Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সীমান্ত হত্যা চলছেই

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব শুধু কাগজে-কলমে হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব : বিজিবি প্রধান

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের মধ্যেকার বন্ধুত্বের সম্পর্কে চলছে এখন ‘বসন্ত কাল’। প্রায় এক যুগ ধরে দাবি করা হচ্ছে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ‘সোনালী অধ্যায়’ চলছে। মন্ত্রীদের কেউ কেউ দাবি করছেন দুই দেশের মধ্যে ‘রক্তের সম্পর্ক’ ‘রাখি বন্ধন’ চলছে। বন্ধুত্বপূর্ণ নতুন উচ্চতার সম্পর্কের মধ্যে সীমান্তকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সীমান্তে’ রুপ দিয়েছে ভারত। সোনালী সম্পর্কের পরও বন্ধ হচ্ছে না সীমান্ত হত্যা। একদিকে কাঁটা তারের বেড়া অন্যদিকে হত্যাকান্ড।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা. রুহুল আমীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। এই সীমান্তের তিন চতুর্থাংশ সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া। সোনালী বন্ধুত্বকে কাঁটা তারে বিভক্ত করলেও দুই দেশের সীমান্তের এক ইঞ্চিও বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। জমি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে, মাছ ধরাবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশিদের বিএসএফ হত্যা করছে। অতপর গরু চোলাচালান হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। সীমান্তে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। গত এক দশকে ৩শ’র বেশি বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গত ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল সংলাপের পর সংবাদ সম্মেলন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, বিএসএফের সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ককে কলঙ্কিত করছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের অবস্থা কার্যত ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরাইলী সীমান্ত এবং আমেরিকার সঙ্গে মেক্সিকোর সীমান্তের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে উন্নতি ঘটলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি দুই দেশের সীমান্তে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও তাতে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। বরং মাঝে কিছুটা কমার পর হত্যাকান্ডের সংখ্যা আবার বেড়ে চলেছে। দুই দেশের সম্পর্ক শুধুই কাগজে কলমে বলে জানিয়েছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভঙ্গ করেছে।

গত বছর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, ২০০৯ সালে সীমান্তে নিহত হয়েছিলেন ৬৬ জন। এরপর ২০১০ সালে ৫৫, ২০১১ সালে ২৪, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ১৮, ২০১৪ সালে ২৪, ২০১৫ সালে ৩৮, ২০১৬ সালে ২৫, ২০১৭ সালে ১৭ ও ২০১৮ সালে তিনজন নিহত হয়েছেন।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলন শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এসময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা সীমান্তে হত্যাকান্ডের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হত্যাকান্ডের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটছে রাত সাড়ে ১০টা থেকে ভোর সাড়ে ৫টার মধ্যে। তিনি নিশ্চয়তা দিয়েছেন, হত্যাকান্ডের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। এ জন্য বিজিবি-বিএসএফ সীমান্তে যৌথ টহল দেবে এবং এলাকার লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে।

এমন প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও থামছে না সীমান্ত হত্যা। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে জাহিদুল ইসলাম (২০) নামের এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। পরে তার লাশ টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায় বিএসএফ। এ ঘটনার তিনদিন পর জাহিদুল ইসলামের লাশ ফেরত দেয় বিএসএফ। নিহত জাহিদুল উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের মধ্য শ্রীরামপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার ছেলে।

শ্রীরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এলাকাবাসীকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকার জনপ্রতিনিধিরা পাহারা দিয়ে থাকেন। তারপরও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

শুধু জাহিদুল ইসলামই নয়, গত সেপ্টম্বরে দুই দেশের মহাপরিচালকদের আলোচনার পরও ৯ জন নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪২ বাংলাদেশি। এর মধ্যে রংপুর সীমান্তে ২০, রাজশাহীতে ১৩, খুলনায় ৭ ও সিলেটে দুইজন প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়াও গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সীমান্ত হত্যা কিছুটা কমলেও সেটি তিন গুণ বাড়ে ২০১৯ সালে। সংস্থাটির আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সীমান্তে ১৫৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তবে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিজিবি সব সময় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম। বিজিবি দিবস উপলক্ষে গতকাল ঢাকার পিলখানায় স্মৃতিস্তম্ভ ‘সীমান্ত গৌরবে’ পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, এখন ক‚টনৈতিকভাবে এবং আমরা আমাদের দিক থেকে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি যেন সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে পারি। সেজন্য সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি যেন অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম না করেন।

