি এসব কার্যক্রম আগে থেকেই চলছিল, যা জোরদার করা হয়। মজলিসের উদ্যোগে ৪৭ সালেই দল মত নির্বিশেষে সকলকে ভাষা আন্দোলনের সাথ যুক্ত করার জন্য একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহ্য়বাক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির লেকচারার নূরুল হক ভুঁইয়া। এরমধ্যে কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আবুল কাসেম সাহেব বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে কয়েক হাজার বিশিষ্ট লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের বৈঠকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংসদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাতে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দানের দাবি করেন। কিন্তু সে দাবি নাকচ হয়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারিত করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। এটার আহ্বাক করা হয় শামসুল আলমকে। তিনি তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগেরও মেম্বার ছিলেন। এই কমিটির উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্বপাকিস্তানে হরতাল আহ্নবা করা হয়। হরতালে পিকেটিংয়ের সময় ছাত্র এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে আবুল কাসেম সাহেবসহ অনেকে আহত হন। পুলিশ অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেককে আটক করে। এরপর থেকে প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে তাদের সব দাবি মেনে নিয়ে ৮ দফা চুক্তি করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপস্থিতিতে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। এরপর ২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত কনভোকেশনে বক্তৃতা করেন, সেখানেও তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। সেখানে ছাত্রদের মধ্যে অনেকে এর প্রতিবাদ করেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ২১ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট তৈরি হলো কীভাবে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: জিন্নাহ সাহেব ও লিয়াকত আলী খান মারা যাওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ৪৮ সালে নিজের করা চুক্তির কথা ভুলে গেলেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পশ্চিমা নেতাদের খুশি করতে পল্টনের একজনসভায় বক্তৃতায় বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার এই বক্তব্যের পরেই ফুঁসে উঠে পূর্বপাকিস্তান। তৃতীয় বারের মতো গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন বিভিন্ন সংগঠন থেকে দুই জন করে নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস থেকে আবুল কাসেম সাহেব এবং আমি ছিলাম এর মেম্বার। এর আহ্বায়ক করা হয়েছিল কাজী গোলাম মাহবুবকে। এই সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়েই সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করা হবে, আর সে মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে রেডিওতে ঘোষণা করা হলো: ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এর ফলে সেদিন সন্ধ্যায় ৯৪, নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সংগ্রাম পরিষদের এক মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। আবুল হাশিম সাহেবের সভাপতিত্বে সভা হয়। সেখানে ১৪৪ ধারা লংঘন করা না করা নিয়ে মতভেদ হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে জমায়েত অনুষ্ঠিত হবে তাতেই ঠিক করা হবে এব্যাপারে।
পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১২টার দিকে শেষ পর্যন্ত ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেয় ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। শুরুতে ৪ জন ৪ জন করে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়। পুলিশ তাদের আটক করতে থাকলে শুরু হয়ে যায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে একপর্যায়ে গুলি করা শুরু করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকেই শহিদ হন। তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ভাষা আন্দোলনে আপনাদের প্রেরণার উৎস কী ছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ভাষা আন্দোলনে আমাদের প্রেরণার উৎস ছিল আল কোরআন। সুরা ইবরাহিমের চতুর্থ আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, ‘আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে।...’ কোনো জাতির মাতৃভাষা আল্লাহপাকের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই আয়াতে তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো অপূর্ণতা কি উপলব্ধি করেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের আত্মত্যাগ এখন আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি সংরক্ষণ এবং নবীন প্রজন্মের জন্য তা প্রদর্শনের ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারকে ঘিরে একটি ‘ভাষা আন্দোলন কমপ্লেক্স’ করতে পারে। যেখানে একটি জাদুঘর থাকবে, সেখানে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্নগুলো বিশেষ করে তমদ্দুন মজলিস প্রকাশিত পুস্তিকা, সৈনিক পত্রিকার কপিগুলোসহ আরো যা যা পাওয়া যায় সেসব সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ অবহিত হতে পারবে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: শুনেছি, একবার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোনো ডিগ্রি নেবেন না, বিয়ে করবেন না, চাকরি করবেন না।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ১৯৫০ সালের কথা, তমদ্দুন মজলিস, ভাষা আন্দোলন এবং সৈনিক পত্রিকা সব মিলিয়ে সংগঠনের কাজ বাড়ছিল। এ অবস্থায় একদিন আবুল কাসেম সাহেব বললেন, আমাদের এমন একজন সার্বক্ষণিক কর্মী দরকার, যিনি কোনো ডিগ্রি নেবেন না, চাকরি করবেন না, বিয়ে-সংসার করবেন না। উপস্থিত আর কেউই রাজি হলেন না। অবশেষে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন কাসেম সাহেব বললেন, তাহলে কালকেই আপনি জায়গীর বাড়ি ছেড়ে আমার বাড়িতে চলে আসবেন। আমার তখন বাংলায় অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ২/৩ মাস বাকী। সেই অবস্থাতেই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে কাসেম সাহেবের বাড়ি উঠে গেলাম। অনার্সে আমরা তিনজন শিক্ষার্থী ছিলাম। আমি, নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী এবং মমতাজ বেগম। আমার দেখাদেখি নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী সে বছর পরীক্ষা দিলেন না। ফলে মমতাজ বেগম একাই পরীক্ষা দিয়ে তৃতীয় বিভাগ পেয়ে ফার্স্ট হয়ে গেলেন। পরে তিনি ইডেন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: আবার পড়ালেখা শুরু করলেন কীভাবে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার খবর পেয়ে আমার আব্বা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। হতাশ হয়ে তিনি জমি বিক্রি করে হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রামে যখন তাকে জাহাজে তুলে দিতে যাই, তখন তিনি আমার প্রতি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এটা আমার মনে দাগ কেটেছিল। তাছাড়া, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথা জেনে তিনিও কষ্ট পেলেন। পরে আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী রেজিস্ট্রার ক্ষিতিশ চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে, কোনো একটি ডিগ্রির ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা সে জন্য। রেজিস্ট্রার আমার কথা শুনে বললেন, আপনি তো মূলত আইএ পাস। পরে তিনি শহীদুল্লাহ সাহেবের রিকমন্ডেশনে জগন্নাথ কলেজে নাইট শিফটে একবছরে বিএ পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখান থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্সে ভর্তি হই। ১৯৬২ সালে এমএ পাস করে বের হওয়ার পর সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগের এক নিয়োগ পরীক্ষার জন্য গেলাম। সেখানে আমার কাগজপত্র দেখে শুধু বলা হলো, ঢাকায় কোনো পোস্ট নেই। ঢাকার বাইরে কোথায় নিয়োগ পেতে চান, বলেন। তমদ্দুন মজলিসের কাজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছি। এর মধ্যে চট্টগ্রামেই আমার জানাশোনা বেশি ছিল। সেখানের কথাই বললাম। সাথে সাথেই চাকরি হয়ে গেল চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট সমাজ কল্যাণ অফিসার পদে। চট্টগ্রাম চলে গেলাম। সেখানে একবছর ছিলাম।
সৈয়দ ইবনে রহমত: কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ইচ্ছা ছিল প্রফেসর হওয়ার। চট্টগ্রামে গিয়ে খবর পেলাম ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগ খোলা হয়েছে, সেখানে শিক্ষক নিয়োগ হবে। সেখানে আমার কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেখানকার ডিসি সাহেব সেসব দেখে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দিয়ে দিলেন। তখন সেটা ছিল বেসরকারি কলেজ। কিছুদিনের মধ্যেই সেটি সরকারি হয়ে যায়। কিন্তু আমার ছিল বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস। সরকারি হওয়ার পর কোথায় কী বক্তব্য দিচ্ছি সেই সম্পর্কে ডিসি সাহেবকে বলে যেতে হতো, লিখিত বক্তৃতার নোট দিয়ে আসতে হতো। এসব আমার ভালো লাগেনি। তাই সাত বছর পর সেখান থেকে চলে আসি ঢাকায়। ঢাকায় এসে যোগ দেই আবুজর গিফারী কলেজে। সেখানে নিয়মিত বেতন হতো না। ফলে এক সময় দৈনিক দেশ পত্রিকায় যোগ দেই।
সৈয়দ ইবনে রহমত: বিয়ে সংসার করা সম্পর্কে কিছু বলুন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ১৯৫০ সালে বিয়ে করব না বলে প্রতিজ্ঞা করলেও, বাস্তবতার কারণে ও পরিবারের চাপে সেটা ভাঙতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ২৪ অক্টোবর বিয়ে করি। আমাদের সংসারে তিন মেয়ে, তিন ছেলে আছে। স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ২০২০ সালের ১০ জুন ইন্তেকাল করেছেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিস সম্পর্কে আরো কিছু জিজ্ঞাসা ছিল, এটি কি শুধুই সাংস্কৃতি সংগঠন নাকি রাজনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারাও প্রভাবিত ছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: তমদ্দুন মজলিস একটি কালচারাল অর্গানাইজেশন। তবে কোনো জাতির রাজনীতি আর সংস্কৃতির মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক সব সময়ই থাকে। তাছাড়া সংস্কৃতির স্বাধীনতা ছাড়া তার রাজনৈতিক