চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনে শূকরের চর্বির উপাদান ব্যবহার করার কারণে ইউরোপ-আমেরিকার মুসলমানরা এ ভ্যাকসিন নিতে অনিহা প্রকাশ করছেন। করোনার ভ্যাকসিন হালাল না হারাম এ সম্পর্কে কোরআন সুন্নাহ কী বলে আসুন জেনে নিই।
কোনো কোনো ভ্যাকসিন কোম্পানি শূকরের চর্বি ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে একথা সত্যি যে, বিভিন্ন ওষুধ সংরক্ষণে শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়ে থাকে। সত্যিই যদি করোনার ভ্যাকসিন অথবা অন্য কোনো ওষুধে শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়ে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে ইসলামী শরিয়েতের দুটো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে।
প্রথমত, বিকল্প কোনো ওষুধ পাওয়া না গেলে জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম উপাদানে তৈরি ওষুধও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ জায়েজ। এ ব্যাপারে সূরা বাকারার ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘একান্ত নিরুপায় অবস্থায় গোনাহ করার ইচ্ছা ছাড়া শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাদ্য খেলে কোনো অপরাধ নেই।’ সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘গোনাহ করার ইচ্ছে ছাড়াই কেউ যদি জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে হারাম খায়, তার জেনে রাখা উচিত আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’
এ দুটো আয়াত প্রমাণ করে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনমত হারাম খেলে কোনো গোনাহ হবে না। করোনার ভ্যাকসিন তো আমরা খাচ্ছি না, শরিরে পুশ করছি মাত্র। জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম খাওয়া যদি জায়েজ হয়, তাহলে শূকরের চর্বি ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ব্যবহার করা কেন জায়েজ হবে না! হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ এবং জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) চর্মরোগে আক্রান্ত হলে রাসুল (সা.) তাদের রেশমি পোষাক পড়ার অনুমিত দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, রোগের কারণে হারাম বস্তু ব্যবহার করা জায়েজ। (সূরা আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪০৫৬।)
এবার দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গীটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। সূরা আনআমের ১১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য যা যা হারাম করা হয়েছে, আল্লাহ তা সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন।’ এ সূরারই ১৪৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদিদের জন্য গরু ও ছাগলের চর্বি হারাম করেছি। তবে পিঠ-পেঠ ও হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকা চর্বি হালাল ছিলো।’ তার মানে একটি প্রাণীর কী এবং কতটুকু অংশ হালাল বা হারাম তা আল্লাহর কিতাবে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়। সূরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হুররিমাত আলাইকুমুল মাইতাতু ওয়াদদামু ওয়া লাহমুল খিনজির। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে- মৃত পশু, রক্ত এবং শূকরের মাংস।’ লক্ষণীয় ব্যপাার হলো, আয়াতে ‘লাহমুল খিনজির’ বলা হয়েছে। লাহমুন অর্থ গোশত। করোনার টিকায় শূকরের গোশত ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যবহার করা হচ্ছে চর্বি। চর্বির আরবি হলো শাহমু। তারমানে শূকরের মাংশ হারাম, চর্বি সরাসরি কোরআনের আয়াতের আলোকে হারাম নয়। আয়াতে ‘শূকরের মাংস’ শব্দটা খাস। শুধু মাংসই হারাম। চর্বি বা শূকরের অন্যান্য বিষয় যদি হারাম হতো তাহলে আল্লাহ বলতেন, তোমাদের জন্য শূকর হারাম করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট করে ‘শূকরের মাংস’ বলে দিয়েছেন।
তার মানে কি আমরা বলতে চাচ্ছি শূকরের চর্বি হালাল? না, আমরা মোটেও সে কথা বলছি না। আমরা তাই বলছি, যা মিশর ও মালশিয়ার একদল আধুনিক আলেম বলেছেন। তাদের ফতোয়া হলো, ওষুধে ব্যবহৃত শূকরের চর্বি হারাম নয়। প্রক্রিয়াজাত করার কারণ চর্বি বা জেলাটিন থেকে শূকরের বৈশিষ্ট ও নাজাসাত দূর হয়ে যাওয়ার কারণে তা হালাল হয়ে যায়। সৈয়দ আমীর আলী দ্য স্পিরিট অব ইসলাম গ্রন্থে স্পষ্ট বলেছেন, শূকরের কোনো অংশ থেকে প্রক্রিয়ারজাত করে নাজাসাত তথা অপবিত্রতা দূর করতে পারলে তা ব্যবহার করা জায়েজ হবে। হালাল প্রাণীর যেমন সবকিছুই হালাল নয়। তেমনি হারাম প্রাণীরও সবকিছু হারাম নয়। গরুর পেশাব-পায়খানা হারাম। কিন্তু গরুর গোবর যদি শুকিয়ে যায়, তাহলে তা পবিত্র হয়ে যায়। একবার একটি মৃত ছাগল দেখে রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা এর চামড়া শোধন করে ব্যবহার করো। সাহাবিরা বলল, ওটা তো মরে গেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, মরা ছাগল খাওয়া হারাম, কিন্তু দাবাগাত-প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা তো হারাম নয়। (বুখারি, হাদিস নম্বর ১৪৯২; মুসলিম, হাদিস নম্বর ৩৬৩।) বুখারির অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘উম্মুল মোমিনিন সওদা (রা.) বলেন, ‘একটি ছাগল মরে গেলে আমরা তার চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে মশক বানিয়ে ব্যবহার করি এবং তাতে খেজুরের শরবত পান করি।’ (ড. ইউসুফ আল কারজাভি, আল হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, ৭৪ পৃষ্ঠা।
তাহলে ‘আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তাতে শেফা নেই’- এ হাদিসের ব্যাখ্যা কী? বুলুগুল মারামের কিতাবুল হুদুদে এ হাদিসটি এসেছে। উম্মে সালামা (রা.) নবী (সা.) থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসদের গবেষণায় হাদিসটি সহিহ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তাতে রোগমুক্তি নেই।’ এ হাদিসের অনেক ব্যখ্যা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, শূকরের চর্বি সরাসরি ব্যবহার করা হালাল সেকথা আমরা বলছি না। আমরা বলছি, প্রক্রিয়াজাত করে তা ব্যবহার করা জায়েজ। অবশ্য বিশেষজ্ঞ আলেমদের ভিন্ন মতও রয়েছে। শূকরের চর্বি যদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হারাম হতো, তাহলে তো এতে মরণঘাতক করোনাভাইরাসের শেফা থাকত না। এ জন্যই কোরআনে আল্লাহ শূকরের মাংস হারাম করেছেন। চর্বির কথা উল্লেখ করেননি। আল্লাহ অবশ্যই জানতেন, একদিন পৃথিবীর বুকে মরণব্যধি করোনা ভাইরাস আসবে, দুনিয়া উলট-পালট হয়ে যাবে। তখন মানুষ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে শুকরের চর্বি ব্যবহার করবে। কেউ যদি শূকরের চর্বি ব্যবহার হয়েছে এ অজুহাতে ভ্যাকসিন না নেয় তাকে আমি কোরআনের এ সতর্কবাণী শুনিয়ে দিতে চাই- ‘তোমরা নিজেকে নিজে মেরে ফেলো না।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৯৫।)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।