সীমান্তের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেও জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সীমান্তবর্তী জনগণকে শিক্ষা দীক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবে যদি স্বাবলম্বী করতে পারি; তাহলেই সীমান্ত হত্যা কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, দেশের সীমানায় কিছু স্থান এখনো অরক্ষিত। সেখানে বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) স্থাপন করা গেলে সীমান্তে হত্যাসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

বিজিবি সূত্রে জানায়, আগামী ২২ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ভারতের গৌহাটিতে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে ৫১তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশ নিবেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ প্রতিনিধিত্ব করবেন। অপরদিকে বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানার নেতৃত্বে ১২ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলে বিএসএফ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, ফ্রন্টিয়ার আইজিগণ এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ প্রতিনিধিত্ব করবেন।

এ ব্যাপারে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ওই সম্মেলনেও সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, আহত, হত্যা করা সম্পর্কে প্রতিবাদ জানানো হবে। এছাড়াও এ ধরনের কর্মকান্ড বন্ধে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।



 

Show all comments
  • মোঃ দুলাল মিয়া ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:৫১ এএম says : 0
    ভারত যে এক নাম্বার সন্ত্রাসী আসলে কেই জানে না।আমি মনে করি জাতিসংঘে এই বেপারে বিচার দেওয়া জরুরি। আমরা যদি মনে করি ভারত আমাদের মামু ।কথায় বলে মামার বাড়ির আবদার। কোথায় সেই আবদার মামারাতে আমাদের ভাগিনা ভাগনি বলে না ।আমরা বলি আমাদের রক্তে বন্দন। ছোট দেশ হলে কি হবে আমরা কি ভারত থেকে সাহায্য নিয়ে বেঁচে আছি না কি ।ভারতকে পুজো করে চলতে হবে কেন।আমি মনে করি আমাদের দেশের লোক কে গুলি করলে আমরা ও করা উচিত। আসল কথা হলো আমাদের যারা পাহারা দিবে সব .....রাই কালো বাজারি আর আমাদের বেইমানেরা সীমান্ত পাহারা দিবার নামে করে স্মাগলারী নারী পাচার বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী খুব খারাপ এই জন্য এই অবস্থা। পুর্বের সরকারের আমলে এই গুলি ছিল না যদিও হতে সংগে সংগে পতিবাদ হতে।এখন মামা ভাগনির জামানা মামা ভাগনি যে খানে আপাত নেই সেখানে। কিন্তু মামাতো ভাগনি পরিচয় দিতে চায় না। দেখেন এই সমস্ত মামা ভাগনির সম্পর্কের আমাদের দরকার নাই। এখন আমরা ও পাল্টা গুলি করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Khandakar Ramin ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:০৯ এএম says : 0
    এর শেষ কোথায় ?
    Total Reply(0) Reply
  • রিজভী ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৫ এএম says : 0
    সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্তে পরিণত হয়েছে
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Atik ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৬ এএম says : 0
    সীমান্ত হত্যা এখন শুধু দলীয় বা বিরোধী দলীয় বিষয় না। এটা এখন জাতীয় ইস্যু। সবাই একত্রিত হয়ে একটা সুরাহা করা সময়ের দাবি।
    Total Reply(0) Reply
  • Miah Rahman ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:১৬ এএম says : 0
    যাক অবশেষে আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন. ভালো লাগলো দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসেন
    Total Reply(0) Reply
  • hbk ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:১৭ এএম says : 0
    স্বামী স্ত্রী র সম্পর্ক বলতে কথা , দুশ্চরিত্র স্বামী স্ত্রী কে পিটুনী দেয় এই আর কি,,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