Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অপার সম্ভাবনার উত্তরাঞ্চল

মহসিন আলী রাজু | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ৮টি জেলাকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের এই অঞ্চলটিকে উত্তরাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অঞ্চলের ১৬টি জেলার নাম যথাক্রমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট ও বগুড়া (রাজশাহী বিভাগ) এবং পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর (রংপুর বিভাগ )।

প্রায় সাড়ে কোটি মানুষের বসবাস এ জনপদে। বাংলাদেশের এই অংশের পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরে প্রতিবেশি ভারতের বিস্তীর্ণ সীমান্ত। উত্তরের ভারত, নেপাল, ভূটান ও সিকিম অঞ্চলে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা। নেপাল ও ভারত সংলগ্ন বিখ্যাত চিকেন নেকের অবস্থান পঞ্চগড় সীমান্তে। নাটোর, রংপুর, বগুড়া ছাড়া বাকি ৫ জেলার সাথেই রয়েছে ভারতের সীমান্ত। চিকেন নেক ছাড়াও বহুল প্রচারিত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল, বড়াইমারি ওয়ার ফিল্ড এখানেই। বিএসএফর হাতে ফেলানি ‘হত্যার স্পট এখানেই। প্রতিবছর বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যার যতগুলো ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই সঙ্ঘটিত হয় উত্তর সীমানেই। তাই উত্তরাঞ্চলের ভু-রাজনৈতিক গুরুত্ব আলাদা বৈকি!

কারণ দেশের বৃহত্তম নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তাসহ কমবেশি ৫০টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফারাক্কা বাঁধের অবস্থান উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীতে। তিস্তা প্রকল্প নীলফামারীতে এবং বিখ্যাত রূপপুর আনবিক প্রকল্প পাবনার ঈশ^রদীতে।

উত্তরাঞ্চলে ভূ-প্রকৃতিতে যেমন বরেন্দ্র অঞ্চলের মত শুকনো খনখনে উচ্চভূমি রয়েছে তেমনি, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, গঙ্গাচড়া, সারিয়াকান্দি, কাজিপুর, চৌহালী, সিরাজগঞ্জের মত বন্যাকাতর এবং নদী অঞ্চলে বিস্তীর্ণ পলল ভূমিও রয়েছে। ধান, পাট, আলু, গম, সরিষা, ভুট্টা, আখ, তামাকসহ সবধরনের সবজীর ফলনের জন্য এলাকাটিকে বলা হয় শস্য ভান্ডার।

মজার ব্যাপার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা না থাকায় উত্তরের উৎপাদক চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিতই থেকে যায় বছরের পর বছর, যুগের পরে যুগ।

১৯৪৭ সালের আগের ব্রিটিশ পিরিয়ডে ভারতের কোলকাতা, আসাম ও শিলিগুড়ি, দার্জিলিংয়ের সাথে মানুষের যোগাযোগ ছিল ভালো। পাকিস্তান হওয়ার পরে আগের যোগাযোগ ব্যবস্থায় তৎকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির কারণে ছেদ পড়ে।

কিন্তু বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যদি নেপাল, ভুটান, সিকিম, শিলিগুড়ি ও আসামে কৃষিপণ্য ও জরুরি ওষুধ, টয়লেট্রিজ সামগ্রী রফতানির উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি প্রভূত লাভবান হবে বলে মনে করেন গবেষকরা। উত্তরপূর্ব ভারতে বাংলাদেশি ওষুধ ও টয়লেট্রিজ সামগ্রীর যে বিপুল চাহিদা রয়েছে তা এখন আর অজানা বিষয় নয়। তাই এই খাতে সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিলে আলোকিত হয়ে উঠবে উত্তরাঞ্চল।

বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে বিপুল সংখ্যায় নেপালী মেডিকেল শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। নেপাল বাংলাদেশ ভায়া ভারতের চিকেন করিডোর ব্যবস্থাপনা না থাকায় নেপালী শিক্ষাথীদের বিমানযোগে ঢাকা হয়ে বগুড়ায় আসতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ-ভূটান ও নেপালের সাথে করিডোর সংযোগ সড়ক থাকলে প্রচুর নেপালী, ভুটানি শিক্ষার্থী কম খরচে উত্তরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এসে পড়াশোনা করতে পারতো ।
উত্তরাঞ্চলের মাটি যেমন ঊর্বর তেমনি এর নিচে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ। বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনি ও কঠিন শিলা, জয়পুরহাটের চুনা পাথর, নীলফামারীর ডোমার এলাকার মোটাদানার বালু আহরণের ব্যবস্থা থাকলেও পঞ্চগড়ের শালবাহান এলাকায় পেট্রোলিয়াম খনিজের অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে রহস্যময় কারণে।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কলাকোপায় গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের অনুসন্ধান কাজ ৮০ এর দশকে শুরু হয়ে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় একই কারণে।

তবে পরিবর্তিত বৈশি^ক পরিস্থিতিতে এখন মনে হয় সুযোগ এসেছে নতুন করে উত্তরের ভূগর্ভস্থ খনিজ উপাদান আহরণে মনোযোগী হওয়ার। এছাড়াও তিস্তা ও যমুনার ঢলের সাথে বয়ে আনা বালুকণায় রেডিয়াম কণা ও কাঁচ তৈরীর উপাদান সিলিকনের আধিক্য সর্বজনবিদীত। মাঝে মাঝে মিডিয়ায় আলোচনাও হয় তবে বাস্তবে এইসব মূল্যবান খনিজ উপাদানের বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ সেভাবে চোখে পড়ে না।

