পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোভিড-১৯ অর্থনীতির নানা খাতে বড় ক্ষত সৃষ্টি করেছে। শুধু অর্থনীতি নয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনমান, সামাজিক অনুষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃদেশীয় লেনদেনেও পরিবর্তনের দৃশ্য লক্ষ্যনীয়। একদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাব, তার উপর বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। কিন্তু এই ভয়াবহতার মাঝেও আশার আলো জ্বলে উঠছে। বাংলাদেশিরা অনেক আশাবাদী, অনেক সাহসী। অর্থনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের সাহসী উদ্যোগের সাথে জনগণ, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর চেষ্টার অন্যতম সাহসী সৈনিক হলো কৃষকসহ গ্রামীণ উদ্যোক্তরা। করোনার মাঝেও আমাদের কৃষি উৎপাদন, খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত আছে। কৃষি উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর, বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্নিঝড়, প্রায় প্রতি বছরই আমাদের দেশে হানা দেয়। এতে কৃষি উৎপাদন ব্যহত হয়। এ বছর করোনা মহামারি ও বন্যা এক সাথে হওয়ায় কৃষি উৎপাদন কাক্সিক্ষত মানের হচ্ছে না। তাছাড়া কোথাও বাঁধ ভেঙ্গে, কোথাও ঘূর্নিঝড়ের প্রকোপে, জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। এতে কৃষকেরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাল, মরিচ, আলু, তরমুজসহ অনেক রবিশস্য উৎপাদন ব্যহত হয়েছে। করোনার কারণে উৎপাদিত ফসল পরিবহনেও সমস্যা দেখা দেয়। ফলে কৃষকেরা তাদের কাংক্ষিত মূল্য পায়নি। করোনা যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে তাই কৃষি উৎপাদন, ফসল ও শাক-সবজি উৎপাদন কৃষকদের সহায়তা করা উচিত। প্রয়োজনীয় সার, বীজ ও কীটনাশক কম মূল্যে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা উচিত। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণও গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে যুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া করোনার কারণে শহরের বেকার, যুবক, খেটে খাওয়া শ্রমিকেরাও গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। ন্যূনতম আশ্রয়টা পাওয়া যাবে- এ চিন্তায় তারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্ব সামনে এসেছে। তাছাড়া টেকশই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জনের জন্য গ্রামীণ অর্থনীতি ইতিবাচক রূপান্তর এখন সময়ের দাবি।
গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে শষ্য উৎপাদন ছাড়াও মৎস্য চাষ, ফুল চাষ, পোলট্রি, সবজি চাষসহ বিভিন্ন ফলের চাষ ইত্যাদিকে বুঝায়। অর্থনীতিতে এগুলোর অনেক অবদান রয়েছে। জিডিপিতে এসবের অবদান ১৮-১৯ শতাংশ। এ হিসাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে ছোট করে দেখা ঠিক না। আজকাল গ্রামের রাস্তা-ঘাট ও উন্নত হয়েছে। শুধু কিছু কিছু এলাকায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রামে বিস্তার লাভ করছে। ইদানিং ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন এজেন্ট ব্যাংক আউটলেট ও উপশাখা স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনশক্তিকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মধ্যে সংম্পৃক্ত করে চলেছে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হচ্ছে। অনেক গ্রামে তরুণ উদ্যোক্তরা নানা প্রজেক্ট স্থাপন করছে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। করোনার কারণে দেশের বিপুল জনশক্তি বেকার হয়ে পড়ছে। এতে প্রায় ১৩% লোক নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছে। তাছাড়া বিদেশ থেকে অনেক প্রবাসী দেশে ফেরত এসেছে। তারা পুনরায় বিদেশে কখন যেতে পারবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। সব মিলিয়ে করোনাকালে জীবন-জীবিকা কঠিন হয়ে গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করছে এবং বিতরণ করছে তা দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে না। তাই অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করা অত্যন্ত জরুরি। গ্রামের প্রতি মানুষের মনোযোগ বাড়াতে হবে। গ্রামে অনেক কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান শহর ও গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকায় অনেক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্কিম থাকলেও তাদের ট্রেড লাইসেন্স বা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের অভাবে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে ঋণ পেতে বেগ পেতে হয়। তাছাড়া গ্রামে লন্ডি, সেলুন, সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতাসহ অনেক উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা ও বিনিয়োগ প্রদানে সহায়তা করলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। আত্ম কর্মসংস্থান বাড়বে।
গ্রামে যে সকল শাক-সবজি, ফল, ফসল উৎপাদিত হয় তা প্রক্রিয়াজাত করে এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সারা বছর সরবরাহ জোরদার করা যেতে পারে। আমরা জানি, আমাদের গার্মেন্ট শিল্প দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন বা সুষম উন্নয়নের জন্য গ্রামের মৎস্য শিল্প, গবাদী পশু ও পোলট্রি খাত, কুটির শিল্পসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন ও বিপণনমুখী খাতগুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে। এসব খাতের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি প্রয়োজন। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। গত পাঁচ দশকে দেশে মোট জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। একই সময়ে কৃষি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। কিন্তু বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে কৃষি খাত ব্যর্থ হয়নি, বরং প্রাকৃতিক দুযোগ, বন্যা, ঘূর্নিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে কৃষি উৎপাদন বার বার বাধার সম্মুখীন হলেও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সরকারের প্রচেষ্টা ও কৃষকদের সর্বাঙ্গীন চেষ্টার ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ লোক গ্রামে বাস করে। ২০০০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক (৪৯ শতাংশ) দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করত। গত তিন দশকে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠির সংখ্যা সামগ্রিকভাবে প্রায়ই অর্ধেকে (২৪ শতাংশ) নেমে এসেছে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষত কৃষির অবদানই অনেক। গ্রামীণ অর্থনীতি অন্যতম খাত হলো কৃষি। খাদ্য শস্য উৎপাদন, মৎস্য উৎপাদন, পোলট্রি ও গবাদি পশু পালনে যদি আমরা উন্নতি করতে না পারতাম তাহলে বিশাল জনগোষ্ঠির খাদ্য সংস্থান কঠিন হত। সাড়ে সাত কোটি থেকে মানুষ ১৭ কোটি হয়ে গেল, এর পরও খাদ্যে সমস্যা হয়নি। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির বিরাট ভূমিকা রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে গ্রামীণ অর্থনীতিকে বেগবান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও মানুষের আয় বাড়াতে হবে।
আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি ইতিবাচক রূপান্তর প্রয়োজন। এজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমানো, মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ জোরদার করা উচিত। যন্ত্র ও প্রযুক্তির ছোঁয়াই গ্রামীণ অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। গ্রামে যে বিশাল তরুণ সমাজ রয়েছে তাদের কৃষিতে নিয়োজিত করতে হলে, অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত করতে হলে কৃষিতে যান্ত্রিকীতিকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে কোনো বিকল্প নাই। গ্রামের তরুণ বা কৃষকের সন্তানরা আজকাল শিক্ষিত ও বেশ পরিপাটি থাকতে চায়। তাই উন্নত যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে তারা কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতে কাজে আগ্রহী হবে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কৃষি পণ্য রপ্তানি ও দেশের কর্মসংস্থানে এই খাতটি ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ধান উৎপাদন বাড়াতে হবে। কৃষকেরা যাতে ধানের দাম ভালো পায়, তাদের উৎপাদন ব্যয় যত কম হবে মুনাফা ও বাড়বে তাতে তারা উৎপাদনে আগ্রহী হবে। লাভজনক ধান উৎপাদন করতে হলে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। এতে কৃষি শ্রমিকের মজুরী বাবদ কৃষকের ব্যয় কমে আসবে, যথাসময় ধান কাটতে পারবে, ধানের অপচয় কমে যাবে। শস্যের নিবিড়তা বাড়বে। ধান চাষে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। তাছাড়া আলু ও ভুট্টা চাষেও যান্ত্রিকীকরণ যথেষ্ট প্রয়োজন। গ্রামের নালা, ডোবা ও যেসব স্থানে ফসল হয় না ঐ সকল নিম্ন পতিত জমিতে মৎস্য খামার করে মাছ উৎপাদনে গ্রামের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। তাছাড়া মাছের প্রক্রিয়াকরণ ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে মাছের আঁশ ও নাড়িভুড়ি ঔষধ শিল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে। মুরগী পালন ও গবাদিপশুতে ও যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধি করে কম সময়ে অধিক উৎপাদন বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার সুযোগ রয়েছে। গ্রামীণ জনশক্তির শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি না হলে গ্রামীণ অর্থনীতি গতিশীল হবে না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যদি শিক্ষা না পায়, স্বাস্থ্য ঠিক না রাখতে পারে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে পারবে না। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত হবে না। গ্রামের মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য শাসন ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। স্থানীয় সরকার স্তরগুলো-ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় বাধ নির্মাণ, বনায়ন বৃদ্ধি, আশ্রয়স্থল নির্মাণ ও বন্যা কবলিত এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, নির্মাণ যেন পরিবেশবান্ধব হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুতির আর একটি দিক হলো গ্রামের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা। অর্থাৎ তাদের আয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজনে ঋণ দানের মাধ্যমে তাদের সচল রাখা। আমাদের সার্বিক উন্নয়ন কৌশলের সাথে গ্রামীণ উন্নয়নকে সংযুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।