Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

কৃষিতে নতুন উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির সংযোজন দ্রুতায়িত করতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৩ এএম

করোনা মহামারিতে দেশের প্রায় সব খাতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ব্যতিক্রম কৃষি, কৃষির তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে, পরপর কয়েকবার ভয়াবহ বন্যায় শাক-সবজি, মাছ ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান এবার ৬-৭ লাখ মে.টন কম উৎপাদন হবে বলে মার্কিন কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। তাই সরকার ৫ লাখ মে.টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে জিটুজির মাধ্যমে। উপরন্তু রবিশস্য ও ইরি-বোরোর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সার, বীজ ও ঋণ সরবরাহ ব্যাপক বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষকও বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। প্রকৃতি অনুক‚ল থাকলে ফসল খুব ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের কৃষিতে সম্প্রতি অনেক নতুন বিষয় সংযুক্ত হয়েছে, যা খুবই কল্যাণকর। যেমন, হাইব্রিড, যান্ত্রিকরণ, প্রযুক্তি ইত্যাদি। ব্রি’র তথ্য মতে, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১০৫টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে ৯৭টি ইনব্রিড ও ৮টি হাইব্রিড। এসবের বেশিরভাগই উচ্চ ফলনশীল। এদের মধ্যে, সুস্বাদু, সুগন্ধযুক্ত, রফতানিযোগ্য, পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং খরা, বন্যা ও লবণ সহিঞ্চু জাতও রয়েছে। ব্রি এখন উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গুরুত্ব দিচ্ছে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও রফতানিযোগ্য ধানের জাত উদ্ভাবনের দিকে, যার কিছু ইতোমধ্যেই উদ্ভাবন করেছে সংস্থাটি। যেমন: জিংকসমৃদ্ধ, লৌহসমৃদ্ধ, লো জিআইসম্পন্ন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ, গাবা ইত্যাদি ধান। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ অপুষ্টির শিকার। এটা দূর করার জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ ধানের চাষ বৃদ্ধির দিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তাহলে পুষ্টির সমস্যা কিছুটা দূর হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। যা’হোক, দেশে হাইব্রিড ধান চাষের ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে অনেক। একইভাবে মাছ, মাংস, সবজি, তরকারি ও ফলের উৎপাদনও বেড়েছে ব্যাপক। খাদ্য উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ম্ভর হয়েছে (মসল্লা ছাড়া)। অপরদিকে, দেশের কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার অনেক আগে শুরু হয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে, ট্রাকটর, পাওয়ার ট্রিলার, সেচ মেশিন, রাইস মিল ইত্যাদি। এসবের সাথে সম্প্রতি রোপণ, নিড়ানি, মাড়াই, বস্তাবন্দি করার যন্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে। আরও বাড়ানোর জন্য চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষিযন্ত্র আমদানির জন্য।আমদানি শুল্কও রেয়াত করা হয়েছে। ফলে কৃষিতে যান্ত্রিকরণ আরও বাড়বে। যান্ত্রিকরণের এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্বল্প দিনের মধ্যেই দেশের কৃষি সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিকরণ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই যেখানে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানে ফসলের রোপণ, নিড়ানি, কাটা, মাড়াই, বস্তাবন্দি ও পরিবহন খুবই সহজতর ও সাশ্রয়ী হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘দেশের কৃষিতে যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৬০-৬৫%, সময় ৭৫% ও অপচয় ১০% বাঁচতে পারে ।উপরন্তু উৎপাদনও বাড়বে।’ অপরদিকে, কৃষিযন্ত্র সৌর বিদ্যুৎ চালিত হলে, বিশেষ করে সেচ মেশিনে, তাহলে উৎপাদন ব্যয় আরও অনেক কমে যাবে। ফসলের উৎপাদন ব্যয় ও অপচয় যত কমবে, মূল্যও তত কমবে। কৃষক ও ভোক্তা লাভবান হবে। তাই দেশের কৃষিকে সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিকীকরণ ও সব সেচ মেশিন সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চালানো দরকার। পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মেকানিক তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা অসংখ্য মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে। কৃষিতে যান্ত্রিকরণ বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে, যা খুব ভালো লক্ষণ।

