পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সমুদ্রে অবস্থিত বিশাল পানিরাশি এবং এর তলদেশের বিশাল স¤পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন দিগšত উন্মোচন হয়েছে বøু ইকোনমির মাধ্যমে। বøু ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র স¤পদনির্ভর অর্থনীতি। সাগরের অজস্র স¤পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব। সমুদ্র জয়ের পর সে বিপ্লব বা¯তবায়নের রোডম্যাপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ।
১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি সমুদ্র স¤পদনির্ভর টেকসই ও পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির ধারণা দেন। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ বিস্তৃত পানির বিচিত্র স¤পদ ব্যবহার করে ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি। বিশ্বের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বøু ইকোনমি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। ভৌগোলিকভাবে আমাদের দেশের অবস্থানও অফুরন্ত স¤পদের ভান্ডার বঙ্গোপসাগরের তীরে। এ স¤পদকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের বেকারত্ব দূর হবে, অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে। এ সম্ভাবনাকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ জনবল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি, গভীর-অগভীর সমুদ্রে প্রাণিজ ও খনিজস¤পদ আহরণে গবেষণা ও জরিপ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বিদেশি দক্ষ কো¤পানির সাহায্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্রস¤পদের অবদান মাত্র ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা ৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিদ্রুত সুচিšিতত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে অর্থনীতির কেন্দ্রে রূপান্তর করে বাংলাদেশ সামুদ্রিক স¤পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে।
বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। ভ‚-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, এশিয়ার পরাশক্তি চীন স্থলপথে বাণিজ্য বাড়াতে ওয়ান বেল্ট রোড তথা সিল্ক রোড বানাচ্ছে। ঠিক তেমনি সমুদ্রপথেও বঙ্গোপসাগর এলাকা দিয়ে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ততপর চীন। আরেক পরাশক্তি ভারতও বসে নেই। ফলে আমাদের অঞ্চলটির কৌশলগত গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। এ অঞ্চলে আমাদের প্রতিবেশী স্থলবেষ্টিত দেশ হলো নেপাল ও ভুটান। বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আকাশ কিংবা স্থলপথের তুলনায় পানিপথে খরচ খুবই কম। তাই তারা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চাইলে বন্দর সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রের মালিক। আর এই নীল পানিরাশির মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিচিত্র সামুদ্রিক স¤পদ। তেল, গ্যাস, মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, শামুক, ঝিনুক, মাছ, অক্টোপাস, হাঙ্গর ইত্যাদি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও খনিজস¤পদ রয়েছে সাগরে। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে মৎস্য স¤পদের বিশাল ভান্ডার। এখানে প্রায় ৫০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। আরও রয়েছে ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক। এছাড়াও রয়েছে টুনা মাছের মতো দামি ও সুস্বাদু মাছ, যার রয়েছে প্রচুর আন্তর্জাতিক চাহিদা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ)-এর মতে, ২০২২ সালের মধ্যে যে চারটি দেশ মৎস্য স¤পদে বিপুল পরিমাণ সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ২০১৭-১৮ সালে সারা দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার মাছের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ ছিল ৬০ লাখ মেট্রিক টন; যদিও ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে। ৬০০ কিলোমিটার সমুদ্রসীমার মধ্যে মাছ ধরার সীমা মাত্র ৩৭০ কিলোমিটার। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তির অভাবে এ দেশের জেলেরা মাত্র ৭০ কিলোমিটার পর্যšত মাছ ধরতে পারে। ফলে বিপুল পরিমাণ মৎস্যস¤পদ থাকার পরও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে বিপুল পরিমাণ স¤পদ কাজে লাগাতে হবে। প্রতি বছর আমরা স্বাদু পানির মৎস্য রপ্তানি করছি। তবে সারা বিশ্বে স্বাদু পানির মাছের তুলনায় সামুদ্রিক মাছের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দুই-ই বেশি। এদিক দিয়ে সফল হলে মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। সেই সঙ্গে নিজেদের মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তো রয়েছেই। গবেষকদের মতে, সামুদ্রিক স¤পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
পর্যটনশিল্প আয়ের এক বৃহৎ উৎস। আমাদের রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত। এছাড়া রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের মন মাতানো সৌন্দর্য, প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনে সমৃদ্ধ দেশের নানা দর্শনীয় স্থান। পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এ শিল্পকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি প্রচুর আয় করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। পর্যটকদের থাকার স্থান চমৎকারভাবে গড়ে তুলতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তবেই ঢল নামবে পর্যটকদের, অর্থনীতি পাবে বহুমাত্রিকতা, কমবে বেকারত্ব, বাড়বে কর্মসংস্থান।
সমুদ্রের বিস্তৃত পানিরাশি এবং তার তলদেশের অফুরšত প্রাকৃতিক স¤পদ আহরণের জন্য প্রস্তুতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক স¤পদগুলোর অস্তিত্ব সাধারণত ১ হাজার ৪০০ মিটার থেকে ৩ হাজার ৭০০ মিটারের ভেতর থাকে। এই স¤পদ আহরণ করা অত্যন্ত টেকনিক্যাল একটি বিষয়। সেজন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে মালিকানা পেয়েছে, সেখানে চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে পুরোপুরি সফলতা পাওয়া সম্ভব। এই চারটি ক্ষেত্র হলো- তেল, গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য স¤পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা স¤প্রসারণ ও পর্যটন।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন ডলার শিল্প হল নৌ-যান নির্মাণ শিল্প। এ সুযোগ লুফে নিয়ে সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশীয় জাহাজ বহর সমৃদ্ধ করতে পারলে রাজস্বে মোটা অঙ্কের আয় যুক্ত করা সম্ভব। বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ নীল জলরাশির স¤পদে অগ্রাধিকার দেয়ার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে, যাতে গুরুত্ব পাবে সমুদ্র স¤পদ ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনা বা¯তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে, পরিকল্পিতভাবে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করতে হবে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে।
উপক‚লীয় অঞ্চলের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা সমুদ্রস¤পদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের ট্রলারগুলো উপক‚ল থেকে ৭০ কিলোমিটারের বেশি গভীরে মাছ ধরতে পারে না। আবার এর বাইরে ৬০০ কিলোমিটার বেশি সমুদ্র অঞ্চলে আমাদের মাছ ধরার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রস¤পদ আহরণের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিনিময় ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এতে করে সামুদ্রিক স¤পদ আহরণে বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।