Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিক কার্যকর ও দক্ষ করে তুলতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

অভিভাবক ব্যাংক হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং লুটপাটের তদারকি ও প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এ নিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতকে পর্যন্ত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত মন্তব্য করে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে অবশ্যই মানলিন্ডরিং প্রতিরোধের ব্যর্থতার বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকটির অডিট বিভাগ, ফান্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন, মার্কেটিং ডিভিশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মরতদের দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করতে ১২ বছরের (২০০৮ থেকে ২০২০) তালিকাসহ তথ্য প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে এসব বিভাগে দায়িত্বরত কর্মকর্তা অর্থপাচার প্রতিরোধে কেন ব্যর্থ হয়েছেন, তার ব্যাখ্যা চেয়েছেন। বলা বাহুল্য, এ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও অদক্ষতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। মানিলন্ডরিং বা অর্থপাচার আমাদের অর্থনীতির জন্য এক বড় দুষ্টক্ষত। তা প্রতিরোধ বা দেখভালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তা সে যথাযথভাবে করতে পারছে না। সাধারণত বিদেশে অর্থ প্রেরণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও এর আওতাধীন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই হয়ে থাকে। লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি)-এর মাধ্যমে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের বিষয়টি তাদের মাধ্যমেই করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক কার্যক্রম এবং বিদেশে নির্ধারিত অর্থ প্রেরণ বা কারসাজির মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান বা পাচার করছে কিনা, ব্যাংকগুলোকে সেদিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এদিকে নজর রাখতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কাজটি যে করতে পারছে না, তা উচ্চ আদালতের মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়।
দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের নিয়ম-শৃঙ্খলার সুরক্ষা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি তদারকি করে খাতটিকে দৃঢ় রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। বহু বছর ধরেই ব্যাংকটি এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপী বৃদ্ধি থেকে শুরু করে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা ঘটছে না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর জেরে গভর্নরকে পর্যন্ত চলে যেতে হয়েছে। চরম অব্যবস্থাপনা ব্যাংকিং খাতকে অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংকিং খাত যদি বিশৃঙ্খল ও ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি বলে কিছু থাকে না। ব্যাংকিং খাতকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে রাখার কাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের। একে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের মেরুদন্ড। এই মেরুদন্ড দুর্বল হয়ে পড়ায় তার শাখা-প্রশাখা হয়ে থাকা অন্যান্য ব্যাংকও দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে, নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। যে যেভাবে খুশি খাতটিকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। দেদারছে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। এই অর্থ পাচারের পরিমাণ কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তবে মাঝে মাঝে দেশি-বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে এর হিসাব পাওয়া যায়। কোনো কোনো সংস্থার হিসেবে দেশ থেকে বছরে গড়ে দশ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। এভাবে বিগত দশ বছরে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার হয়ে গেছে। এই পাচার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ আমদানি-রফতানির নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে, কেউ হুন্ডির মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার করছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো পরিসংখ্যান দেয়া হয় না এবং তা প্রতিরোধেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খোঁজ-খবর নিয়ে কারো কারো বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিগত পাঁচ বছরে সংস্থাটি মানিলন্ডরিংয়ের ৪৭টি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে এবং আরও ৮৮টি মামলা তদন্ত করছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত শতাধিক ব্যক্তি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এ সংখ্যাটি যে অর্থপাচারের পুরো চিত্র নয়, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। এর বাইরের সংখ্যাটি যে আরও বৃহৎ তা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন থেকে ইতোমধ্যে জানা গেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এমনকি, ব্যাংকটির রিজার্ভ থেকে যে অর্থ চুরি হয়ে গেছে, তা উদ্ধারেও কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।
দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যে ধরনের দক্ষতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা দরকার তা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই বললেই চলে। ব্যাংকটির পুরো ব্যবস্থাপনা নাজুক হয়ে পড়েছে। নিজস্ব সৃজনশীল ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি প্রতিষ্ঠানে দুর্বলতা দেখা দেয়, তার বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারির অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে। এর দায় পুরো প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কিছু কর্মকর্তার ব্যর্থতা রয়েছে। দেখা যায়, আর্থিক নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত দিক-নির্দেশনা দিতে হচ্ছে। প্রণোদনার অর্থ কিভাবে বন্টন করা হবে, রির্জার্ভের অর্থ কিভাবে ব্যবহার করা হবে-এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশনা প্রদান করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার অপেক্ষায় বসে থাকে। তার নিজস্ব সৃষ্টিশীল কর্ম ও উদ্যোগের মাধ্যমে যে আর্থিক খাতকে সুশৃঙ্খল করে তুলবে, এ ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। বরং দুর্নীতিকে ধামাচাপা এবং দুর্নীতিবাজদের রক্ষার প্রয়াস তার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নাজুক পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশের অর্থনৈতিক খাতকে সুদৃঢ় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মপদ্ধতি অধিক দক্ষ ও কার্যকর করে তোলা অপরিহার্য। এর প্রত্যেকটি বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও গতিশীল করতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা বিরাজমান, তা দূর করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঋণের নামে অর্থ লুটপাট, অর্থ পাচার বন্ধে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ ব্যাংক

২৫ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন