পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃত। এই অধিকার বাংলাদেশে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সবার জন্য উন্নত উৎস থেকে পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে কতটা সম্ভব হয়েছে, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। মানুষের জন্য বিশুদ্ধ উৎসের পানি সরবরাহ এখনও সীমিত পর্যায়েই রয়েছে। মলের জীবাণু রয়েছে এমন উৎসের পানি পান করছে এদেশের ৪১ শতাংশের বেশি মানুষ। শহরাঞ্চলে যে পানি খাওয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশেই উচ্চমাত্রার ই-কোলাই ব্যাক্টেরিয়া থাকে, যা ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ। উৎস থেকে বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহের সময় এতে আরও বেশি ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া মিশে যায়। পাহাড়ি এলাকা, শহর, বস্তি, দ্বীপাঞ্চল, উপক‚লীয় ও জলাভূমিতে এই পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব জায়গায় বিশুদ্ধ পানির উৎস পাওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে পুরোপুরি নিরাপদ পানি পানের সুযোগ এখনও সীমিত, মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। অগ্রগতি সত্তে¡ও এক কোটি ৯৪ লাখ মানুষ এখনও সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। এছাড়া পানিতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরাইড ও লৌহ দূষণের কারণেও খাওয়ার পানির মান খারাপ থাকে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ পানির উৎসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি পাওয়া যায়। পাহাড়ি এলাকা, শহরের বস্তি, দ্বীপাঞ্চল, উপক‚লীয় ও জলাভূমিতে বিশুদ্ধ পানি সর্বরাহ পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। সারা দেশের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও হাইজিনের অবস্থা ভালো না হওয়ায় সেগুলো থেকেও জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং তা নবজাতক ও মাতৃ মৃত্যু হার কমানোর অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে যত নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে তার প্রায় ২০ শতাংশই হয়েছে জীবাণু সংক্রমণের কারণে। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দুটি, অর্থাৎ বাংলাদেশের ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া দূষিত উৎসের পানি পান করে। আবার ঘরের কল বা টিউবওয়েলের আশপাশ পরিষ্কার না থাকায় বিভিন্ন অণুজীবযুক্ত পানি পানকারীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় নয় কোটি ৯০ লাখ। এছাড়া ঘনঘন বন্যা, ভূমিধ্বস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে শৌচাগার উপচে ময়লা ছড়িয়ে পানির উৎস দূষিত হয়ে পড়ে। শিল্পবর্জ্য, সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং জমিতে লবণাক্ত পানির কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণও বাংলাদেশে পানির গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট কাটছে না। দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় পানির সঙ্কট অত্যন্ত প্রবল। ওয়াসা এমডির দাবি ‘বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা ২২৫ কোটি লিটার পানি প্রতিদিন সরবরাহ করছে। এর বিপরীতে ২০০ কোটি থেকে ২১০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। তাহলে রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানির এতো অভাব কেন? ওয়াসার দাবি তার সরবরাহ করা পানি শতভাগ বিশুদ্ধ। অথচ একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। তাতেও পানি দুর্গন্ধমুক্ত সুপেয় হচ্ছে না। আর বাসাবাড়িতে এই পানি ফোটাতে বছরে পোড়াতে হয় ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস, যার আর্থিক মূল্য ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
ঢাকা ওয়াসার পানি দূষিত হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে ৪টি প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। তা হলো, (১) ভূগর্ভস্থ পানি ছাড়া নদী থেকে সরবরাহ করা পানি সঠিক উপায়ে শোধন না করা, পানির জলাধারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ না করা তদুপরি শোধনাগারে পানি শোধনের সময় সঠিক পরিমাণে শোধন কেমিক্যাল না দেয়া, (২) পর্যাপ্ত দূরত্ব রক্ষা না করে সমান্তরালে পানির লাইন ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন স্থাপন, নাগরিক সচেতনতার অভাব এবং ওভারহেড ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার না করা। ঢাকা শহরের বহু পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন লাইন যুগ-প্রাচীন। সেই কবে স্থাপন করা হয়েছে। এরপর জোড়াতালি ছাড়া কার্যত কিছু করা হয়নি। তদুপরি অনেক ক্ষেত্রে লাইনগুলো গায়ে গায়ে লাগানো। ফলে কোনো কারণে দুটি লাইনের কোনো একটি অংশ ফেটে বা ভেঙে গেলে খাবার পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা মিশে যায়, (৩) অনেক সময় রাস্তার পাশের বাসিন্দা পানি বা সুয়্যারেজ লাইন নেয়ার জন্য লোক নিয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা থাকে অদক্ষ। ফলে কোদাল চালাতে গিয়েও পাইপ ফেটে যায়। খাবার পানির সঙ্গে ময়লা মিশ্রিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, (৪) ওভারহেড ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার না করাও পানি দূষিত হয়ে পড়ার জন্য কম দায়ী নয়। এর ফলে ট্যাঙ্কে শুধু শেওলা জমে না, ইঁদুর-বিড়াল পড়ে ও পচে-গলে পানি দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত করে। অথচ কি গরম কি শীত! সব সময়ই মনে হয়, গলাটা যদি একটু ভেজানো যেত। কিন্তু সেখানেই বিপত্তি। যেখানে সেখানের পানি দিয়ে তো আর তৃষ্ণা মেটানো যায় না। পানি বিশুদ্ধ না হলে রয়েছে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। আর গরমে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব যে সবচেয়ে বেশি তা সবারই জানা।
নিজের স্বাস্থ্য রক্ষার খাতিরে দূষিত পানি পান না করে পানির বিশুদ্ধতা রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা দরকার সবার। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার করণীয় সবচেয়ে বেশি। সার্বিকভাবে ঢাকা শহরের পানি সঙ্কট নিয়ে শিগগির কোনো উদ্যোগ না নিলে তা আস্তে আস্তে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কথায় আছে, দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে আমরা সচেতন হই না। ঢাকার পানি সমস্যার সাথে ওয়াসা তথা সরকারের পদক্ষেপ দেখে কিন্তু তারই প্রমাণ মেলে। কিন্তু আমরা চাই জীবন রক্ষাকারী বিশুদ্ধ পাানির সমস্যার সঠিক সমাধান। পানির সঙ্কট না মিটলে ঢাকাবাসীই অসুস্থ হয়ে পড়বে না সমস্যায় পড়বে সরকারও।
বাংলাদেশের বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটের কারণ বিবিধ। কিন্তু প্রায় সব কারণই মানুষের তৈরি। কারণগুলো কী?
১. বাংলাদেশের জনবিস্ফোরণ এই সমস্যার অন্যতম কারণ। বছর-প্রতি বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.০৭%, বছর-প্রতি এই বিপুল হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও পানিসম্পদ কিন্তু একই থাকছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে প্রচুর মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়বে।
২. সাধারণ মানুষের দায়িত্বহীনতাও পানি-সমস্যার অন্যতম কারণ। এই ভোগবাদী সমাজে সকলেই কেবল নিজের স্বার্থ দেখে। আগামী প্রজন্মের দিকে নজর না দিয়ে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য পানির ব্যাপারে হয় অমিতব্যয়ী। ফলে পানিসম্পদ আজ খাদের কিনারে এস পৌঁছেছে।
৩. দ্রুত নগরায়ন ঘটানোও এর এক অন্যতম কারণ। কোনো নগরে একসাথে বহু লোক বসবাস করায় সেই অঞ্চলের সীমিত পানির ভান্ডার টান পড়ে। ফলে পানি-সমস্যা দেখা দেয়।
