Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি কতটা ইউটার্ন নিতে পারে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০২০, ১:০২ পিএম

ট্রাম্প জমানার বিদেশ নীতি আমূল বদলে দেবেন বাইডেন। ডেমোক্র্যাট শিবিরের নির্বাচনী ইস্তেহার ও প্রচার থেকেই তা অনেকখানি স্পষ্ট হয়েছিল। ইরান ইস্যুতে বাইডেন বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন। তবে ইরান এতে খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

এবার কত ডিগ্রি ঘুরতে পারে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি। বাইডেনের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের ব্যাপারে ১৮০ ডিগ্রি না হলেও বেশ কিছুটা আশাবাদী পর্যবেক্ষক মহল। বিশেষ করে ইরান এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে অল্পবিস্তর ইতিবাচক ভাবনা পোষণ করছেন অনেকে।

ইরানের বিদেশমন্ত্রী তথা পরমাণু চুক্তির অন্যতম কুশিলব মুহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি যখন সই হয়, তখন ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেই সরকারে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। সুতরাং তাঁকে আর নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। তিনি পুরো বিষয়টা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। তাই বাইডেনের উচিত সবার আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা। তারপর পরবর্তী করণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, ট্রাম্প জমানার ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করার সুযোগ পেয়েছেন বাইডেন। তাই তাঁর উচিত যত শীঘ্র সম্ভব পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যাওয়া। রুহানি এও বলেছেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ তত্ত্ব আউড়ে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যে বিভাজন ও দূরত্ব তৈরি করছেন ট্রাম্প, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সদর্থক পদক্ষেপ করতে হবে বাইডেনকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইডেন প্রথম দফায় মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নামের যে তালিকা ঘোষণা করেছেন, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এবার বিদেশনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য নীতির খোলনলচে অনেকটাই বদলে যাবে। ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তির অন্যতম কারিগর প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী জন কেরিকে ফিরিয়ে ইরানকে ইতিবাচক বার্তা দিলেন বাইডেন। যদিও জন কেরি এবার বিদেশমন্ত্রী হচ্ছেন না। তাকে জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা করা হয়েছে। তবুও হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রত্যাবর্তন ইরানের কাছে অবশ্যই কিছুটা আলোর দিশা। মনে করা হচ্ছে, জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা হলেও ইরান-চুক্তি পুনর্বিবেচনা বিষয়ক অতিরিক্ত দায়িত্ব পেতে পারেন কেরি। যেহেতু তিনিই ছিলেন ওবামা-বাইডেন সরকারের বিদেশমন্ত্রী এবং চুক্তি সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানেন তিনি।

এবার বিদেশমন্ত্রী হচ্ছেন অ্যান্টনি ব্লিনকেন। যিনি ওবামা এবং বিল ক্লিনটন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ফিলিস্তিন, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তিনি বরাবরই ট্রাম্পের নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বাইডেনের বিদেশনীতি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য মুখ হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান, রাষ্ট্রসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড প্রমুখ। এদের সবার যৌথ প্রয়াসেই আমেরিকার নতুন বিদেশ নীতি প্রতিফলিত হবে। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবেন ৪৬তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বদল আনতে হলে ইসরাইল এবং আরব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে বাইডেনকে। কারণ, এই দুটো বিষয় মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ট্রাম্প ইসরাইল এবং আরবকে মাথায় তোলায় গত ৪ বছরে সলিল সমাধি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবার ইসরাইল, আরব এবং মিশরের ব্যাপারে অবস্থান বদলাতে হবে বাইডেনকে। নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের সখ্যতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্পর্কটা এতটাই গভীরে যে, বহুবার সুটকেস বোঝাই করে নোংরা জামা-কাপড় নিয়ে আমেরিকা সফর করতেন নেতানিয়াহু। কারণ, বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ট্রাম্পের অতিথি নিবাসে ফ্রি-তে ময়লা পোশাক সাফসুতরো করার জন্য একদল ধোপা নিযুক্ত রয়েছেন। নেতানিয়াহুর এহেন আচরণে বিরক্ত হয়েই তাঁরা এই তথ্য ফাঁস করেন। যার প্রতিবাদে সম্প্রতি নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনে নোংরা জামা-কাপড়ের স্তুপ বানিয়ে বিক্ষোভ দেখান কয়েক হাজার ইসরাইলি নাগরিক।

অন্যদিকে, আরবদের সঙ্গে ট্রাম্পের দহরম-মহরম দেখে তো পাগলেরও হাসি পায়। ট্রাম্পের বদৌলতে ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক আর ঘোমটার আড়ালে নেই। এর কৃতিত্ব পুরোটাই ট্রাম্পের প্রাপ্য। ২০১৭ সালে মসনদে বসে প্রথমেই সউদি সফরে গিয়ে আরব বিশ্বের একঝাঁক রাষ্ট্রপ্রধানকে সামনে বসিয়ে ট্রাম্প যেভাবে ইরান ও কাতারের বিরুদ্ধে কামান দাগেন তা থেকেই বোঝা গিয়েছিল তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি কেমন হবে। সেই মতোই ট্রাম্পের হুকুমের গোলাম বনে গিয়ে কাতারকে কোণঠাসা করতে মরিয়া প্রয়াস চালিয়েছিল আরবরা। যদিও গত ৪ বছরে ইরান-কাতারের একগাছা পশমও সোজা করতে পারেনি আমেরিকা, আরব ও ইসরাইল ত্রয়ী।

অবশ্য কাতার সম্পর্কে বিলম্বে বোধোদয় হয় আরবদের। তখন তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করে হরেক রকম শর্ত দিয়েও কাতারের মান ভাঙাতে পারেনি। কাতার তাদের মুখের ওপর স্পষ্ট বলেছে– সংকটকালে ইরান ও তুরস্ক যেভাবে তাদেরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা কোনওদিন ভোলা সম্ভব নয়। কাতার এও বলেছিল, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানো ইরান-তুরস্কের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে আরবদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারবে না।

অতি সম্প্রতি আমেরিকা কাতারকে অফার দিয়ে বলে, ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তিতে সই করলে আরবরা বয়কট তুলে নেবে। কাতার সে প্রস্তাবও পত্রপাট নাকচ করে দিলে সউদি প্রিন্স বলেন, ইরান-তুরস্ক ও কাতার হল ‘অশুভ ত্রিশক্তি।’

ট্রাম্পের বিদেশ নীতিতে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিলিস্তিন। পূর্ব জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তর করেছেন। জর্ডন নদীর পশ্চিমতীর এবং গোলান মালভূমিও ইসরাইলকে পাইয়ে দিতে এক্সিকিউটিভ অর্ডারে সই করেছেন তিনি। যেন জেরুসালেম, গোলান ইত্যাদি ট্রাম্পের পৈতৃক সম্পত্তি।

সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে চিরতরে মুছে দিয়ে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাসের চাবিকাঠি ইসরাইলের হাতে তুলে দিতে ‘ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ বানিয়েছেন। আরবরা যাতে ইসরাইলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, সে জন্য এখন নতুন আরেকটা বিতর্কিত চুক্তি নিয়ে দৌত্য চালাচ্ছেন ট্রাম্পের বিদেশমন্ত্রী। আপাতত ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে চুক্তি সই করেছে আমিরশাহী ও বাহরাইন। ওয়েটিং লিস্টে থাকা সউদি আরব, জর্ডন, কুয়েত, ওমান, মিশর, সুদানকে রাজি করাতে নানা রকম আশ্বাস ও অফার নিয়ে হন্যে হয়ে দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছেন মার্কিন বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পেও।

অন্যদিকে বারাক ওবামা আক্ষেপ করে বলেছেন, ট্রাম্প গত ৪ বছরে ঘরে-বাইরে আমেরিকার ভাবমূর্তিকে যেভাবে কলঙ্কিত করেছেন তা পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। একটা নির্বাচনের ফলাফল সেই বিভাজন ও মেরুকরণের প্রভাব মুছতে পারবে না। ট্রাম্প জমানায় প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক পরিকাঠামো অবলুপ্ত হয়েছে, ভেঙে পড়েছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মানদণ্ড। বিদেশ নীতি স্বৈরাচারিতার সীমা লঙ্ঘন করেছে।

আন্তর্জাতিক মহলে আমেরিকার ভাবমূর্তি ভূলুন্ঠিত হয়েছে। একইসঙ্গে ওয়াশিংটন প্রশাসনে ক্ষমতার দম্ভ কায়েম হয়েছে। সবক্ষেত্রে হঠকারিতা ও অদূরদর্শিতার পরিণতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘন ঘন বয়ান ও অবস্থান বদলে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন যার মাশুল দিতে হবে নতুন সরকারকে। বাইডেনকে তার নিজের অ্যাজেন্ডার থেকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে পুরোনো গৌরব ফেরানোর ব্যাপারে। এটাই বাইডেনের কাছে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং এবং ট্র্যাজেডি। পুবের কলম



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্র


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