Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ট্রাম্প সমর্থকদের নজিরবিহীন সন্ত্রাস

| প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের কংগ্রেস ভবনে গত বুধবার ট্রাম্প সমর্থকরা যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা নজিরবিহীন। ট্রাম্পের সশস্র উগ্র সমর্থকরা ভবনের ভেতর ঢুকে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর চালিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ সময় দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জয়ের আনুষ্ঠানিক সত্যায়নের যৌথ অধিবেশন চলছিল। অভাবনীয় সন্ত্রাসী হামলার মুখে এ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে পুনরায় তা শুরু হয়। এ ঘটনায় পুলিশের সাথে হামলাকারিদের সংঘর্ষে চার জন নিহত এবং ৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওয়াশিংটনে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ক্যাপিটল হিল এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্তের শিকার হয়েছে। ১৮১৪ সালে ইংরেজ সৈন্যদের হাতে প্রথাম হামলার শিকারের পর ২০৬ বছর পর গত বুধবার দ্বিতীয়বার ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হলো। এ হামলার মূল কারিগর হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার সরাসরি উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে এ হামলা হয়েছে। গত বুধবার হোয়াইট হাউজের কাছে একটি সমাবেশে ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা ক্যাপিটল ভবনে পদযাত্রা করব। আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহিত করব। আপনাদের দৃঢ়তা দেখাতে হবে।’ তার এ বক্তব্যের পরপরই হাজার হাজার সমর্থক ক্যাপিটল হিলের দিকে যাত্রা শুরু করে। সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ এবং হামলা চালায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন আচরণ এবং তার সমর্থকদের এরূপ হামলার ঘটনা যেমন অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত তেমনি বিশ্বব্যাপী এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ ঘটনা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো উগ্র, একরোখা ও গোয়ার প্রেসিডেন্ট কখনো দেখা যায়নি। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পরাজয় মেনে না নেয়াসহ হিংস্র আচরণ আর কোনো প্রেসিডেন্ট করেননি। নির্বাচনের আগে থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন, পরাজিত হলে ক্ষমতা ছাড়বেন কিনা তা ফলাফল দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন। এমনকি পরাজিত হলেও হোয়াইট হাউজ ছাড়বেন না বলে অনঢ় অবস্থান নেন। জো বাইডেনের কাছে পপুলার ও ইলেকটোরাল ভোটের ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর তিনি পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেন। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ফল উল্টে দেয়া হয়েছে, গণনা ঠিক মতো হয়নি ইত্যাদি নানা অভিযোগ তোলেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে মামলা দায়ের করেন এবং সংশ্লিষ্টদের হুমকি-ধমকি দেন। সব মামলায় তিনি হেরেও গেছেন। তারপরও তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেন, যার সর্বশেষটি ছিল ক্যাপিটল হিলে তার উগ্র সমর্থকদের উস্কে দিয়ে হামলা করানো। এ হামলাকে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের অধিকাংশ সিনেটরসহ সাবেক প্রেসিডেন্টরা ‘অভ্যুত্থানের চেষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ট্রাম্পের এমন আচরণে ট্রাম্পের মন্ত্রীসভার সদস্যরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ২০ জানুয়ারির আগেই তাকে অপসারণের দাবি করেছেন। তাদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীর ৪ নম্বর অনুচ্ছেদ কার্যকর করে তাকে অপসারণের আহবান জানিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এমনই একজন প্রেসিডেন্ট যার ইতিবাচক দিক বলতে তেমন কিছু নেই। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি নেতিবাচক পন্থা অবলম্বন করেই প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। বহু জাতি, শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণের অপূর্ব মিলনের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যে আঘাত হেনে তিনি উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদকে রাজনীতিতে সংস্থাপিত করেন। ‘ট্রু আমেরিকা’ বা ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট’ শ্লোগান দিয়ে উগ্র শ্বেতাঙ্গদের প্রশ্রয় দিয়ে উন্মাদনার সৃষ্টি করেন। রিপাবলিকান দল ও ট্রাম্প ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা বর্ণবাদকে টেনে আনেন এবং সমর্থন ও প্রশ্রয় দিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়িয়ে দেন। তার এই বর্ণবাদী নীতি সে সময় তাকে জিততে সহায়তা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প অভিবাসীদের বের করে দেয়া, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ সাদা-কালো বর্ণবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেন। গত বছর নির্বাচনের কয়েক মাস আগে পুলিশের হাতে এক অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বর্ণবিদ্বেষকে আরো উস্কে দেন। তার এই উস্কানি যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সারাবিশ্বে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ শিরোনামে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। নির্বাচনে জেতার জন্য ট্রাম্প তার পুরণো কৌশল হিসেবে এ পন্থা বেছে নেন বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সমাজে সাদা-কালো দ্ব›দ্ব ও অভিবাসীবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাতে ট্রাম্প কুঠারাঘাত করেন। তিনি অগ্রহণযোগ্য ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অবলম্বন করেন। একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার এই শাসন নীতি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা নির্বাচনে তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের এই রায় ট্রাম্প মানতে না পেরে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, জর্জ ওয়াশিংটনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবিদ্বেষের মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি তা নিরসন করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রকে দ্বিধাবিভক্তি থেকে রক্ষা করেছিলেন। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পুরনো বর্ণবাদী নীতি গ্রহণ করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এখন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত ঐতিহ্য ধরে রাখতে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকল যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে একই ছাতার নিচে এনে ঐক্যবদ্ধ জাতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশ্বে এখনো যুক্তরাষ্ট্র এক নম্বর পরাশক্তি। সারাবিশ্বেই তার প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে, দেশটির গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়া কিংবা জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রতিক্রিয়া অন্যান্য দেশে পড়া স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে তার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে জনগণের অধিকার হরণ করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অবলম্বনের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ফ্রান্সের সরকারের মধ্যে বর্ণবাদী আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারত সরকার দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে খর্ব করে মুসলমানদের নির্মূল করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। জার্মানিতেও বিভক্তির রাজনীতি দেখা দিয়েছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে বর্ণবিদ্বেষী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে বিভক্তির রাজনীতি ট্রাম্প শুরু করেন, তার প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়েছে। এ প্রভাব কাটিয়ে গণতন্ত্রকে ধরে রাখতে এখন জো বাইডেনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সব দল-মত ও ধর্ম-বর্ণের মধ্যে পারস্পরিক সহবস্থান নিশ্চিত করে সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। এ নীতি থেকে বিচ্যুত বা ট্রাম্পের সৃষ্ট বিভক্তির রাজনীতি বহাল রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই কাম্য হবে না। অন্যান্য দেশের জন্য একই কথা প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকেও সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

 



 

Show all comments
  • MD.BORATUZZAMAN ৯ জানুয়ারি, ২০২১, ৩:২৯ পিএম says : 0
    Trump Akta Dram.....Sagol Kotakar
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রাম্প-সমর্থক
আরও পড়ুন