৪. দেশের বেশ কিছু অংশে ভূপৃষ্ঠ পানি ব্যবহার না করে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করে পাম্পের সাহায্যে উপরে এনে জমিতে ব্যবহার করাও অন্যতম কারণ।
পানির সমস্যা যে কেবল বাংলাদেশের তা অবশ্য নয়। বলতে গেলে সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। বলা হয়ে থাকে যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনও বাধে তা হলে তা বাঁধবে পানি নিয়ে। বিশ্বজুড়ে পানি সংকটের কারণ যতটা না প্রকৃতিগত, তার চাইতে অনেক বেশি মনুষ্যসৃষ্ট। বিশ্বের ২৬০টি দীর্ঘ ও বৃহৎ নদী দুই বা ততোধিক দেশের মধ্য দিয়া প্রবাহিত। নদ-নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ছাড়াও পরিবেশ-প্রতিবেশগত আরও নানান কারণে দুনিয়ার দেশে দেশে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে এরই মধ্যে। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ আজ সুপেয় পানির অধিকার হতে বঞ্চিত। পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে ৩৯ হাজার শিশু মারা যায় পানিবাহিত রোগে। ডায়রিয়ায় মারা যায় ১০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। বলাবাহুল্য, ডায়রিয়া রোগের প্রধান কারণ দূষিত পানি। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৮৯ শতাংশ মানুষ পরিষ্কার পানি পাচ্ছেন। বিশেষ করে চীন ও ভারতে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে পানি সরবরাহেরও উন্নতি হয়েছে। ২০১৫ সাল নাগাদ ৯২ শতাংশ মানুষের কাছে পরিষ্কার পানি পৌঁছে দেয়া যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু সে লক্ষ্যে এখনও পৌঁছা যায়নি। বিশ্বের জনসাধারণের একটা বিরাট অংশ অর্থাৎ ১১ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান থেকে বঞ্চিত। অন্য কথায় পৃথিবীর প্রায় ৮০ কোটি (৭৮৩ মিলিয়ন) মানুষ প্রতিদিন দূষিত পানি পান করছে।
জাতিসংঘে সুপেয় পানির অধিকারকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সেখানে লক্ষ করা যায় যে, শুধু কাগজে-কলমে আইন করে কাজ হয় না। আমার মনে হয়, এটা অত্যন্ত জটিল বিষয়, যার বাস্তবায়নও সহজ নয়। এজন্য প্রয়োজন বিশেষ কলাকৌশলের। পৃথিবীর চারভাগের মধ্যে তিনভাগ পানি। কিন্তু এই বিশাল পরিমাণ পানির মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পানি পান করার যোগ্য। আবার এই পানির একটা বড় অংশই রয়েছে বরফ হিসেবে। এই অ-লবণাক্ত পানির বাকি অংশ রয়েছে ভূপৃষ্ঠে ও ভূগর্ভে। এই পানির ৮৩% ব্যবহার হয় কৃষিকার্যে ও বাকি ১৭% শিল্প, গৃহস্থালির প্রয়োজনে। তাই পৃথিবীর পানিসম্পদ যা এক সময় অফুরন্ত উৎস হিসেবে গণ্য হতো তা আজ বিরল সম্পদে পরিণত হচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানির অভাবের মুখোমুখি হবে। বাংলাদেশের অবস্থা হবে ভয়াবহ। এ বিষয়টি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।
এখনই বিশুদ্ধ পানির ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে সরকারকে। এজন্য বিশুদ্ধ পানির উৎসস্থল নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। বেশি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহৃত পানি পুনব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প-কারখানার, পয়ঃবর্জ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনার বর্জ্য নদী বা জলাশয়ে ফেলা বন্ধ করতে হবে। শিল্প-কারখানায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) বাদ্ধতামূলক করতে হবে। পানি ব্যবহারে সংযমী হতে জনসাধারণকে উৎসাহী করতে হবে। ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস করা এবং ভূ-পৃষ্টের পানির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে। পুকুর, দীঘি, খাল-বিল-নদীসহ যে কোন জলাশয় ভরাট বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পানি পরিশোধনের লক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও অবিলম্বে নদী- দূষণের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।