Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নবী-চরিত্রের একটুখানি পাঠ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০২০, ১২:১৬ এএম

বলাবাহুল্য, বিরূপ মন্তব্যকারী ব্যক্তিদ্বয় খাঁটি মুমিন ছিল না। তারা ছিল মুনাফিক। হযরত ইবনে মাসঊদ রা.-এর মত একজন খাঁটি মুমিন ও আশেকে রাসূলের পক্ষে তাদের বেআদবীপূর্ণ উক্তি শুনে চুপ করে যাওয়া সম্ভবপর হওয়ার কথা নয়। তাঁর ইশক ও মহব্বতের দাবি তো এটাই ছিল যে, সে কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দেবেন। তিনি তা জানানোর আগে এ কথা উল্লেখও করেছিলেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে কারও সম্পর্কে কোনও কথা আপনাকে জানাতে নিষেধ করেছেন। তার মানে এ নিষেধাজ্ঞা পালনের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন। তা সত্তে¡ও যে তিনি লোক দু’টির স্পর্ধিত উক্তি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করলেন, তা ইশক ও মহব্বতের দাবি অনুসারেই করেছিলেন। এ কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সে ইশক ও মহব্বত সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তথাপি এটা অপসন্দ করা ছিল তাঁর মহত্তর চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি যে সকলের ব্যাপারে কতটা স্বচ্ছ ও নির্মল হৃদয়ে থাকতে চাইতেন, এটা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।
সকলের প্রতি অন্তর অমলিন রাখার যে আদর্শ তিনি লালন করতেন, প্রিয় সাহাবীদেরকেও তাতে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। এ হাদীসে যেমন দেখা যায় প্রিয় খাদেমকে উৎসাহ দিচ্ছেন, যেন তিনিও সর্বক্ষণ নিজ মন সকলের প্রতি নির্মল রাখেন। কারও প্রতি মনে কোনও কষ্ট, ক্ষোভ ও বিদ্বেষ পোষণ না করেন। এ হাদীসে আমাদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। তা হচ্ছে অধীনস্তদের তালীম তারবিয়াতের ব্যবস্থা গ্রহণ; বিশেষত খাদেম ও ভৃত্য-অনুচরদের জন্য। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাস খাদেম। ঘরে-বাইরে সর্বত্র খেদমতের জন্য তিনি তাঁর সংগে সংগে থাকতেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছ থেকে কেবল খেদমত গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হতেন না; প্রয়োজনীয় শিক্ষা-দীক্ষাও তাঁকে দান করতেন। তত্ত্ব ও তথ্যমূলক জ্ঞানের পাশাপাশি তাঁর চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা ও আখলাক-চরিত্র গঠনের প্রতিও লক্ষ রাখতেন। অর্থাৎ তালীমের পাশাপাশি তারবিয়াতও দান করতেন। এ হাদীসটি তাঁর সে তারবিয়াতেরই অংশ। তিনি নিজে যেমন সকলের প্রতি ‘সালীমুস-সাদ্র’ তথা অমলিন মনের হয়ে থাকতে চাইতেন, প্রিয় খাদেমও যেন সদা-সর্বদা সেরকম থাকেন, সেই সবক এতে তাকে দান করেছেন। কী গভীর স্নেহ-মমতার সম্বোধন এতে লক্ষ করা যায়। ‘ওহে আমার প্রিয়পুত্র! বাছা হে!’ এভাবে পরম যত্নের সাথে তিনি প্রিয় খাদেমকে মনের মত করে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে পরবর্তী জীবনে তিনি সারা জগতের মাখদূমে পরিণত হয়েছিলেন। আজ সারা জাহানের মুসলিম গভীর শ্রদ্ধার সংগে হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.-এর নাম নিয়ে থাকে। শত শত বছর যাবৎ কত অগণ্য মানুষ তার থেকে তালীম ও তারবিয়াতমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে। কত শত শত হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন। নবী-জীবনের কত তথ্য তিনি মানুষের কাছে সরবরাহ করেছেন। এ আর কিছুই নয়, প্রিয় খাদেমকে শিক্ষা-দীক্ষায় মনের মত করে গড়ে তোলার যে প্রযত্ন তিনি নিয়েছিলেন, কেবল তারই ফল। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও আমাদের অধীন, বিশেষত খাদেম-সেবকদের তালীম তারবিয়াতের প্রতি যত্নবান হব কি?
যাহোক, কথা হচ্ছিল মানুষের প্রতি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনের স্বচ্ছতা সম্পর্কে। এটা ছিল তাঁর মহান চরিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জীবন গড়ার নমুনা। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকই সারা জাহানের মানুষের জন্য আদর্শ। প্রতিটি মানুষের কর্তব্য সে অনুযায়ী নিজ জীবন গড়া। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন ও মুসলিম বলে বিশ্বাস করে, তার যে এ ব্যাপারে কত বেশি যত্নবান থাকা উচিত তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বলা যতই বাহুল্য হোক না কেন, নৈতিক অবক্ষয়ের যে পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গেছি, তাতে এ কথা কেবল বলাই নয়; বারবার বলা এবং শতমুখে বলা অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আজ আমরা কথায় কথায় একে অন্যের প্রতি মন খারাপ করে ফেলি। তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে মন এত বেশি মলিন হয়ে যায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভালো কিছুর প্রতিবিম্ব তাতে আর ধরা পড়ে না। এ ব্যাপারে আপন-পরেরও কোনও বালাই থাকে না। কথা তো ছিল পরের ব্যাপারেও সর্বদা ইনসাফের পরিচয় দেব। তার মন্দটি কেবল সেই মন্দতেই সীমাবদ্ধ রাখব। কিন্তু আমরা তা করি না। তার একটি মন্দ আমাদের অন্তরকে এমন ছায়াচ্ছন্ন করে ফেলে যে, ওই অন্তরের আয়নায় সে ব্যক্তির কোনও ভালো গুণ আর ধরা পড়ে না। ওই একই অবস্থা আমাদের আপনজনদের ক্ষেত্রেও। কোনও এক ব্যাপারে আপনার কারও সাথে বিরোধ দেখা দিলে বা তার কোনও এক অপ্রীতিকর আচরণের সম্মুখীন হলে তার শুভ সবকিছু বেমালুম ভুলে যাই। তার ব্যাপারে মন সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। অতপর তার কোনওকিছুই প্রীতিকর থাকে না। তার মুখ দেখতে মনে চায় না। তার কথা শুনতে ভালো লাগে না। তার প্রতিটি বিষয়ই বিস্বাদ ঠেকে। যেন সে আমার চিরদিনের শত্রু। এমন তো কিছুতেই হওয়া উচিত ছিল না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের সংগে এ স্বভাবের কোনও মিল নেই। তাঁর সুন্নত অনুযায়ী মন হওয়া দরকার অনেক বড়। কারও ব্যাপারে সহজে তা মলিন হওয়াই উচিত না। যদি কোনওক্রমে মলিন হয়েও যায়, তবে সে মলিনতা যত দ্রুত সম্ভব দূর করে ফেলা উচিত। সমস্ত মানুষ এক আদম সন্তান। সব মুসলিম ভাই ভাই। অন্যের প্রতি আচরণেও থাকা উচিত ভ্রাতৃত্বের স্পর্শ এবং অন্যের আচরণ গ্রহণেও চাই ঔদার্য্যরে ছোঁয়া। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত তো আমাদের সে শিক্ষাই দান করে। এ সুন্নতের অনুসরণ করলে আমাদের জীবন হতে পারে অনেক সুন্দর, অনেক শান্তিময়। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নবী-চরিত্র
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