Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নবী-চরিত্রের একটুখানি পাঠ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৭ এএম

হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন, হে বাছা! যদি তোমার পক্ষে সকাল-সন্ধ্যা এভাবে কাটানো সম্ভব হয় যে, তোমার অন্তরে কারও প্রতি মলিনতা নেই, তবে সেভাবে কাটাবে। তারপর বললেন, হে বাছা! এটা আমার সুন্নত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে যিন্দা করল, সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সংগে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৮
এ হাদীস দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও জীবনাদর্শের একটি দিক সম্পর্কে আলো পাওয়া যায়। তিনি সে আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য সরাসরি প্রিয় খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.-কে উপদেশ দিয়েছেন। আর তার মাধ্যমে এ উপদেশ তাঁর উম্মতের সকলের প্রতি। যেন তাঁর উম্মতের প্রত্যেকে এ আলোয় আলোকিত হয়।
তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.-কে উপদেশ দিয়েছেন, যে-কোনও মানুষের ব্যাপারে তার অন্তর নির্মল রাখতে। সকাল-সন্ধ্যা এভাবে কাটাবেন যে, তার অন্তরে কারও প্রতি কোনও হিংসা-বিদ্বেষ নেই, কোনও দুঃখ-কষ্ট নেই এবং কোনও রাগ ও ক্ষোভ নেই। যে যত দুঃখ-কষ্ট দিক, মনে যত বড় আঘাতই দিক, অবিলম্বে সে আঘাতের চিহ্ন মুছে ফেলবে। মুখে ক্ষমা ঘোষণা করবে এবং অন্তর পরিষ্কার করে ফেলার চেষ্টা করবে। যেন কোনও দিন তার পক্ষ থেকে সে কোনও কষ্ট পায়ইনি।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাচ্ছেন এটা তাঁর সুন্নত- তাঁর জীবনাদর্শ। তিনি সারাটা জীবন এভাবেই কাটিয়েছেন। কত মানুষ তাঁকে কতভাবে কষ্ট দিয়েছে।
তিনি জগতের শ্রেষ্ঠতম সত্যবাদী। তা সত্ত্বেও বিরুদ্ধবাদীরা তাঁকে মিথ্যুক বলে গালি দিয়েছে। তাঁর মত সুস্থ-নিখুঁত বুদ্ধি কার কখন ছিল? তথাপি তারা তাঁকে পাগল আখ্যায়িত করেছে। সর্বকালের সর্বোত্তম সারগর্ভ কথা তিনিই বলতেন। তারপরও তাঁর অমূল্য কথাকে অসার কল্পনা ঠাওরানোর মতলবে তাঁকে কবি বলে কটাক্ষ করত। মানুষের শ্রেষ্ঠতম দরদী বন্ধু হওয়া সত্তে¡ও তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিত। তাঁর পবিত্র শরীরে আঘাতের পর আঘাত করেছে, তাঁকে রক্তাক্ত করেছে। তাঁকে দেশছাড়া পর্যন্ত করেছে।
তিনি তাদের সকল নিষ্ঠুরতা ক্ষমা করেছেন। মন থেকে আঘাতের সব চিহ্ন মুছে ফেলেছেন। প্রাণের শত্রুরা যখন আসামীরূপে সামনে হাজির হয়েছে, অতীতের সব মলিনতা ভুলে পরম মমতায় তাদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এমন স্নেহ-ভালোবাসা ও এমন ইজ্জত-সম্মান তাদের দেখিয়েছেন যে, তারা নিজেরাও সব তিক্ততা চিরতরে ভুলে গেছে এবং একান্ত সেবকরূপে তাঁর জন্য কুরবান হয়ে গেছে।
শত্রুর শত্রুতা ভুলে তাকে বন্ধুতে পরিণত করা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। আঘাতের বিপরীতে কল্যাণকামনা ও কাদার বদলে সুবাস বিলানোই ছিল তাঁর সুন্নত। অন্তরে মলিনতা পুষে রাখা তাঁর সুন্নতের পরিপন্থী। তিনি নিজে কোনও দিনই তা পুষে রাখেননি এবং তা পুষে রাখাকে অন্যের জন্যও অনুমোদন করেননি।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতগ্রন্থ যারা পড়েছে, তারা জানে, জীবনে তিনি কত শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, কত নিষ্ঠুরতা বিস্মৃত হয়েছেন এবং কত গভীর আঘাতের চিহ্ন অন্তর থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলেছেন।
