Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বার্থ উদ্ধারে চিন্তিত ভারত

মিয়ানমারে অভ্যুত্থান

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৫ এএম

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দার ঝড় উঠলেও তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এ বিষয়ে নীরব রয়েছে। তাদের চিন্তা মূলত বার্মায় ভারতের চলমান কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প নিয়ে। রাখাইনের ভেতর দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা উৎখাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অন্যতম একটি স্বার্থও ছিল ব্যবসা। রাখাইনে রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। রাখাইনের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বও রয়েছে। এ কারণেই দেখা যায় যুগ যুগ ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গারা যেসব অঞ্চলে ছিল, সেখান থেকে উৎখাত করে তাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওইসব অঞ্চল এখন বিনিয়োগের জন্য দেয়া হয়েছে জাপানি ও চীনা বিনিয়োগকারীদের। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যা তাতমাদো নামে পরিচিত, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে। মূল্যবান পাথর তথা ‘জেম’-এর জন্য মিয়ানমারের বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। এই মূল্যবান ‘জেম’ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন শীর্ষ জেনারেলদের পত্মীরা। রাখাইনে রয়েছে এর অস্তিত্ব। ফলে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করে সেখানে মাটির নিচ থেকে গভীর ক‚প খনন করে সেই মূল্যবান ‘জেম’ আহরণ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর জাপানিরা সেখানে বিনিয়োগ করছে।

মিয়ানমারে চীন ও জাপানের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ভারত। ফলে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের মাধ্যমে তারাও সেই ব্যবসায় ভাগ বসাতে চাইছে। এর আওতায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের সাতবোন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজল সংযুক্ত হয়েছে। কলকাতা থেকে পণ্য ৫৩৯ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের সমুদ্রবন্দর সিটওয়েতে (রাখাইন) নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে কালাদান নদীর ১৫৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়া হবে নদীবন্দর পালেটাওয়াতে (মিয়ানমারের চিন স্টেট)। এরপর ১৬২ কিলোমিটার মহাসড়ক হয়ে পণ্য যাবে আইজলে।

ভারত এজন্য সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর উন্নত করছে, একই সঙ্গে মহাসড়ক উন্নয়নেও বিনিয়োগ করছে। ফলে বোঝাই যায় মিয়ানমারের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থ কেন এত বেশি। এখন বাংলাদেশ ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব করছে। তবে ভারতের জন্য এ ক্ষেত্রে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এই প্রস্তাবে মিয়ানমার নাও রাজি হতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে এই রুট বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারত। বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় যেতে পারত। ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হতে পারত। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশই লাভবান হতো। প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডরও সাফল্যের মুখ দেখত।

ফলে মিয়ানমারের সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এই ব্যবসাগুলো জড়িত। অর্থাৎ পাশ্ববর্তী দুটো বড় দেশ চীন ও ভারতের স্বার্থ যখন বেশি, তখন দেশ দুটি মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে না। প্রতিবেশী আরেকটি দেশ থাইল্যান্ডেরও স্বার্থ রয়েছে (রাখাইনের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস যাচ্ছে থাইল্যান্ডে)। যে কারণে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে থাইল্যান্ড কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর চলতি সপ্তাহেই জানিয়েছেন, কালাদান প্রকল্পে এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। মিয়ানমারে যা-ই ঘটুক না কেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে তার কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই ভারতের বিশ্বাস। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে ভারতের যে কোনও অস্বস্তি নেই এটা তারই প্রমাণ।

প্রায় সাত বছর আগে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে এখন সেখানে কাজ চলছে ঝড়ের গতিতে। আর দুই দিন আগে আসাম সফরে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বুঝিয়ে দিয়েছেন, মিয়ানমারে ক্ষমতায় কারা আছে, তার সঙ্গে কালাদানের কোনও সম্পর্ক নেই। বার্মা সফরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কালাদান আসলে মিয়ানমারের খুব দুর্গম একটা এলাকায় অবস্থিত। তারপরও প্রজেক্টের অনেকটা অংশ, যেমন সিতওয়ে সমুদ্রবন্দর, পালেতোয়া নদীবন্দর চালু হয়ে গেছে।’ এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘নদীর নাব্যতা নিয়ে সমস্যা হওয়ায় প্রজেক্টে আমাদের রাস্তার অংশটা বাড়াতে হয়েছে, আর দেরিটা হয়েছে সেখানেই। কিন্তু এখন আমরা খুবই আত্মবিশ্বাসী যে প্রকল্পের কাজ আমরা দ্রুতই শেষ করে ফেলবো।’

কালাদান প্রকল্প মিয়ানমারের যে দুইটি প্রদেশের ভেতর দিয়ে গেছে, সেই শিন আর রাখাইনে বেইজিং-এর প্রভাব মোকাবিলাও ভারতের একটা প্রধান লক্ষ্য। এমনটাই মনে করছেন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘শিন আর রাখাইন, দুই রাজ্যেই কিন্তু চীনের অনেক সংশ্লিষ্টতা আছে। ফলে ভারত মনে করে সেখানে কালাদান নিয়ে তাদের পিছপা হলে চলবে না। তাছাড়া ভারত যে মিয়ানমার আর্মির প্রতি আজকে হঠাৎ ‘সফট’ হয়ে উঠেছে, বিষয়টা কিন্তু মোটেই তেমন নয়। সেই ১৯৯০ থেকেই সম্পর্কের এই রূপান্তরটা ঘটেছে। আর তা ভারতকে অনেক ডিভিডেন্ড বা সুফলও এনে দিয়েছে।’

জয়িতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকেও বঙ্গোপসাগরকে ভারত ছাড়তে পারবে না। সেখানেও ভারতের এনগেজমেন্ট বা ইনভলভমেন্ট দরকার, কালাদান সেটাও নিশ্চিত করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের এখন রাষ্ট্রীয় নীতিই হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে ধরনের সরকারই থাকুক না কেন তার রাজনৈতিক চরিত্র বিচার্য নয়; বরং সম্পর্কটা হবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে।’ ফলে অন্যভাবে বললে নেপিডো-তে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় কি না, সেটা এখন ভারতের কোনও মাথাব্যথা নয়। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে এ মাসের গোড়ার দিকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারত কিন্তু একবারের জন্যও ‘ক্যু’ বা অভ্যুত্থান শব্দটা ব্যবহার করেনি। সূত্র : বিবিসি, হিন্দুস্থান টাইমস, ডব্লিউআইওএন।



 

Show all comments
  • বাদল বাদল ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:৩৪ এএম says : 0
    ভারত স্বার্থপর একটা দেশ।
    Total Reply(0) Reply
  • জাহিদ খান ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:৩৪ এএম says : 0
    ভারতের মতো সেলফিশ দেশ খুবই কম পাওয়া যাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নীল আকাশ ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১:৩৫ এএম says : 0
    ভারত তাদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Rîîyan Rââj ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৯:১৫ এএম says : 0
    তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না।
    Total Reply(0) Reply
  • মেহেদী ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৯:১৬ এএম says : 0
    আজব একটা দেশ যার কোনো প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Monjur Rashed ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১২ পিএম says : 0
    Realistic report.
    Total Reply(0) Reply
  • smt akash ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১০:০০ পিএম says : 0
    কি মন্তব্য করব। ভারত সম্পর্কে।এদের আচরনই হল বিমাতা সুলব।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