পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধকলের মধ্যে দেশে চুরি, ছিনতাই, দুর্নীতি, জালিয়াতি, টেন্ডারবাজির মতো অপরাধমূলক ঘটনা সচেতন ও বিবেকবানদের দুর্ভাবনায় ফেলেছে। এর মধ্যে ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে উঠতি বয়সের একশ্রেণীর কিশোরের সন্ত্রাসী কর্যক্রম। গ্যাং তৈরি করে বা দল বেঁধে এরা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমে এদের কিশোর গ্যাং হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এর সাথে জড়িতরা নিজেদের হিরোইজম এবং ক্ষমতা দেখাতে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদকাসক্ত হওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। তারা গ্যাংয়ের বিভিন্ন উদ্ভট নাম দিয়ে এ অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বিগবস, হাংকি-ফাংকি, নাইন স্টার, পাংকু টেন, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নাম দিয়ো যার যার এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাÐ চালাচ্ছে। তাদের ফেসবুক গ্রæপ থাকার পাশাপাশি বিশেষ পোশাকও রয়েছে। উদ্ভট ধরনের শব্দও তারা ব্যবহার করে। তাদের কিশোর গ্যাং বলা হলেও এসব গ্রæপে কিশোর বয়স অতিক্রম করেছে এমন সদস্যও রয়েছে। এতে যেমন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থী রয়েছে, তেমনি রয়েছে অছাত্রও। বরগুনার নয়ন বন্ডের গ্যাংও ছিল এ ধরনের। এসব গ্যাং আবার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়ে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। এক গ্রæপ আরেক গ্রæপকে শায়েস্তা করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে খুন করতেও দ্বিধা করছে না।
কিশোর গ্যাং নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর কিশোর গ্যাংয়ের বিবাদে খুন হয়েছে পাঁচ কিশোর। আর এ বছরের প্রথম আট মাসেই করোনার মধ্যে খুনের তালিকায় যোগ হয়েছে আরো সাত কিশোর। বেশ কয়েক বছর আগে কুমিল্লায় এ জাতীয় একটি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে নানা সন্ত্রাসী তৎপরতায়। তখন থেকেই কিশোর গ্যাং শব্দের প্রচলন। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তা রাজধানীসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাং কালচার আলোচনায় আসে ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় দুই গ্রæপের বিরোধের জেরে স্কুলছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর। এরপর ঢাকার বাইরেও কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রæপ গড়ে উঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পত্র-পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে রয়েছে ৬০টির মতো কিশোর গ্যাং। এদের মধ্যে ৩২টি সক্রিয়। স¤প্রতি এই গ্যাং গ্রæপের একটি রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় সোহাগ নামের এক কিশোর খুন হয়। তাকে হত্যা করে দি বস নামের গ্যাং। এর আগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাঠানটুলী এলাকায় আহাদ আলম শুভ মিয়া নামের এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এলাকার এক যুবককে চড়-থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতেই শুভকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। এছাড়া ফতুল্লার গাবতলীতে ওয়াসিফ গাউসিল উৎস নামের এক কিশোর রামদা হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে। এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজে এ ঘটনা ধরা পড়ে। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রæপের সংঘর্ষ চলাকালে আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় বন্দরের কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মিহাদ ও বন্দরের বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র জিসান । পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই দুই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ফতুল্লার দেওভোগ আদর্শনগর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা শরি হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য শাকিল ও লালনসহ কয়েকজন শত্রæতার জেরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। কিশোর গ্যাংদের এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি দেশের আইনশঙ্খলার জন্য নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
তথাকথিত এই কিশোর গ্যাং এখন কেবল ঢাকা-নারায়নগঞ্জে নয়, দেশের প্রায় সকল জেলা শহরে দোর্দÐ প্রতাপে চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সমাজের ভেতর এরা যেন আরেক সমাজ কায়েম করে চলছে। দীর্ঘদিনের প্রচলিত সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে একশ্রেণীর কিশোরের এই গ্যাং। মারামারি, খুনাখুনি, ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজি পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটর সাইকেলের মহড়া দেয়া, মাদক সেবন ও কারবার, মেয়েদের উত্ত্যক্ত ও ধর্ষণ করার মতো অপকর্ম করে সমাজকে অস্থির করে তুলছে। কোন গ্যাং কোন গ্যাংয়ের চেয়ে এগিয়ে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দিন দিন কিশোর গ্যাং বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন জেলা শহরে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক গ্যাং এখন সক্রিয়। এসব গ্যাংয়ের মধ্যে বিরোধের পাশাপাশি অন্তমিল ও সম্মিলনও হয়। কার বা কাদের মদদে গড়ে উঠছে এ ধরনের গ্যাং? এর জবাব এক কথায় মিলবে না। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান ভার্চুয়াল মিডিয়ার সহজলভ্যতা, হিরোইজম ও ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা এবং বয়সের অপরিপক্কতা ও পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা এর পেছনের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। এছাড়া পারিবারিক শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় উঠতি বয়সের কিশোররা বিপদগামী হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহারের প্রবণতাও কিশোর গ্যাং গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিশোর গ্যাং কালচারের উত্থানকে কেউ কেউ ভিন্নভাবেও দেখছেন। তাদের কথা হচ্ছে, সব অপরাধ সংঘটনের পেছনেই কিছু ‘ট্রিগার ফ্যাক্টর’ কাজ করে। অপরাধী যে অপরাধ করছে তা সে অপরাধ ভেবেও করতে পারে আবার না ভেবেও করতে পারে। তবে কিশোরদের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা বেশি কাজ করে। তারা নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করছে না।
শুরুতে এ গ্যাং কালচার কিছু স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকলেও এখন এর বিস্তার ঘটেছে অশিক্ষার্থী কিশোরদের মধ্যেও, এমনকি বস্তিবাসীর মধ্যে। দিনমজুর বস্তিবাসী কিশোর থেকে অভিজাত পরিবারের কিশোরও এখন এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। সাধারণ বিচারে এর কারণ হিসেবে বলা হয়, সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধ ও আদর্শগত অভাবের কথা। সু¯পষ্ট ভাষায় দায়ভার নির্ধারণ করতে চাইলে প্রথম অভিযোগের দায় পড়ে পরিবারের ওপর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, শৈশব থেকে সন্তানদের আদর্শনিষ্ঠ ও সৎপথে পরিচালনায় অভিভাবকদের উদাসীনতা কিশোরদের বিপথে যাওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী। বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত ও অনুরূপ পরিবারে অভিভাবকরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের সময় দিতে পারছে না। তারা কোথায় যায়, কার সাথে মেলামেশা করছে, কখন বাসায় ফিরছে, এ ব্যাপারে তারা উদাসীন। অথচ সন্তানদের যথাযথভাবে গড়ে তোলার দায় তাঁদের কাজ ও কর্তব্যের অংশ। এ দায়িত্ব পালিত না হলে শিশু-কিশোর শিক্ষায়তনে বা বাইরে সঙ্গীদের কুপ্রভাবে পথভ্রষ্ট হয়, নিষিদ্ধ পথের টানে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ক্রমে তা বাড়তেই থাকে নানা মাত্রায়। দ্বিতীয় দায়িত্ব শিক্ষায়তনের অভিভাবক তথা শিক্ষকদের। শ্রেণীকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীরা কী করছে সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব তাদের রয়েছে। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের দরদ দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই সঠিক পথে চলতে সহায়তা করা শিক্ষকদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না বলে কিশোর গ্যাংয়ের মতো সন্ত্রাসী গ্রæপ গড়ে উঠছে। এ ব্যাপারে পরিবার ও সমাজের সচেতন মহলকে কিশোরদের সঠিক পথে পরিচালিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে নতুন উপদ্রব কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।
মহামারীর কারণে মার্চ থেকে গত সাত মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গার্মেন্টস ও কল-কারখানাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে শিল্প-কারখানা চালু হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদেও লেখাপড়ার চাপ নেই। এ সুযোগে তাদের মধ্যে পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আড্ডা দেয়ার প্রবণতা থেকে বিপথে যাচ্ছে কিনা, তা আমলে নেয়া উচিৎ। এটা করোনার সাইড ইফেক্ট হয়ে থাকলে ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনার শঙ্কা থেকেই যায়। এ ব্যাপারে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে। আগামী প্রজন্ম যদি বিপথে চলে যায়, তবে তা রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে বাধ্য।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।