স্বাধীনতার তেমন কোনো মূল্য থাকে না। আবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সংস্কৃতিক স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় না। যেমনটা দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, তাদের বাঙালি সংস্কৃতি আজ রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে হিন্দির আগ্রাসনের শিকার। এসব কারণে কোনো কোনো সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক এবং কালাচারাল সংগঠনের মধ্যে একটা যোগসূত্র হয়ে যায়। তমদ্দুন মজলিসের কোনো কোনো নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেটা হয়েছে। তারা একই সাথে মজলিস এবং রাজনৈতিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। তবে সংগঠন হিসেবে মজলিস কখনো রাজনীতিতে জড়ায়নি।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিসের সাথে রাজনৈতিক অনেক নেতাও ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর: তমদ্দুন মজলিসের ফাউন্ডারদের মধ্যে আবুল কাসেম সাহেব ছাড়া অনেকেই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন। বিশেষ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলমের নাম উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া, আজিমপুরের ১৯ নম্বরের বাসায় অনেক রাজনীতিবিদেরও আসা যাওয়া ছিল। মওলানা ভাসানী থাকতেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। কিন্তু তিনি ঢাকায় এলে একবার হলেও কাসেম সাহেবের বাসায় আসতেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ছাত্রলীগের সাথে তমদ্দুন মজলিসের সম্পর্ক কেমন ছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারপর ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছাত্রলীগ। তমদ্দুন মজলিসের অনেকে ছাত্রলীগের সাথেও যুক্ত হন। ফলে সংগঠন দুটির মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ছাত্রলীগ মজলিসের কর্মসূচিতে এটেন্ড করত। এমনকি বাঘেরহাট এবং জামালপুরে একই অফিসে মজলিস এবং ছাত্রলীগের কার্যক্রম চলত। পরে যখন ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সভাপতি হন মওলানা ভাসানী। তিনি ছাড়াও এ সংগঠনের প্রথমসারির অনেক নেতাকর্মী ভাষা আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক বা সমর্থক ছিলেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: তমদ্দুন মজলিসের সাথে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার কোনো যোগসূত্র ছিল কিনা?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: তমদ্দুন মজলিসের মধ্যে বিপ্লবী চিন্তাধারা ছিল, তবে সেটা নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্ট চিন্তাধারা ছিল না। মজলিসের চিন্তাধারা ছিল ইসলামি ভাবধারার। অবশ্য কমিউনিস্ট চিন্তাধারার কেউ কেউ ভাষা আন্দোলনে মজলিসের সাথে ছিলেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: যে চেতনায় তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার প্রভাব কতটা পড়েছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: আমাদের দেশের রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তমদ্দুন মজলিসের প্রভাব অবশ্যই আছে। তমদ্দুন মজলিসের লক্ষ্য ইসলাম এবং বাংলা ভাষা। শুরুতে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত ছিল। কিন্তু আজকে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কাউকে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে এদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেও কেউ পার পায় না।
সৈয়দ ইবনে রহমত: আমাদের বর্তমান রাজনীতি কি তমদ্দুন মজলিসের চেতনা থেকে উৎসারিত বলে মনে হয়?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: শুরুতে পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতি তমদ্দুন মজলিসের চেতনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তখনকার রাজনীতিবিদরা সেটা লালন করতেন। কিন্তু ভাষার দাবি পূরণের পর যখন আমরা স্বাধীনতাও পেয়ে যাই, তখন থেকে অনেকের কাছে মূল চেতনার প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। সে কারণেই আজকের বাস্তবতা দেখলে মনে হয়, রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সাথে তমদ্দুন মজলিসের যেন কোনো সম্পর্কই নেই। এটা আসলে কাম্য না। কেননা, বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি দুটি। একটি হলো ইসলাম এবং অন্যটি বাংলা ভাষা; তমদ্দুন মজলিসের চেতনাও কিন্তু এই দুটি। এর কোনো একটিকে বাদ দিয়ে এদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ভবিষ্যতে কঠিন হবে। আমাদের রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসায়। মাদরাসায় স্টুডেন্টস হোমে থাকতাম। তিনি কলকাতায় থাকতেন। জনপ্রিয় ছাত্র নেতা ছিলেন। মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতেন। একবার ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আমাদের মাদরাসায় গিয়েছিলেন। মাদরাসার ছাত্র নেতাদের সাথে নিয়ে হোস্টেলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমরা রুমের জানালা দিয়ে দেখেছি। তিনি একটা বিশেষ ভঙ্গি নিয়ে হাঁটছিলেন। ছাত্ররা উনাকে সালাম দিচ্ছে, আর উনি হাত উঁচিয়ে তার জবাব দিচ্ছেন।