অভিজ্ঞজনদের অনেকেই বিশ^াস করেন, উত্তরাঞ্চলের খনিজ সম্পদ আহরণের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশ এতদিন হয়তো পেট্রল, ডিজেল, অকটেন, কয়লা ও গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যেত। সরকারের এই ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগি হওয়া উচিত।

সেই আদিকাল থেকেই উত্তরাঞ্চল কৃষিভিত্তিক অর্থনিিত, কারুপণ্যভিত্তিক হস্তশিল্প, তাঁত শিল্পভিত্তিক একটি কর্মপ্রবাহ ছিল। বস্ত্র ও বিশেষ করে রেশম বস্ত্রের উৎপাদনের জন্য এ এলাকার সুনাম ও পরিচিতি ছিল। পাকিস্তান আমলে এসবের বিকাশের ধারা অব্যাহত ছিল।

একই সময়ে বগুড়া ও সৈয়দপরে মুহাজির হয়ে আসা বিহারী সম্প্রদায়ের হাত ধরে এই অঞ্চলে বেকারী ও লৌহজাত পণ্য এবং ফাউন্ড্রি শিল্পের বিকাশ ঘটে। উত্তরাঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থানের জেলা বগুড়ায় ফাউন্ড্রি শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। এখানকার সেচ পাম্প ও টিউবওয়েলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে উত্তরপূর্ব ভারতের কৃষিজীবীদের মধ্যে। এখানকার এই লৌহজাত পণ্যসমূহ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে যাতে বৈধ প্রক্রিয়ায় রফতানি করা যায় সে ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ জরুরি ।

এ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তা, উত্তরাঞ্চলের চেম্বার অফ কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তিদেরও যে বিরাট দায়িত্ব রয়েছে সেটা তাদের উপলব্ধি করা উচিত।

উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির ও রামসাগর, ঘোড়াঘাটের সুরা মসজিদ, নীলফামারীর নীল সাগর ও তিস্তা ব্যারেজ, রংপুরের রোকেয়া সদন, তাজহাট জমিদার বাড়ি, প্রেসিডেন্ট এরশাদের কবর, বগুড়ার মহাস্থানগড় শাহসুলতান মাহিসাওয়ার রহঃ এর কবর, লক্ষিন্দরের বাসরঘর, বৌদ্ধ বিহার, খেরুয়া মসজিদ, জয়পুরহাটের ঝিন্দের মসজিদ, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ, পুঠিয়ার জমিদারবাড়িসহ অন্তত দর্শনীয় হাজার খানেক পর্যটন স্পট রয়েছে যেগুলোতে পর্যটন সুবিধার ব্যবস্থা করলে দেশি/বিদেশি পর্যটকের কমতি পড়ার কথা নয়।

যদিও যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর উত্তর জনপদের সাথে দেশের অপরাংশের যোগাযোগ অনেক বেড়েছে, তবে ভয়াবহ রোড জ্যামের কারণে ভোগান্তি বেড়েছে সীমাহীন। অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার আন্তর্জাতিক চাহিদার আলোকে উত্তরবঙ্গ মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নয়নের কাজ শুরু করেছে। তবে কাজের ধীরগতি এতটাই যে মানুষ ক্ষুব্ধ ও চরম বিরক্ত ।

একই সাথে চলছে দ্বিতীয় যমুনাসেতু রেল ব্রিজের কাজও। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রভূত উপকৃত হবে উত্তরাঞ্চলবাসী। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যমুনা সেতু দি¦তীয় রেল ব্রিজ ও ফোরলেণ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা যে হারে বাড়বে তাতে যানজট কতটা কমবে সেটা বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল পদ্মা, যমুনা, তিস্তাসহ নদী কেন্দ্রিক রুটগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। ছোট ছোট নদ-নদীগুলোর নাব্য ফেরাতে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। উচ্ছেদ করতে হবে অবৈধ দখল।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আকাশ পথকে। উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পাকিস্তান আমলে ডজনখানেক ডমেস্টিক ফ্লাইট চলার মত বিমানবন্দর নির্মাণ ও চালু করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সব সরকারই উত্তরের বিমানবন্দরগুলোর ব্যাপারে কেন যে উদাসীন বোঝা মুশকিল।


এক্ষেত্রে সরকারের বড় অজুহাত হল আর্থিক অক্ষমতা ও যাত্রীর অভাব। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমানে চালু রাজশাহী ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যাত্রী ঘাটতি রয়েছে নাকি টিকেটই পাওয়া যায় না?

আসল চিত্র হল সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ফ্লাইটগুলো এখন যাত্রীতে ঠাঁসা থাকছে। টিকেটেই পাওয়া যাচ্ছে না। আপামর জনসাধারণ মনে করেন ঠাকুরগাঁও এবং ঈশ^রদী বিমানবন্দররের উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি। বগুড়া ও রংপুরে পৃথক দুটি বিমানবন্দর অতি জরুরি। এ’দুটির মধ্যে একটি হতে হবে আন্তর্জাতিক। বিদেশ যাত্রায় ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের জটিলতা ও ভোগান্তি কমাতে উত্তর জনপদে একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। এটা প্রতিষ্ঠা হলে উত্তরাঞ্চলে খুলবে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন