Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নবী-চরিত্রের একটুখানি পাঠ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

এ মহানুভবতা ইকরিমার জীবন বদলে দিল। ইসলামের ঘোরশত্রু ইকরিমা এখন থেকে ইসলামের পরম সেবক। জন্মগত বীরত্ব তো ছিলই। ঈমানের স্ফূলিঙ্গ তাতে বাড়তি তেজ যোগাল। এতদিন তো ইসলামের বিরুদ্ধে শক্তিক্ষয় করছিলেন, এবার শুরু করলেন দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রক্তদান। প্রাণ বাজি রেখে একের পর এক রণক্ষেত্রে ছুটে যান। অক্লান্তভাবে জিহাদ করতে থাকেন। পরিশেষে ইসলামী ইতিহাসের এ বীর মুজাহিদ আজনাদাইনের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এ আর কিছুই নয়, অন্তর থেকে মলিনতা মুছে ফেলার সুফল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঘাতের বদলে ভালোবাসা দানের সুন্নত দ্বারা এরকম বহু শত্রুর জীবন বদলাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যাদের বদলে ফেলা সে জীবন ইসলামের সোনালি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মনের মলিনতা ভোলার আচরণ তিনি করেছিলেন মুনাফিকদের সাথেও। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবন উবাঈয়ের প্রতি দেখানো তাঁর মহানুভবতার নজির কে কোথায় পাবে? এ মুনাফিক কী না করেছে? কখনও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছে, কখনও সামনাসামনি অপমানকর উক্তি করেছে, কখনও ইহুদীদের উস্কানি দিয়েছে, কখনও আত্মকলহ সৃষ্টির চক্রান্ত করেছে, কখনও নবী-পরিবার সম্পর্কে ন্যক্কারজনক কথা বলেছে- এমন অপবাদ রটিয়েছে, যা ক্ষমা করার শক্তি কম মানুষেরই থাকে, এমনকি সে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছে। এতকিছু সত্তে¡ও তিনি তাকে কেবল ক্ষমাই করে গেছেন। জানা আছে সে একজন মুনাফিক। মুখে মুখে নিজেকে মুসলিম বলে, কিন্তু খাঁটি মনে কখনও ঈমান আনেনি। ওই যে মুখে মুখে নিজেকে মুসলিম বলত, সেদিকে তাকিয়ে দয়ার নবী সর্বদা তার মুক্তি কামনা করতেন। যখন তার মৃত্যু হয়ে গেল, তিনি তার জানাযাও পড়ালেন। হযরত ‘উমর ফারূক রা. তাঁকে বার বার জানাযা পড়াতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু ফেরাতে পারেননি। আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি যদি তার জন্য সত্তর বারও ক্ষমা চান, তাও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন, যদি জানতাম সত্তর বারের বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন, আমি তাও করতাম। শত্রুর দেওয়া আঘাতের কথা মনে রাখলে এতটা উদারতা দেখানো কখনও সম্ভব? কারও প্রতি যদি মনে সামান্য কালিমাও থাকে, তখনও কি সম্ভব এতটা মহানুভবতা প্রদর্শন?
বস্তুত সকল আঘাত ভুলে যাওয়া এবং মন থেকে সব মলিনতা মুছে ফেলা ছিল তাঁর সারা জীবনের আচরিত ধর্ম। ঘোরতর শত্রুর প্রতিও তাঁর এ আচরণে কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয় ক্ষেত্রেই তিনি এটা বজায় রেখেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর যখন প্রতিশোধ গ্রহণের অবারিত সুযোগ তাঁর সামনে, যারা তাঁকে হত্যা করতে সচেষ্ট ছিল, দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল, দেশত্যাগের পরও সমানে উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছিল, বিদ্বেষপরায়ণ সেই শত্রুগণ আসামীরূপে সামনে হাজির, দশ হাজার সশস্ত্র হুকুম বরদার আজ্ঞা পালনে প্রস্তুত, আঙ্গুলের এক ইশারায় হাজার হাজার শত্রুর শিরচ্ছেদ হয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন রাহমাতুল্লিল-আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক কণ্ঠ থেকে যে ফরমান উচ্চারিত হয়েছিল, তা ছিল তাঁর শুভ্র সফেদ হৃদয়েরই বাণী। তাঁর অমলিন অন্তর থেকে সে ধ্বনিই উৎসারিত হয়েছিল, যা বহুকাল আগে মহান নবী হযরত ইউসুফ আলাইহিস-সালাম, যারা তাঁর প্রাণনাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, সেই ভাইদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সেদিন মক্কাবাসীদের উদ্দেশে বলেছিলেন- আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু। [সূরা ইউসুফ (১২) : ৯২] সুতরাং তোমরা যেতে পার। তোমরা মুক্ত।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একান্তভাবে চাইতেন, যাতে কখনও কারও প্রতি তাঁর মন খারাপ না হয়। সকলের প্রতি তিনি সন্দেহমুক্ত ও অমলিন হৃদয়ের হয়ে থাকতে চাইতেন। তাই তিনি এটাও পসন্দ করতেন না যে, কেউ তাঁকে কারও সম্পর্কে অপ্রীতিকর কিছু শোনাক। কেননা তাতে সেই ব্যক্তির প্রতি তাঁর মন খারাপ হয়ে যেতে পারে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কেউ যেন আমার সঙ্গীদের কারও সম্পর্কে কোনও (বিরূপ) কথা আমাকে না শোনায়। কেননা আমি পরিষ্কার মন নিয়ে তোমাদের কাছে আসতে পসন্দ করি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৭৫৯; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৬৬৭৫; শারহুস-সুন্নাহ, হাদীস ৩৫৭১
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. এ হাদীস শোনার পর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে দুই ব্যক্তিকে পরস্পর আলাপচারিতায় লিপ্ত পেলেন। তারা দু’জন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে অশোভন উক্তি করছিল। তারা তাঁর সম্পর্কে যা বলছিল তিনি সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর আবার ফিরে আসলেন এবং তাদের সে কথা সম্পর্কে তাঁকে অবগত করলেন। কিন্তু তিনি এটা পসন্দ করেননি। -প্রাগুক্ত



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নবী-চরিত্র
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