সৈয়দ ইবনে রহমত: ভাষা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার কি কখনো দেখা হয়েছে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্বপাকিস্তানে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল ডাকা হয়েছিল। হরতালে পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে আবুল কাসেম সাহেবসহ আরো কয়েকজন পিকেটিং করতে গিয়ে আহত হন। সেদিন অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। পিকেটিংয়ে আমিও ছিলাম, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার সেদিন দেখা হয়নি। তবে ১৯৫৩ সালের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে একটা মিটিং ছিল। সে মিটিংয়ে কেউ কেউ দাবি করলেন, দুইটা না বরং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে সাতটা। ইংরেজি, উর্দু, বাংলার পাশাপাশি পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ এবং পশতু ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এই দাবিকে উপস্থিত কমিউনিস্টরা সমর্থন করল। আমরা এটাকে একটা ষড়যন্ত্র মনে করলাম। কারণ, যারা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিই করেনি, সেটা আমরা কেন করব? তাছাড়া সাতটা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষার দাবিটাও বানচাল হয়ে যেতে পারে। সেকারণেই এর বিরোধিতা করে আমি একটি প্রবন্ধ পাঠ করলাম। পরে আমার যুক্তিকে সমর্থন করে সে মিটিংয়ে বক্তৃতা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সৈয়দ ইবনে রহমত: অনেকে বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। আপনি কী বলেন?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: এটা অবশ্যই সঠিক। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল এবং তার ধারাবাহিকতার মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। তবে শুরুতে আমাদের চিন্তায় এটা ছিল না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি প্রথমে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে, পরে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরিসহ নানান দিক থেকেই আমাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। এসবের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধীনতার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন আপনাদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু সেটা কি পূরণ হয়েছে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: এটা ঠিক, সর্বস্তরের বাংলার প্রচলন আমাদের লক্ষ্য ছিল। তখন অনেকেই বলতেন, সেটা সম্ভব না। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলন সম্ভব না। কিন্তু সেই সময় আবুল কাসেম সাহেব, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ প্রমুখ উদ্যোগ নিয়ে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দেন যে সেটাও সম্ভব। আমরা চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নির্দেশ দিয়েছিলেন সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের। দুঃখের বিষয় হলো, দেশ স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর। সর্বস্তরে বাংলার পক্ষে জনমত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও আছে। কিন্তু তারপরও সেটা পুরোপুরি হচ্ছে না। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা, অফিস-আদালত এবং উচ্চ আদালতে এখনো ইংরেজিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটা আসলে আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
সৈয়দ ইবনে রহমত: আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ কেমন হওয়া উচিৎ?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: এদেশের ৯০ ভাগের বেশি মানুষ মুসলমান। তাই তাদের সংস্কৃতিও হতে হবে ইসলামি মূল্যবোধ সমৃদ্ধ। তাছাড়া ইসলামের কারণেই পাকিস্তান হয়েছিল। আর পাকিস্তান হয়েছিল বলেই ভাষার প্রশ্নে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এই সত্যকে যে সংস্কৃতি ধারণ করবে সেটাই আমাদের সংস্কৃতি। এখন তো কেউ কেউ কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতিকে আমাদের সংস্কৃতি বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো হিন্দি প্রভাবিত সর্বভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে কলকাতার বাঙালিদের সংস্কৃতি আজ বিলীন হওয়ার পথে। যতটুকু টিকে আছে সেটাও পূজা-পার্বণ আর কিছু সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এখন আমরাও কি কলকাতার বাঙালিদের মতো হিন্দি প্রভাবিত সর্বভারতীয় সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হবো? অবশ্যই আমরা সেটা চাই না। এ কারণেই ইতিহাস, ঐতিহ্য, ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করেই আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে।
সৈয়দ ইবনে রহমত: সাংবাদিকতা করেছেন কোথায় কোথায়?
অধ্যাপক আবদুল গফুর: পাক্ষিক জিন্দেগী, সাপ্তাহিক সৈনিক, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক নাজাত, দৈনিক আজাদ, দ্য ডেইলি পিপল এবং দৈনিক দেশ পত্রিকায় কাজ করেছি। দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ৪ জুন থেকেই ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।