তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম : এটা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এখানে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার আগে যেসব রাজার শাসন ছিল তারা এ দেশের মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে নিষিদ্ধ ভাষা করে দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, অষ্টাদশ পুরানানি রামস্য চরিতা নিচ/ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরব নরকং ব্রজৎ অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরান রামচরিত ইত্যাদি মানুষের ভাষায় (বাংলায়) চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে।
এখানে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা শাহী ভাষায় উন্নীত হলো। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত হলো। সেই সঙ্গে বাঙালিয়ান সত্তা স্বাধীন সত্তা লাভ করল। প্রতিষ্ঠিত হলো শাহে বাঙ্গালা সুলতানে বাঙ্গালা।
সুলতানি আমলে বাংলা ভাষায় অসংখ্য পুঁথি, কাব্যসম্ভার বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ভাষাতে পরিণত করল।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা তাদের এদেশীয় দালালের সহযোগিতায় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য লুট করে নিল। কিন্তু বাঙালিয়ানরা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা থেকে পিছপা হলো না।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, যদি পলাশী ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য বিপর্যয় না ঘটিত তবে হয়তো এই পুঁথির ভাষায় হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি জনতার মহাবিপ্লবের পরে নতুন করে বাংলার মুসলিমরা কলম ধরেন। সেই সময় ফুরফুরার পীর মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) বাংলা ভাষায় বইপুস্তক এবং পত্র-পত্রিকা প্রকাশের জন্য জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।
আমরা যদি বাংলা ভাষায় দৈনিক পত্রিকা সম্পর্কে পর্যালোচনা করি তা হলে দেখব প্রথম প্রকাশিত দৈনিক ছোলতান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, যিনি ফুরফুরা শরিফের পীর মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)-এর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। এদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখপাত্র দৈনিক আজাদের সম্পাদক ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁ। মূলত মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন বাংলার মুসলিম সাংবাদিকতার অগ্রপথিক। আবার যদি দেখি বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখপাত্র দৈনিক ইত্তেফাককে। এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী যেমন এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার মজলুম জননেতা, তেমনি তিনি ছিলেন একজন কামিল পীর। দৈনিক ইত্তেফাক জনপ্রিয়তার শীর্ষে উন্নীত হয়েছিল।
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা আবদুল মান্নানের সম্পাদনায় দৈনিক ইনকিলাব বিপুল পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়, যার চলমানতা এখনও বিদ্যমান। মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ.) এদেশের মাদরাসা শিক্ষকগণকে একটি শক্তিশালী জমিয়তে ঐক্যবদ্ধ করে অমর হয়ে রয়েছেন। তার পিতা ছিলেন ফুরফুরা মুজাদ্দিদে যামান মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) -এর খলিফা। ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেব (রহ.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় সেকালে অনেক সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইসলাম প্রচারক (১৮৯১), মিহির সুধাকর (১৮৯৫), নবনূর (১৯০৩), মোসলেম হিতৈষী (১৯১১), ছোলতান (১৯০২), মোহাম্মদী (১৯০৩), আল-ইসলাম (১৯১৫), ইসলাম দর্শন (১৯২০), ইসলাম জগৎ (১৯২৩), শরীয়ত (১৯২৪), হানাফী (১৯২৬), বঙ্গ নূর (১৯১৯), রওশনে হেদায়ৎ (১৯২৪), আল-মুসলিম (১৯২৮), তরুণের ঝা-া (১৯৩০), সুন্নত আল-জামায়াত (১৩৪০ বাং), হেদায়েত (১৩৪২)। ডক্টর আনিসুজ্জামান লিখেছেন, একজন বিখ্যাত পীর ছিলেন ফুরফুরার আবু বকর সাহেব। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের লেখকদের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। তাদের সাহিত্যিক, সাংবাদিক প্রচেষ্টায় তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। (মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য)
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ‘হক কথা’ বের হয়, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।