প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
দেশ, জাতি ও সংস্কৃতিভেদে প্রত্যেকের আলাদা বর্ষপঞ্জি রয়েছে। তবে একমাত্র গ্রেগরিয়ান বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনেই চলে বিশ্ববাসীর সব হিসাব-নিকাষ ও দৈনন্দিন কর্মকান্ড। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে উৎসবের আমেজে সাড়ম্বরে ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসাবে পালিত হয়ে থাকে। তবে বহুকাল থেকেই পৃথিবীর কিছু জাতি যেমন মুসলিম, পারসীয়ান, চীনা, ইহুদী প্রভৃতির মধ্যে নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করতেও দেখা যায়।
মানুষ আদিকাল থেকেই কোনো না কোনোভাবে দিন-ক্ষণ, মাস-বছরের হিসাব রাখতে প্রয়াসী হয়েছে চাঁদ দেখে, নক্ষত্র দেখে, সূর্য দেখে, রাত-দিনের আগমন-নির্গমন অবলোকন করে, ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করে। সাধারণ কোনো বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিন গণনা, মাস গণনা, বছর গণনার রীতি কালক্রমে চালু হয়েছে। তিথি, নক্ষত্র বিশ্লেষণ করার রীতিও আবিষ্কার হয়েছে, উদ্ভাবিত হয়েছে রাশিচক্র। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী যে বছর গণনার রীতি চালু হয় তা চান্দ্র সন নামে পরিচিতি লাভ করে। এই চান্দ্র সনে বছর হয় কমবেশি ৩৫৪ দিনে আর সুর্যের হিসাবে যে বছর গণনার রীতি চালু হয় তা সৌর সন নামে পরিচিত হয়। সৌর সনের বছর হয় সাধারণত ৩৬৫ দিনে।
ইতিহাসবেত্তাদের মতে, বিশ্বব্যাপী পালিত উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হিসেবে মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমিয় সভ্যতায় (যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সে সময়কার দজলা ও ফোরাত নদীর তীরে) প্রথম বর্ষবরণ উৎসব পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমান ইরাকের প্রাচীন নাম ছিল মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা আবার ৪টি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। সে হলো: সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো বর্ষবরণ উৎসব। তবে তা এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। পালিত হতো বসন্তের প্রথম দিনে। কেননা, শীতের রুক্ষতা ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজতে শুরু করে বসন্তে। গাছে গাছে নতুন পাতা, বাহারি রঙের ফুল আর পাখিদের কল-কাকলিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি।প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই নতুন বছরের শুরু হিসেবে পালন করতো ব্যাবিলনীয়ানরা। অবশ্য তখন বছর গণনা করা হতো চাঁদের উপর নির্ভর করে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠতো, শুরু হতো নতুন বছর আর বর্ষবরণ উৎসব। চলতো টানা ১১ দিন। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমকভাবে বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো রোমানরাও। তবে তাদের ছিল নিজস্ব ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারও রোমানরা তৈরি করেছিল চাঁদ দেখেই। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের নববর্ষ ছিলো মার্চের প্রথম দিন। প্রথম দিকে তাদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল ১০টি। ছিল না জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস। পরবর্তীতে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। এরপর রোমান রাজ এর ইচ্ছানুযায়ী বছরের প্রথম মাস মার্চ হতে জানুয়ারিতে পরিবর্তন করা হয়। তবে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে চালু করতে বেশ সময় লাগে। এটি প্রথম চালু হয় ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে। তখন এটি অনিয়মিতভাবে পালিত হতো। কারণ তখনো বিভিন্ন স্থানে জনগণ মার্চের ১ তারিখকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমসম্রাট জুলিয়াস সিজার যখন সূর্যকেন্দ্রিক ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ চালু করেন, তখন জানুয়ারির ১ তারিখকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।মাস থাকলেও রোমানদের ক্যালেন্ডারে ছিলো নাকোনো তারিখ। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করতো রোমানরা। চাঁদ উদয়ের সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে তারা বলতো ইডেস, আর চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলা হতো নুনেস। পরবর্তীতে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের পরিবর্তে যোগ করেন দিন-তারিখ। চান্দ্রমাসের হিসেবে সে সময় বছরের মোট দিন দাঁড়ায় ৩৫৫। এভাবে বছর হিসাবের ফলে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখী হতে থাকে রোমের চাষীরা। সমস্যার সমাধানের জন্যে হোঞ্চাস হেডাস ফেব্রুয়ারি মাসের পর অতিরিক্ত আরও একটা মাস যুক্ত করেছিলেন ক্যালেন্ডারে। সমস্যা কমার বদলে আরো জটিল আকার ধারণ করেছিল সে সময়। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজার চান্দ্র হিসাবের বদলে সৌর মাসের ব্যবহার প্রবর্তন করেন। ফলে ৩৫৫ দিন থেকে বছর হয়ে গেলো ৩৬৫ দিনের। (তবে অনেকের মতে, তিনি সৌর হিসেবে ৩৬৫ দিনের নয়,বরং ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন!)কথিত আছে যে, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। যদিও এ নিয়ে বিতর্কও আছে। এতকিছুর পরও সমস্যা ছিল জুলিয়াস ক্যালেন্ডারে।
