পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আইনের বাতিঘর বলে নন্দিত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আর নেই। গত ২৪ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার আদ-দ্বীন হাসপাতালে বর্ষীয়ান এই আইনজীবী শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজেউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বাধ্যকজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। দেশের আইনাঙ্গনে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ছিলেন কিংবদন্তি। সর্বজন-শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিত্ব আইনজীবীদের অভিভাবক হিসাবেও গণ্য হতেন। আইনযোদ্ধা হিসাবে তার সুখ্যাতি দেশের গÐি ছাড়িয়ে বাইরেও পরিব্যপ্তÍ ছিল। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। তার মতো সর্বমান্যব্যক্তি দেশে খুব বেশি নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যখন অব্যাহত তখন তার না থাকা একটা বিরাট ক্ষতি। এই ক্ষতি অপূরনীয়। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি এবং রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার স্মৃতি ও কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেছেন : দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রফিক-উল হক বড় অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন অভিজ্ঞ আইনবিদ হারালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন : রফিক-উল হক সংবিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন : তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনের ব্যাখ্যাতা হিসাবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক অন্যন্যসাধারণ পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ছিলেন অ্যামিকাস কিউরি বা আদালত বন্ধু। যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তিনি আদালতকে সহায়তা করেছেন। সঙ্গতকারণেই বলা যায়, তার শূণ্যতা সহসা পূরণ হবে না।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের জীবন বর্ণাঢ্য, আলোকোজ্জ্বল। একটানা প্রায় ৬০ বছর আইন পেশায় সক্রিয় ছিলেন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে লন্ডন থেকে তিন বছরের ব্যারিস্টারি কোর্স দেড় বছরে সম্পন্ন করেন। তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসেন ১৯৬২ সালে এবং এখানে আইন ব্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়া সত্তে¡ও তিনি সারাজীবন রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন। তার মানে এই নয় যে, তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রখর রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি। যখন রাজনীতি আক্রান্ত হয়েছে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, তখন তিনি সোচ্চার প্রতিবাদীর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছেন। দুর্দান্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিগত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে যখন কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তখন আইনজীবীদের অনেকেই তাদের পক্ষে লড়াই করার সাহস দেখাতে পারেননি সেখানে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন তিনি। এক সঙ্গে দুই নেত্রীর পক্ষে লড়েছেন। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া পরস্পরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে সেটা বড় হয়ে ওঠেনি এবং কোনো একজনের পক্ষে আইনী লড়াইয়ে তিনি অবতীর্ণ হননি। দুই নেত্রীই তার সমান মর্যাদা লাভ করেছেন। দেশের গণতন্ত্রের প্রতীক ছিলেন দু’ নেত্রী। সে বিবেচনাই তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। দেশের গণতন্ত্র উদ্ধারের ইতিহাসে এটা এক অন্যন্য ঘটনা। দুই নেত্রীর সংলাপ ও সহাবস্থানমূলক রাজনীতির পক্ষে ছিলেন তিনি। এজন্য চেষ্টাও তিনি করেছিলেন সাধ্যমত। সব সময় তিনি রাজনীতিনিরপেক্ষ থেকেছেন। কোনো দলে যোগ দেননি, এমন কি সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হননি। তিনি ১৯৯০ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেননি। শুধু তাই নয়, ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের বেতন-ভাতাও নেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে রফিক-উল হক ছিলেন সজ্জন, সদালাপী, সহৃদয় ও অত্যন্ত মানবিক। মানুষের সেবা ও কল্যাণে তিনি ছিলেন অনলস। তিনি সারাজীবন যত অর্থ রোজগার করেছেন, একজন চিকিৎসক হিসাবে তার স্ত্রী যত আয় করেছেন তার অধিকাংশই তিনি মানুষের সেবা ও কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন। আইনজীবী হিসাবে তিনি রাষ্ট্রের ও মানুষের খেদমত যেমন করেছেন তেমনি হাসপাতাল-ক্লিনিক স্থাপনে অর্থ ব্যয় করে আর্তমানবতার সেবায় অনুকরণীয় নজির স্থাপন করেছেন। ঢাকায় শিশু হাসপাতাল, সবর্ণ ক্লিনিক, আদ-দ্বীন হাসপাতাল, বারডেম, আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালসহ অনেক চিকিৎসা-সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। গাজীপুরের চন্দ্রায় ১০০ শয্যার সুবর্ণ-ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতাল তার এক অসাধারণ র্কীতি। এছাড়াও ২৫টির বেশি হাসপাতাল, এতিমখানা মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার তিনি অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছেন। এই কাজগুলোর কথা অনেকেরই অজানা। তিনি নিরবে এসব কাজ করে গেছেন। তার সততা, সৎ সাহস ও মানবসেবাব্রতিতা অতুল্য, অনুসরণীয়। আমরা জাতির এই মহান সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং তার পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।