কৃষিতে যান্ত্রিকরণে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন: বেশিরভাগ জমি ক্ষুদ্র। তাই যন্ত্র ব্যবহার করা কঠিন হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে গত ২০১৯ সালে গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা যায়, ‘২০১৮ সালে যেসব কৃষক বোরো আবাদ করেছেন, জমির পরিমাণের দিক থেকে তাদের প্রায় ৮৩% প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ ০.৫ থেকে ১.৪৯ একরের কম), আর মাত্র ৫% কৃষক ২.৫ একর বা তার বেশি পরিমাণ জমিতে আবাদ করেছেন’।এরূপ চিত্র কম-বেশি অন্য ফসলের ক্ষেত্রেও। কিন্তু এসব ক্ষুদ্র জমিতে যন্ত্র ব্যবহারে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিতেও স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। মুনাফাও কম হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম গত ২০ নভেম্বর বলেন, ‘উত্তরাধিকার আইনের কারণেই জমির খন্ড-বিখন্ডতা বাড়ছে, যা আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদে বাধা সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় আমাদের ক্রমান্বয়ে বৃহৎ খামারে যেতেই হবে। বৃহৎ জমি নিয়ে যেকোনো কৃষিভিত্তিক খামার করতে চাইলে আইনি বাধা ও অর্থায়ন ঘাটতি দূর করতে হবে।’ এই অবস্থায় কৃষিকে সমবায়ভিত্তিক করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য যে, দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখের মতো নিবন্ধিত সমবায় সমিতি এবং তাতে এক কোটির বেশি মানুষ জড়িত রয়েছে।এছাড়া,দেশের প্রায় সর্বত্রই বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য অনিবন্ধিত সমিতি রয়েছে এবং তাতে অসংখ্য মানুষ সংশ্লিষ্ট আছে। অর্থাৎ এ দেশের মানুষ সমবায়মুখী। তাই কৃষিকে সমবায়ভিত্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হলে তা সফল হবে।

গত ২৯ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘কৃষককে ভূমিহীন রেখে জিডিপি বা গ্রোথ রেট যতই বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে তা সব মিথ্যা কথা। জমির মালিকানা যতদিন না প্রকৃত উৎপাদক অর্থাৎ কৃষকের হাতে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কৃষির সমস্যার সমাধান হবে না।’ সভায় অন্য বক্তারা বলেন, ‘দেশের সিংহভাগ কৃষকই ভূমিহীন। তাই প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিশ্চিতে ভূমি আইনে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন।’ জাল যার জলা তার এবং সরকারি খাস জমি ভূমিহীনদের দেওয়ার নীতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এসব ভূমিহীনদের চেয়ে ধনীরাই ভোগ করছে বেশি। এতে সরকারের এ নীতির সুফল পাচ্ছে না ভূমিহীনরা। আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। এছাড়া, ভূমি সংস্কার করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক চাষিদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ‘হলিস্টিক ও ইনোভেটিভ’ সমাধান পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বায়ার, আইএফসি ও ন্যাটোফিম ২০১৮ সালে ‘বেটার লাইফ ফার্মিং’ অ্যালায়েন্সের যাত্রা শুরু করেছে।বাংলাদেশেও এটা গত ২৪ নভেম্বর শুরু করা হয়েছে।বায়ার ক্রপ সায়েন্স বাংলাদেশ, বিসিআইসি ও বায়ার এজির যৌথভাবে এটা পরিচালিত হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘মডেল কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করা। প্রতিটি সেন্টারে ৪-৬শ’ গ্রামের প্রায় ৫০০ কৃষক অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যারা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। সারাদেশে ইতোমধ্যেই ৩৫টি সেন্টার চালু করা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে মোট ৫০টি সেন্টার চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় মহিলা কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে মহিলা প্রান্তিক কৃষকদের কাছে সেবা পৌঁছানোর বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের কৃষিখাতে এ এক মহৎ উদ্যোগ। এটা সফল হলে গ্রামীণ মহিলাদের অনেক কল্যাণ হবে। অনেকের অভিমত, সমবায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা করা হলে কৃষক ও ভোক্তা লাভবান হবে ।এটা অনেক দেশেই সফল হয়েছে। অনেকে কৃষি পণ্য মূল্য কমিশন গঠনের কথা বলছেন।যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন রয়েছে। সেখানে পণ্যের মূল্য পর্যালোচনা করে বেঁধে দেয়। বাজারে পণ্য উদ্বৃত্ত হলে সরকার কিনে নেয় এবং পরে তা চাহিদার সময় বিক্রি করে। অবশ্য এরূপ ব্যবস্থা এ দেশেও আছে ধান-চালের ক্ষেত্রে।তাতে কৃষক-ভোক্তা লাভবান হচ্ছেন। একই ব্যবস্থা অন্য নিত্য পণ্যের ক্ষেত্রে করা হলে কৃষক ও ভোক্তা খুবই লাভবান হবে।

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এবং তার অনেক সুফল পাওয়া যাচ্ছে। দেশীয় উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতিও ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন: কচুরি পানা ও ঘাস দিয়ে ভাসমান মাচা এবং প্লাস্টিক ও মাটির পণ্যে সবজি চাষ, ছাদ বাগান, বাঁশের ৩-৪ তলার মাচায় চাষ,ভাসমান খাঁচায় ও বাসা-বাড়িতে চৌবাচ্চায় মাছ চাষ, জৈব সার,সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, সুষম সার ব্যবহার ইত্যাদি। এছাড়া, হারিকেন বাতির উত্তাপে হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো, গাভীর কৃত্রিম প্রজননে দেশীয় উদ্ভাবিত ডিভাইস ব্যবহার ইত্যাদি। এসবেরও সুফল পাওয়া যাচ্ছে অনেক। বারির বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাসুদ আলম ১৮ ধরনের মসলার গুঁড়া, স্লাইস কিংবা পেস্ট বা সস-আচার ইত্যাদি তৈরি ও পলিব্যাগে মোড়কজাত করার নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। মসলাগুলো হচ্ছে: পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, রসুন, আদা ও অলস্পাইসের (চায়নিজ মসলা) গুঁড়া, কাঁচা মরিচের পেস্ট ও আচার, শুকনা মরিচের আচার ও সস, কাঁচা মরিচ খাদ্যজাতকরণ (অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায়), রসুনের আচার, কেচাপ ও চাটনি, আদার আচার ও জ্যাম, হলুদের পেস্ট, অলস্পাইসের পেস্ট এবং অ্যানাটো পাউডার। বিজ্ঞানী আলম বলেছেন, ‘তার এই উদ্ভাবন দেশে ব্যবহৃত হলে মসলার অপচয় ৩০% রোধ হবে, স্বাদ ও গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকবে, দুই-তিন বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে এবং ভোক্তা ও উদ্যোক্তারা সহজেই এসব কাজ করতে পারবেন।’ হ্যাঁ, বিজ্ঞানী আলমের এই উদ্ভাবন কাজে লাগাতে পারলে দেশের অনেক কল্যাণ হবে। যেমন: গৃহিণীদের পরিশ্রম কমবে, মসল্লার অপচয় রোধ হবে, মূল্য সারা বছর একই থাকবে, সংশ্লিষ্ট পণ্যের সিজনে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে, মসল্লার ঘাটতি দূর হবে, মসল্লার ফুল সিজনে স্বল্প মূল্যে আমদানি করে তা প্রসেস করে রফতানির করে বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব। উপরন্তু অনেক লোকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে। বিজ্ঞানী আলমের উদ্ভাবনের সদ্ব্যবহার আবশ্যক। এ দায়িত্ব প্রধানত ব্যবসায়ীদের। এদিকে, দেশের এক তরুণ উদ্ভাবন করেছেন পাটের বাইসাইকেল, যা সরকারের এটুআই পুরস্কার ও বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। ২০২১ সালেই ঢাকার রাস্তায় দেখা যেতে পারে এই সাইকেল। এর আগে পাট থেকে পচনশীল পলিব্যাগ তৈরি করেছেন বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানী। পাটের এসব নতুন উদ্ভাবন কাজে লাগাতে পারলে পাটের সুদিন ফিরে আসবে এবং পরিবেশের সুরক্ষা হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্টার্ট-আপ ‘ইট জাস্ট’ গবেষণাগারে মুরগির মাংস তৈরি করেছে এবং তা বাজারজাতও হয়েছে। এ মাংস কোনও প্রাণীকে হত্যা করে প্রস্তুত করা হয় না।এটা প্রাণীর পেশিকোষ কালচার করে তৈরি করা হয়। এর আগে ‘বয়ন্ড মিট ইনকর্পোরেটেড’ এবং ‘ইমপসবল ফুডস’ নামে দুটি সংস্থা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন থেকে মাংস তৈরি করেছে। জেপি মর্গান চেজ-এর মতে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে উদ্ভিজ্জ মাংসের বাজারের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি ডলার। গত ২ নভেম্বর ইট জাস্টের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বর্তমানে হিমাগারের তৈরি মুরগির মাংসের মূল্য বেশি। কিন্তু স্বল্প দিনের মধ্যেই প্রিমিয়াম মুরগির সমান দামে পাওয়া যাবে। বর্তমানে বিশ্বে দুই ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষাগারে মাছ, গরু ও মুরগির মাংস নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৯ সাল নাগাদ বিকল্প মাংসের বাজার দাঁড়াবে ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা বৈশ্বিক মাংসের ১০%। এসব উদ্ভাবন খাদ্য চাহিদা পূরণে বিশাল ভূমিকা পালন করবে।

মুসলমানদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এমনকি, অমুসলিমদের মধ্যেও। তাই ম্যাকডোনাল, কেএফসি ও অনেক বড় প্রতিষ্ঠান হালাল খাবার বিক্রি করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে এই খাত থেকে প্রায় ৮.৫ হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এটা আরও ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। কারণ, থমসন রয়টার্সের ‘দ্য স্টেট অব দ্য গ্লােবাল ইসলামিক ইকোনমি’ শীর্ষক রিপোর্ট মতে, ‘২০২২ সালে হালাল পণ্যের বাজার দাঁড়াবে ৩ বিলিয়ন ডলার।’ ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হকও স¤প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘২০২৪ সালের মধ্যে হালাল পণ্যের বৈশ্বিক বাজার হবে ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের। আগামী ৫ বছরে ৬.১% হারে চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়বে এই বাজার।’ বৈশ্বিক এ বিশাল বাজার দখলে রয়েছে মালয়েশিয়ার। এর একটা অংশ যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে আমাদের রফতানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৫ হাজার কোটি টাকার অধিক বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত। তাই এই বিশাল বাজার ধরার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। আগামী ১০ বছরে এই লক্ষ্য অর্জনে কাজ শুরু করা হয়েছে। ইসলামিক বিধানে যে ধরণের পণ্য ও সেবা গ্রহণের অনুমোদন রয়েছে, সেগুলোকে হালাল বলা হয়। হালাল নির্ধারণ করা হয় ব্যবহ্নত কাঁচামাল, উৎপাদন প্রক্রিয়া ইত্যাদি ইসলামিক বিধান অনুযায়ী কি-না তা বিবেচনা করে।তাই দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের হালাল সার্টিফিকেশন অথরিটি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ৬ মন্ত্রণালয় ও ৫টি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ একটি সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। হালাল পণ্য প্রস্তুত করার জন্য স্থাপন করা হবে একটি পৃথক অর্থনৈতিক জোন। সম্ভাব্য রফতানি পণ্য হচ্ছে: শাক-সবজি, ফল-মূল, মসল্লা, গরুর মাংস, মাছ, ওষুধ, হিমায়িত খাদ্য, হিমায়িত মুরগির মাংস ও মুরগির মাংসের তৈরি বিভিন্ন পণ্য। নিউজিল্যান্ড এই খাতে বড় বিনিয়োগ করবে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। এটা খুবই মহৎ উদ্যোগ। তাই এই উদ্যোগ সময়মতো সফলভাবে বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। তাহলে দেশের কৃষি খাতের নবতর পথ সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ রফতানি যোগ্য হালাল কৃষি পণ্যের উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রফতানি অনেক বেড়ে যাবে।

গত কুরবানীর সময় ৩০-৪০ মন ওজনের গরু বিক্রি হয়েছে অনেক। যা দেশে উৎপাদিত। এফএও’র মতে, চলতি বছর বাংলাদেশে পালনকৃত গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি। গবাদিপশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ। বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটকে অন্যতম সেরা জাতের ছাগল বলে স্বীকৃতি দিয়েছে এফএও। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। দেশে প্রতি বছর গড়ে ২.২০ কোটি ছাগল উৎপাদন হয়, যার ৯৫% ব্ল্যাক বেঙ্গল।২০১৮ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জেনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। দেশে উৎপাদিত টার্কি মুরগির মাংস খুবই সুস্বাদু। তাই এর মূল্য দেশি মুরগির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। উৎপাদনও কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া, স¤প্রতি বিরল প্রজাতির কালো মুরগির চাষ হচ্ছে। এটি মূলত ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের প্রাণী। এর মাথার ঝুঁটি থেকে পা পর্যন্ত সবকিছুই কালো। এই মুরগির মাংসের পুষ্টিগুণ বেশি। ব্যাধিও খুব কম। তাই বাঁচে বেশিদিন।চাষেও ব্যয় কম।ফলে কালো মুরগির মূল্য অত্যধিক।তাই এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হালাল পণ্য হিসাবে এসব প্রাণীর মাংস রফতানি করতে পারলে দেশের চতুরমুখি কল্যাণ হবে।
দেশে বর্তমানে কৃষির অবস্থান জিডিপিতে তৃতীয় আর শ্রমশক্তির অর্ধেক। উপরন্তু কৃষির উৎপাদনের বেশিরভাগ কাঁচামালই দেশীয়। তাই কৃষির উন্নতিই দেশের প্রকৃত উন্নতি, টেকসই উন্নতি ও সার্বিক উন্নতি। যা অন্য খাতে সম্ভব নয়। তাই দেশের কৃষির উন্নতির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, দেশে ক্রমান্বয়ে মানুষ বাড়ছে, কৃষি জমি কমছে,প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। তাই চাষযোগ্য সব জমিতেই অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহার করে এবং শস্য বহুমুখিকরণ করে খাদ্য উৎপাদন অনেক বাড়াতে হবে। নতুবা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা টেকসই হবে না। খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষি


আরও
আরও পড়ুন