উহুদ যুদ্ধের ঘটনা কে না জানে! বিজয়োন্মত্ত কাফেরগণ মুসলিম মুজাহিদদের সংগে কেমন আচরণ করেছিল? শহীদদের লাশ কেটে টুকরো টুকরো করেছিল। হাত-পা, নাক-কান কেটে বিকৃত করে দিয়েছিল। হযরত হামযা রা.-এর বুক ফেড়ে হৃৎপিন্ড বের করে ফেলেছিল। আবূ সুফয়ানের স্ত্রী হিন্দের উন্মত্ত আক্রোশ তাতেও মেটেনি। তার দাঁতের কামড়ে সে হৃৎপিন্ড ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাদের হিংগ্রতা যেন কোনওক্রমেই তৃপ্তি পাচ্ছিল না। তারা একযোগে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর হামলে পড়েছিল। তাদের আঘাতে তাঁর শিরোস্ত্রাণ ভেঙে যায়। তার কড়া চোয়ালে ঢুকে পড়ে। তাতে তাঁর নূরানী দাঁত শহীদ হয়ে যায়। এতসব পৈশাচিকতা যারা চালিয়েছিল, সে বাহিনীর নেতৃত্ব কে দিয়েছিল? নেতৃত্ব যে দিয়েছিল তার নাম আবূ সুফয়ান।
আবূ সুফয়ানের অতীত জীবনের কুখ্যাতি অনেক। সে জীবনে তিনি ছিলেন বহু কুকর্মের হোতা। মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে বহু ষড়যন্ত্র তিনি চালিয়েছেন। অনেক অঘটন তখন তিনি ঘটিয়েছেন। তার সে জীবনের দুষ্কৃতির ফিরিস্তি অনেক লম্বা। কিন্তু তার উপর্যুপরি দুষ্কর্মের একসময় ছেদ ঘটে। তা ঘটার পেছনে ছিল যে জিনিসের ভূমিকা, তা কেবলই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই সুন্নত, যা তিনি জীবনভর সকল শত্রুর সংগে রক্ষা করেছেন।
মক্কা বিজয়কালে আবূ সুফয়ান ধৃত হয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নীত হন। দুর্র্ধষ এ আসামীর সংগে সেদিন তিনি কী আচরণ করেছিলেন? প্রতিশোধ গ্রহণ? অতীত কর্মকান্ডের জন্য ধিক্কার? সরোষ তিরষ্কার? না কতলের হুকুম? এমন কিছু হওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নবী-জীবনে এ জাতীয় সংকীর্ণ স্বাভাবিকতার কোনও স্থান নেই। তিনি যা করলেন, আবূ সুফয়ানের পক্ষে তা ছিল অকল্পনীয়। তিনি তাকে ক্ষমা করেই ক্ষান্ত হলেন না, তাকে বানিয়ে দিলেন অন্যসব শত্রুরও প্রাণরক্ষার ঠিকানা। ঘোষণা করে দিলেন- আজ যে ব্যক্তি আবূ সুফয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে সেও নিরাপদ।
এমন মহানুভবতা কে কবে দেখেছে? মন থেকে শত্রুর আঘাত-চিহ্ন কতটা মুছে ফেললে এমন মহানুভবতা দেখানো সম্ভব? এ মহানুভবতারই সুফল যে, আবূ সুফয়ান আর শত্রু আবূ সুফয়ান থাকেনি। এর পর থেকে তিনি হয়ে যান হযরত আবূ সুফয়ান রা., যিনি ইসলাম গ্রহণ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উৎসর্গিতপ্রাণ সাহাবীদের তালিকায় নিজের স্থান করে নেন। এবার তিনি তাঁর পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করতে থাকেন এত দিনকার লালিত শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে আর এভাবে ঈমানে উদ্বেলিত রক্ত ঢেলে অতীতের সব গ্লানি মুছে ফেলেন। যুদ্ধ করেছেন হুনায়ন ও তায়েফে। তায়েফের যুদ্ধে তিনি এক চোখ হারিয়েছেন। তাঁর সে চোখ দ্বীনের সেবায় উৎসর্গিত, যার প্রতিদানে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানীতে পান জান্নাত লাভের আশ্বাস। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও তিনি ইসলামের সেবায় সমর্পিত থেকেছেন। যুদ্ধ করেছেন ইয়ারমুকে। এ যুদ্ধেও ছিল তাঁর বলিষ্ঠ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা। এ যুদ্ধে তাঁর দ্বিতীয় চোখেরও শাহাদাত নসীব হয়। মলিনতা মুছে ফেলার সুন্নত এভাবেই একদার ঘোরতর শত্রুকে দ্বীনের একজন পরম সেবকে পরিণত করেছে। আজ আমরা মহান এ সাহাবীকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় হযরত ইকরিমা রা.-এর অবস্থাও। তিনি আবূ জাহেলের পুত্র। আবূ জাহেল ছিল এ উম্মতের ফির‘আউন। বদরের যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে তার পক্ষে যা-কিছু সম্ভব ছিল সবই করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালি করেছে। সাহাবীগণের উপর অত্যাচার করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশের লোকজনকে বয়কট করেছে। তার সে বর্বরতা মানবেতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সবশেষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছে, যে কারণে তিনি হিজরত করতে বাধ্য হন। ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে তার সীমাহীন আক্রোশ ও বিদ্বেষ তার পুত্রতেও সংক্রমিত হয়েছিল। সুতরাং সকল জুলুম-অত্যাচারে ইকরিমাও তার বাবার এক অন্ধ সহযোগী হয়ে থেকেছে। উহুদের যুদ্ধে ইসলামী মুজাহিদদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল, তাতে সে-ই ছিল শত্রুপক্ষের মহানায়ক। সে তার শত্রুতা কোনওক্রমেই পরিত্যাগ করতে পারছিল না। মক্কা বিজয়কালে যখন অসহায় মুশরিকগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, তখনও সে তার একদল সহযোগীসহ প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। বলতে গেলে রক্তপাতহীন সে বিজয়ে কিছুটা হলেও যে রক্ত ঝরেছিল, সেজন্য ইকরিমাই দায়ী। তারপর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হল। দলে দলে মক্কাবাসী ইসলাম গ্রহণ করতে থাকল। কিন্তু ইকরিমার অন্তর থেকে ইসলামবিদ্বেষ কিছুতেই নামে না। পণ করল, ইসলামের অধীন মক্কায় সে থাকবেই না। থাকা সম্ভবও ছিল না। কারণ মক্কাভূমি এখন ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত। শিরকের অন্ধকার নিয়ে এখানে অবস্থান সম্ভব নয়। অগত্যা মক্কা ছেড়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করল। কিন্তু তার পক্ষে সেখানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। নিরুপায় ইকরিমা সোজা গিয়ে হাজির হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে। তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী আচরণ তার সাথে করলেন? দর্পিত বিজেতাগণ যা করে, সেরকম কিছু? না, মহাহৃদয়ের মহানবী উঠে তাকে স্বাগত জানালেন। বললেন- ‘আরোহী মুহাজিরকে স্বাগতম, স্বাগতম!’।



 

Show all comments
  • Morfud Ahmed Mollah (Farid) ২০ অক্টোবর, ২০২০, ১০:০৪ এএম says : 0
    Al-hamdullah.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নবী-চরিত্র
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