সেই সমস্যার সমাধান করেন অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস নামের একজন ডাক্তার তিনি তৈরি করেছিলেন নতুন আরেকটি ক্যালেন্ডার। পরবর্তীতে যিশুখ্রিস্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের পরামর্শক্রমে জুলিয়াস ক্যালেন্ডারটির সংস্কার করে তার নামানুসারে প্রচলন করেন; যা বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবেই পরিচিত। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সকল জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে এ.ডি লেখা হয় তা ল্যাটিন অ্যানো ডোমিনি এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই আ্যনো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভুর বছর। ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াস নামক এক খ্রিস্টান পাদরী জুলিয়াস ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশুখ্রিস্টের জন্মবছর থেকে হিসাব করে এই খ্রিস্টাব্দ লিখনরীতি চালু করেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আধুনিক বিশ্বে পহেলা জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে প্রচলন করার ব্যাপারে ‘রিপাবলিক অব ভেনিস’ (দেশটি ১৭৯৭ সালে বিলুপ্ত হয়) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ দেশটি ১৫২২ সাল হতে এ দিনকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনা করতে শুরু করে। পরবর্তীতে যে সকল দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা সকলেই পহেলা জানুয়ারি তারিখেই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে; যেমন ১৫৫৬ সাল থেকে স্পেন, পর্তুগাল; ১৫৫৯ থেকে প্রুশিয়া, সুইডেন; ১৫৬৪ সাল থেকে ফ্রান্স; ১৬০০ সাল থেকে স্কটল্যান্ড, ১৭৫১ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং বৃটিশ কলোনিগুলো নববর্ষের রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। আর এই ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৭০০ সাল হতে রাশিয়া এই রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে।
যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতেই এই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি তাই ইংরেজি বছরের বারোটি মাসের বেশির ভাগের নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা বা স¤্রাটের নামানুসারে। যেমন, জানুয়ারি রোমান দেবতা জানো’সের নামানুসারে, ফেব্রুয়ারি ল্যাটিন শব্দ ফেব্রুয়া থেকে, মার্চ রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মার্স থেকে, এপ্রিল ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলিস থেকে, মে বসন্তের দেবী মায়া’সের নামানুসারে, জুন বিবাহ এবং নারী কল্যাণের দেবী জুনো’র নামানুসারে, জুলাই রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে, আগস্ট জুলিয়াস সিজারের পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামানুসারে, সেপ্টেম্বর ল্যাটিন সপ্তম সংখ্যা সেপ্টেমের নামানুসারে, অক্টোবর ল্যাটিন অষ্টম সংখ্যা অক্টো-এর নামানুসারে, নভেম্বর ল্যাটিন নবম সংখ্যা নভেমের নামানুসারে এবং ডিসেম্বর ল্যাটিন দশম সংখ্যা ডিসেমের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে।
আগেকার দিনে নিউ ইয়ারের আগের রাতকে বলা হতো নিউ ইয়ার ইভ। বর্তমানে যা থার্টিফার্স্ট নাইট হিসেবে প্রচলিত। খ্রিস্টের জন্মের পর ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা ক্রিসমাস ডে থেকে শুরু করে বছরের শেষদিন শেষে রাতের অর্ধপ্রহর পর্যন্ত নানান বিকৃত পন্থায় তাদের দেবতাদের পূজা-অর্চনা করতো। সাথে থাকতো ভোগ বিলাসের সকল আয়োজন (মদ্যপান থেকে শুরু করে সকল অনাচার)। সেসময় ইউরোপের প্রোটেস্টান ধর্মগুরুরা এ সংস্কৃতিকে প্যাগানীয় ও অ-খ্রিস্টানীয় আখ্যা দিয়ে বর্জন করার ঘোষণা দেন। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে প্রোটেস্টানরাও যোগ দেয় এ উৎসব পালনে। এদিকে ইংরেজি নতুনবর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ইসরায়েল রাষ্ট্রটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ বিভিন্ন ধর্মীয়গোষ্ঠী অ-ইহুদী উৎস হতে উৎপন্ন এই রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করে বেশ জাঁকজমকভাবে। পশ্চিমা বিশ্বের এ উৎসবকে বেশ কিছুকাল যাবত স্বাগত জানিয়েছে আমাদের দেশও। পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে পালন করা হয় ইংরেজি নববর্ষও।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহ-অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।